বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

খোদা বক্‌স সম্পর্কে স্মৃতিচারণে সি.এম. রহমান

‘তাঁর দিবারাত্রির স্বপ্ন ছিল বীমা বীমা আর বীমা’

বিবিএনিউজ.নেট   |   মঙ্গলবার, ১৬ জুন ২০২০   |   প্রিন্ট   |   517 বার পঠিত

‘তাঁর দিবারাত্রির স্বপ্ন ছিল বীমা বীমা আর বীমা’

বীমা জগতের কিংবদন্তি খোদা বকস সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বিশিষ্ট বীমাব্যক্তিত্ব সি এম রহমান বলেন, তাঁর মতো একজন ব্যক্তির স্মৃতিচারণ করা খুবই আনন্দের একটি বিষয়। আমাদের দু’জনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল এবং আমরা কয়েক বছর যাবৎ খুব কাছাকাছি কাজ করেছিলাম। আমি সত্যিই দীর্ঘকাল ধরে জনাব খোদা বকসকে জানতাম। যখন আমি বাণিজ্য বিভাগে স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করছিলাম, আমার মুখ্য বিষয় ছিল “বীমা”। আমার শেষ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতির সময়ে, আমি জীবনবীমার কিছু নির্দিষ্ট দিক সম্বন্ধে আরও জানতে চেয়েছিলাম। সেই সময়ে, খুব কম মানুষ বীমা নিয়ে পড়াশোনা করতেন, আর বিষয়টি সম্বন্ধে শেখার সুযোগ ভীষণ কম ছিল। তাই আমি জনাব খোদা বকসের পরামর্শ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
যখন আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য তাঁর ঘরে ঢুকেছিলাম, জনাব খোদা বকস দাঁড়িয়ে উঠেছিলেন এবং দরজায় এগিয়ে এসে আমাকে অভ্যর্থনা করেছিলেন। বিষয়টির উপর তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞান ও তাঁর মন্ত্রমুগ্ধ ব্যক্তিত্ব দেখে আমি বিহŸল হয়ে গেছিলাম। যদিও আমি কেবলমাত্র একজন ছাত্র ছিলাম আর তুলনায় বয়স অনেক কম ছিল, তিনি আমার প্রতি খুব সহায়তাপূর্ণ, নম্র ও দয়ালু ব্যবহার করেছিলেন। আমাদের কথোপকথন দীর্ঘক্ষণ হয়েছিল। এখন সেটি সত্যিই আমার মনে নেই, কিন্তু এখনও আমার মনে আছে যে, তাঁর প্রতি ও বীমা সম্বন্ধে তাঁর গভীর জ্ঞানের প্রতি প্রবল শ্রদ্ধা নিয়ে আমি সেইদিন বেরিয়েছিলাম।

ইস্ট পাকিস্তান কো-অপারেটিভ ইন্সিওরেন্স সোসাইটি (EPCIS)-এ যোগদান করার পর আমি তাঁর সঙ্গে নিকট যোগাযোগে এসেছিলাম। আমি যোগদান করার পর তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, ইপিসিআইএস (EPCIS)-এ আমার যোগদানের ব্যাপারে তিনি সহায়তা করেছিলেন। ইপিসিআইএস (EPCIS)-এর ব্যবস্থাপনা জনাব খোদা বকসের কাছে জীবনবীমা বিভাগের জন্য একজন যোগ্য ব্যক্তির সন্ধান চেয়েছিলেন এবং শ্রেষ্ঠ পছন্দ হিসেবে তিনি আমার কথা ভেবেছিলেন। সেই সময়ে আমি হাবিব বীমা প্রতিষ্ঠান লিমিটেডে কাজ করছিলাম। তিনি ইপিসিআইএস(EPCIS)-এর নির্দেশক সমিতির একজন সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে করাচিতে আমার প্রধান ব্যবস্থাপকের সঙ্গে দেখা করে আমার সম্বন্ধে খোঁজ করেছিলেন। জীবনবীমা বিভাগের প্রধান হিসেবে ইপিসিআইএস (EPCIS)-এ যোগদান করার জন্য আমাকে ১৯৬২ সালের অক্টোবর মাসে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।

১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসে ইপিসিআইএস (EPCIS) ছাড়ার জন্য যখন আমি প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, জনাব খোদা বকস করাচি থেকে আমাকে ফোন করেছিলেন এবং তাঁকে আমার করা প্রতিজ্ঞাটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে যদি কখনও আমি ইপিসিআইএস (EPCIS) ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই, আমি যেন তাঁর প্রতিষ্ঠানে যোগদান করি। তিনি আমাকে আরও বলেছিলেন যে তিনি আমাকে বিমানের টিকিট পাঠিয়ে দিচ্ছেন এবং আমাকে অভ্যর্থনা করার জন্য তিনি বিমানবন্দরে থাকবেন। এই ছোট ঘটনাটি থেকে যে কেউ বুঝতে পারবেন যে, তিনি কতটা দূরদর্শী ছিলেন এবং তাঁর প্রতিষ্ঠানকে তিনি কতটা ভালোবাসতেন। ইস্টার্ন ফেডারেল ইউনিয়ন বীমা প্রতিষ্ঠান লিমিটেডে আমার যোগদানের পরের রাত্রে, বীচ লাক্সারি হোটেলে প্রতিষ্ঠানের তরফে রাত্রে খাওয়ার একটি আসর ছিল, যেখানে জনাব খোদা বকস আমার সঙ্গে ব্যবস্থাপনার নির্দেশক, রোশেন আলি ভিমজী, যিনি পাকিস্তানের বীমাশিল্পে খুব পরিচিত একজন ব্যক্তি, তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমি কিছু সময় যাবৎ জনাব ভিমজীকে চিনতাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে তিনি জানতেন ইপিসিআইএস (EPCIS)-এর জীবন বিভাগটি প্রতিষ্ঠিত করতে আমি কঠোর পরিশ্রম করেছিলাম এবং ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যে করাচিতে প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ে যেন তিন মাস আমি বিশ্রাম ও উপভোগ করি, আর যাতে ঢাকাতে আমার স্ত্রী যেন আমার বেতনের চেক পেয়ে যান। এই কথায় সেখানের কাজের পরিবেশ এবং আধিকারিকদের প্রতি উচ্চ ব্যবস্থাপনার মনোভাব প্রদর্শিত হয়।

ইস্টার্ন ফেডারেলের পরিবেশ মালিক-কর্মচারী সম্পর্কের ছিল না। এটি একটি পরিবারের মতো ছিল। এটি আমার খুব ভালো লেগেছিল আর ব্যবস্থাপনার এই প্রকারের মনোভাব প্রতিষ্ঠানের জন্য সবচেয়ে ভালো কাজটি করতে উৎসাহ দিয়েছিল। ১৯৭২ সালে আমি ইএফইউ (EFU) ছেড়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমি পরিবারের মতো একটি পরিবেশে কাজ করেছিলাম। ১৯৭২ সালে আমি সদ্যজাত বাংলাদেশে চলে গেছিলাম।

যখন ইএফইউ (EFU) বীমা প্রতিষ্ঠানে করাচিতে প্রধান কার্যালয়ে একজন ব্যবস্থাপক হিসেবে আমি যোগ দিয়েছিলাম, জনাব খোদা বকস জীবনবীমার প্রধান ব্যবস্থাপক ছিলেন। তাই স্পষ্টত. প্রধান কার্যালয়ে জনাব খোদা বকস ব্যতীত আমি ছিলাম একমাত্র বরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানি কার্যনির্বাহী। প্রধান কার্যালয়ে ব্যবস্থাপক হিসেবে আমাকে সরাসরি নিয়োগের কারণে এই পদের জন্য অনেক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল। তাই স্বাভাবিকভাবে আমার নিয়োগের বিরুদ্ধে প্রচুর ঝড় উঠেছিল।

জনাব খোদা বকস ১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যবস্থাপক হিসেবে ইএফইউ (EFU)-তে যোগদান করেছিলেন। জনাব খোদা বকস, যিনি খুব কঠোর পরিশ্রমী আর বীমা বিক্রয়ের একনিষ্ঠ একজন ব্যবস্থাপক ছিলেন, তিনি গোটা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে কর্মক্ষেত্রের জন্য দৃঢ় লোকবল গঠন করেছিলেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে জীবনবীমার প্রাণপুরুষ হয়ে উঠেছিলেন। এই কারণেই ইএফইউ (EFU) পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে অনেক বেশি নতুন বীমার ব্যবসা লগ্নি করতো।

জনাব খোদা বকস উচ্চ সরকারি আধিকারিক, পেশাদার, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ইত্যাদি মানুষদের সঙ্গে দারুণভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি রোটারি ক্লাবের একজন জনপ্রিয় সদস্যও ছিলেন। তাঁর মহৎ স্বভাব, সরল জীবন, অবিচলিত সততা, আর কর্তব্যের প্রতি দৃঢ় চেতনা তাঁর সংস্পর্শে আসা সকলের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জয় করে নিয়েছিল।

আমি একটি ঘটনার কথা বলতে পারি যেটি তাঁর ব্যবস্থাপনার শৈলীকে প্রতিফলিত করে। একবার আমরা একসঙ্গে যাচ্ছিলাম। আমাদের কর্মক্ষেত্রের আধিকারিকদের মধ্যে একজনের একটি ছোট গাড়ি ছিল এবং তিনি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়েছিলেন। গাড়িটিতে কিছু সমস্যা হচ্ছিল। জনাব খোদা বকস তখনই তাঁর গাড়ি থেকে নেমে ওনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আপনি আপনার গাড়িটি বদলাচ্ছেন না কেন? একটি নতুন গাড়ি কিনে নিন!” আমি জনাব খোদা বকসকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “আপনি ওনাকে এতকিছু অনুমোদন করেছেন আর আপনি প্রতিষ্ঠানের অগ্রিম টাকায় ওনাকে একটি গাড়ি কেনার প্রস্তাব দিচ্ছেন? আপনি এটি যুক্তিসঙ্গতভাবে বোঝাতে পারেন কি?” খোদা বকস আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “এই মানুষটির মধ্যে বিক্রয়কর্মী হিসেবে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। তাই আমি আপনাকে ওনার শ্রেষ্ঠ সামর্থ্য অনুযায়ী ওনার সম্ভাবনার সদ্ব্যবহার করতে সুযোগ দিচ্ছি। এটিতে ওনার ক্ষেত্রে উৎসাহ প্রদান করা হয় আর ব্যবসা বাড়ানোর জন্য খুব সদর্থক একটি পদক্ষেপ হয়।” আমি সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হয়েছিলাম যে তিনি সঠিক বলেছিলেন।
আমরা সাধারণত একসঙ্গে থাকতাম, তাই আমি তাঁকে দিনরাত দেখতে পেতাম। তিনি খুব সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। তিনি সবদিক থেকেই আমার খেয়াল রাখতেন। তিনি স্বভাবে খুব সাধারণ, খুব সৎ, খুব আন্তরিক, খুব সহায়তাপূর্ণ আর সর্বদা হাসিমুখের ছিলেন। আমি তাঁকে কখনও উদ্বিগ্ন মানসিকতায় থাকতে দেখিনি। তিনি সবসময় হাসিখুশি, সবসময় কথা বলা এবং পেশার প্রতি ভীষণ একনিষ্ঠ ছিলেন। সর্বক্ষণ, যখনই তিনি লোকজনের সঙ্গে দেখা করতেন, তিনি সাধারণত বীমা, বীমা, আর বীমা বিষয়ে কথা বলতেন- যা ছিল তাঁর দিবারাত্রির স্বপ্ন।

সেই সময়ে, একজন পূর্ব পাকিস্তানির পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের জীবনবীমা কর্মক্ষেত্রের লোকবলকে শাসন করা ও সামলানো মোটেও সহজ কাজ ছিল না। বিশেষত. কর্মক্ষেত্রের ব্যবস্থাপনা খুব কঠিন ব্যবস্থাপনা হয়, কারণ কর্মক্ষেত্রের আধিকারিকরা কোনও চাকরির আইনের অধীনস্থ থাকেন না এবং তাঁরা ব্যবস্থাপনার কোনও কঠোর নিয়ন্ত্রণে থাকেন না। তৎসত্ত্বেও জনাব খোদা বকস পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মক্ষেত্রের সকল আধিকারিকদের হৃদয় জয় করতে পেরেছিলেন এবং কর্মক্ষেত্রের জন্য দৃঢ় ও দক্ষ লোকবল গঠন করেছিলেন। সেই সময়ে ইস্টার্ন ফেডারেল ছিল পাকিস্তানের প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান।
প্রতিষ্ঠান ও তার কর্মচারীদের মধ্যে যখনই কোনও অসন্তোষ বা বাদানুবাদ হতো, জনাব খোদা বকস তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিগত সম্পর্ক প্রয়োগ করতেন। আমি জানতাম যে ঢাকায় আমাদের কর্মক্ষেত্রের কয়েকজন বরিষ্ঠ আধিকারিক পদত্যাগ করেছিলেন। তিনি তাঁদের বাড়িতে গিয়ে ইস্টার্ন ফেডারেলে যোগদান করতে ফিরে আসার জন্য বুঝিয়েছিলেন। তাঁর সমাধান করার উপায় এইরকম ছিল। তিনি সাধারণত তাঁর ব্যক্তিগত উপায়ের দ্বারা সমস্যার সমাধান করতেন। জনাব খোদা বকসের ব্যবস্থাপনার আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল। তিনি কেবলমাত্র উদ্দিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতেন না, বরং তাঁর পরিবারের সকল সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতেন। তিনি তাঁদের বাড়িতে যেতেন, তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে কথা বলতেন এবং একটি পারিবারিক যোগসূত্র স্থাপন করতেন, যাতে যদি তিনি কোনও আধিকারিককে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন, তাহলে তাঁর স্ত্রীকে বোঝাতেন যে তাঁকে ইস্টার্ন ফেডারেলে ফিরিয়ে আনার জন্য সম্মত করাতে। এতে বোঝা যায় যে, তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠান ও তাঁর নিজের মানুষদের কতটা পছন্দ করতেন।

তিনি প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিদের মধ্যে এবং কর্মক্ষেত্রের আধিকারিকদের বিভিন্ন দলের মধ্যে প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে এসেছিলেন… একই সময়ে, একদল মানুষ ছিলেন যারা সাধারণত কর্মক্ষেত্রের প্রত্যেক বরিষ্ঠ আধিকারিকের অধীনে এক-একজন একক হিসেবে কাজ করতেন। তিনি সময়ে সময়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ঘোষণা করতেন এবং তাঁদের বিভিন্ন রকমের পুরস্কার দিতেন। যারা সাধারণত অসাধারণ কাজকর্ম করতেন তিনি তাঁদের গাড়ির জন্য অগ্রিম বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পুরস্কৃত করতেন।

ইএফইউ (EFU)-এর বিস্ময়কর অগ্রগতিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম. নতুন জীবনবীমা ব্যবসার বৃদ্ধি: এই ক্ষেত্রে, জনাব কে. বি. ছিলেন একজন অবিস্মবাদিত নেতা এবং ব্যবস্থাপনার নির্দেশক থেকে শুরু করে প্রত্যেকে তাঁকে সমাদর করতেন। সমাদরের চিহ্ন হিসেবে আমরা দেখেছিলাম যে বৎসরান্তে, যখন জনাব খোদা বকস করাচিতে তাঁর প্রধান কার্যালয়ে ফিরতেন, করাচি বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা করার জন্য প্রত্যেকে উপস্থিত থাকতেন। এতে পরিলক্ষিত হয় যে, তিনি ছিলেন ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। এখন একটি জীবনবীমা প্রতিষ্ঠানের সার্বিক বৃদ্ধির জন্য এই বৃদ্ধি স্বয়ং সর্বেসর্বা হয় না। অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য বরিষ্ঠ কার্যনির্বাহীদের প্রচুর অবদান ছিল।

যখন জনাব খোদা বকস জীবনবীমার প্রধান ব্যবস্থাপক ছিলেন, আমি ইএফইউ (EFU)-এর জীবনবীমার প্রধান কার্যালয়ে ব্যবস্থাপক ছিলাম। তাই তাঁর পর, প্রধান কার্যালয়ে আমি ছিলাম একমাত্র বরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানি কার্যনির্বাহী। আমাদের ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানে প্রিমিয়ার বীমার জনাব মহম্মদ আহমেদ ছিলেন একমাত্র বরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানি বীমা কার্যনির্বাহী। দুর্ভাগ্যবশত. পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগতদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষদের মনোভাব প্রসন্ন ছিল না। তাঁরা তাঁদের নিচু নজরে দেখতেন এবং তাঁদের ভালো কাজের সমাদর করতে বা তাঁদের প্রাপ্য সম্মান দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। এই কারণে জাতীয় স্তরে আঞ্চলিক অসাম্য সৃষ্টি হয়েছিল।

এখানে আমি একটি ছোট ঘটনা মনে করতে পারি। ১৯৬৭ সালে লাহোরের পাকিস্তান প্রশাসনিক কর্মী মহাবিদ্যালয়ের চৌদ্দতম অধিবেশনে আমি একজন অংশগ্রহণকারী ছিলাম। সেটি ছিল পাকিস্তান সরকারের অসামরিক কর্মচারীদের জন্য অধ্যয়নের উচ্চতম শিক্ষালয়। চৌদ্দতম অধিবেশনে আমার সহপাঠীদের মধ্যে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের মুখ্য সচিব জনাব এস. বি. আওয়ান এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকারের দুই সচিব জনাব আলাউদ্দিন আহমেদ ও জনাব এস. বি. চৌধুরীদের মতো বরিষ্ঠ আধিকারিকরা ছিলেন।

প্রতিটি প্রধান আঞ্চলিক কার্যালয়ে, মহাবিদ্যালয়ের প্রাক্তন অংশগ্রহণকারীদের জন্য একটি করে পর্ব থাকতো, যেখানে সাম্প্রতিক জাতীয় সমস্যাগুলির উপর আলোচনা করার জন্য মাসে একবার করে সম্মিলিত হতে হতো। ১৯৭০ সালের শেষদিকে আমাদের করাচি পর্বে “পাকিস্তানের আঞ্চলিক অসাম্য” সমস্যার উপর আলোচনা করার জন্য আয়োজন করা হয়েছিল। সেই সময়ে সেটি একটি দগদগে রাজনৈতিক সমস্যা ছিল। বক্তা ছিলেন পাকিস্তান সরকারের একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব, যিনি পূর্ব পাকিস্তানেও আঞ্চলিক সচিব হিসেবে কাজ করেছিলেন। শুরুতেই বক্তা পাকিস্তানের অসাম্যের ইতিহাস বর্ণনা করেছিলেন এবং তারপর বলতে চেষ্টা করেছিলেন যে, বাস্তবে সেটি একটি অনুমান-নির্ভর সমস্যা ছিল। তিনি বলেছিলেন যে ১৯৫০-এর শুরুর দিকে পূর্ব পাকিস্তানের সাংসদরা সংসদে উপস্থিত হওয়ার জন্য সাধারণত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপককে সঙ্গে নিয়ে আসতেন। এই অধ্যাপকরা ওই সাংসদদের পূর্ব পাকিস্তানে হওয়া অর্থনৈতিক অসাম্যের বিষয়ের উপর বলার জন্য শেখাতেন। তিনি এই বিশ্বাস দিতে চেয়েছিলেন যে এই উদাহরণের সাংসদরা আঞ্চলিক অসাম্যের উপর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু খামখেয়ালি অধ্যাপকদের শেখানো মিথ্যা কথাগুলি বলতেন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিদেশি মুদ্রার বিতরণ, অসামরিক প্রশাসনিক কর্ম ও সামরিক বাহিনিতে নিয়োগ ইত্যাদিতে গভীর অসাম্যের কারণে পূর্ব পাকিস্তানে হওয়া বঞ্চনাগুলি সম্বন্ধে তিনি সুবিবেচক ছিলেন না। প্রশ্নোত্তর পর্বের সময় আমি উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, “অর্থনৈতিক অসাম্যের বৃদ্ধি সম্বন্ধে পূর্ব পাকিস্তানি সাংসদদের আশঙ্কার প্রতি যদি মনোযোগ দেওয়া হতো, তাহলে বিষয়টি বর্তমানে দেশের ঐক্য বিপন্ন হওয়ার মতো গুরুতর অবস্থায় পৌঁছতো না। এটিও খুব দুর্ভাগ্যজনক যে, ১৯৫০-এর শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা যা দেখতে পেয়েছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সাংসদ বা পাকিস্তান সরকার কেউ সেগুলির সমাদর করতে পারেননি। এখন যখন ১৯৬২ সালের সংশোধিত সংবিধানের থেকে কম নয় এমন একটি নথিতে স্বীকার করা হয়েছে যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ব্যাপকহারে অসাম্য ছিল, তখন অস্বীকার করার কোনও সুযোগ নেই।” আমার বক্তব্যটি জ্বলন্ত অগ্নিকাণ্ডের উপর ঠান্ডা জল ছুড়ে দেওয়ার মতো হয়েছিল। বক্তা আশা করেননি যে, সেখানে একজন পূর্ব পাকিস্তানি অংশগ্রহণকারী উপস্থিত থাকবেন এবং দ্রুত তাঁর বক্তব্যের গতি শুধরে নিয়েছিলেন।

ঘটনা হলো, এইরকমের মনোভাব অধিকাংশ সরকারি কার্যালয়ে ও সামরিক বাহিনিতে প্রচলিত ছিল। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতেও একই ছায়া দেখা যেতো। করাচিতে যখন জনাব খোদা বকস পাকিস্তানের জীবনবীমা ব্যবস্থাপকের পদে ছিলেন, তিনি প্রচুর অসহযোগিতা ও অপমানের মুখোমুখি হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এমন চরিত্রের ছিলেন না যাকে দমন করে রাখা যায়।

আমি জনাব ভিমজীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই সময়ে আমি জনাব খোদা বকস ও জনাব আর. এ. ভিমজী উভয়ের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। তাঁরা কখনও কখনও একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেন এবং উভয়েই তাঁদের অনুভূতি সম্বন্ধে আমাকে জানাতেন। জনাব খোদা বকস অবসর নেওয়ার বয়সে অবসর নিয়েছিলেন। জনাব ভিমজী পূর্ব পাকিস্তানে একটি পাট কারখানা স্থাপনের জন্য আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু জনাব খোদা বকসের মনে হয়েছিল যে এটি তাঁকে তাঁর বীমার পেশা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য একটি কৌশল। তিনি প্রস্তাবটি গ্রহণ করেননি এবং আরেকটি নতুন জীবনবীমা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন।

আমার কাছে এটি বিস্ময়ের বিষয় ছিল না, কারণ জনাব খোদা বকস আমার সঙ্গে মাঝেমাঝে আলোচনা করতেন যে তিনি একটি নতুন জীবনবীমা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধীকরণের ব্যাপারে কীভাবে এগোচ্ছিলেন। তিনি আমার সঙ্গে জনাব এম. এ. সামাদ ও অন্যান্যদের মতো তাঁর কয়েকজন বরিষ্ঠ কার্যনির্বাহীদের নির্বাচন করার বিষয়েও আলোচনা করেছিলেন। আমি খুব খুশি হয়েছিলাম যে বীমার এইরকম একজন বিশাল বীরপুরুষ পূর্ব পাকিস্তানে জীবনবীমা প্রতিষ্ঠান শুরু করবেন, যেটি পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য অবশ্যই একটি গৌরবের বিষয় হয়ে উঠবে।

আমার মনে হয় জনাব খোদা বকসের অনুপস্থিতি পূর্ব পাকিস্তানে অনেক বেশি পরিমাণে অনুভ‚ত হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে যেহেতু উচ্চতম ব্যবস্থাপনা তাঁর পদত্যাগের বিষয়ে আগে থেকে জানতেন, তাঁরা ইতিমধ্যেই খুব সুসম্পন্ন ব্যবস্থা করেছিলেন এবং তাঁর অবসরের অব্যবহিত পরেই পিন্ডি ও লাহোরের আঞ্চলিক কার্যালয়ের বদলে প্রধান কার্যালয়ে ব্যবসা ও অন্যান্য বীমা পরিষেবাগুলি সামলানোর জন্য উচ্চপর্যায়ে অনেক পরিবর্তন করেছিলেন। তাই সেখানে সবকিছু বেশ স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তাঁর ব্যবস্থাপনার কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর অনুপস্থিতি অনেক বেশি পরিমাণে অনুভ‚ত হয়েছিল।

আমি প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করতাম এবং সেটিই আমার উদ্দেশ্য ছিল। আমি জনাব খোদা বকস বা জনাব ভিমজীর জন্য কাজ করতাম না। একজন বরিষ্ঠ কার্যনির্বাহী হিসেবে আমার আনুগত্য ছিল প্রতিষ্ঠানের প্রতি। যদিও ব্যক্তিগত সম্পর্ক সবসময়েই ছিল। জনাব খোদা বকস এবং জনাব ভিমজী দু’জনের সঙ্গেই আমার চমৎকার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। একবার জনাব খোদা বকস প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যাওয়ার পর পরবর্তী ব্যবসায়িক বৎসরান্তে জনাব ভিমজীর বাড়িতে রাত্রে খাওয়ার আয়োজন হয়েছিল এবং আমরা তাঁর ঘাসে ঢাকা উঠোনে পান করছিলাম, পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্ত বরিষ্ঠ আধিকারিকরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ জনাব ভিমজী আমাকে বলেছিলেন, “জনাব রহমান, আপনি জনাব খোদা বকসের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন, কিন্তু সেজন্য আপনার কোনও ক্ষতি হবে না।”

সূত্র : বীমাবিদ খোদা বক্‌স স্মারক গ্রন্থ (পৃষ্ঠা ৪২-৪৭)

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৩:০৫ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১৬ জুন ২০২০

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।