বিবিএনিউজ.নেট | শনিবার, ২০ জুলাই ২০১৯ | প্রিন্ট | 809 বার পঠিত
অবসায়িত হলো আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং। কিন্তু পিপলস লিজিং যুগের অবসান হবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান গ্রাহক থেকে শুরু করে খাতসংশ্লিষ্ট সবাই। জানা গেছে, হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (সংক্ষেপে এনবিএফআই, তবে লিজিং কোম্পানি হিসেবে বেশি পরিচিত) ছাড়া বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো গত কয়েক বছর ধরে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে এনবিএফআইগুলোর অভিঘাত সহনীয়তা পরখ করে আর্থিক স্থিতিশীলতার যে মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করে, তাতে দেখা যায় গত পাঁচ বছর ধরেই ডজনখানেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
ওই প্রতিবেদনে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা এনবিএফআইগুলোকে ‘সবুজ’ অঞ্চলে রাখা হয়। খুব ভালো নয়, আবার খুব খারাপও নয় এমন অবস্থানে থাকা এনবিএফআইগুলোকে ‘হলুদ’ অঞ্চলে এবং মন্দ অবস্থানে থাকা এনবিএফআইগুলোকে ‘লাল’ অঞ্চলে রাখা হয়।
পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে অভিঘাত সহিষ্ণুতায় লাল অঞ্চলে ছিল ১০টি এনবিএফআই। এরপর থেকে কখনও কখনও এই সংখ্যা ৭-এ নেমে আসে, আবার কখনও ১৫তে গিয়ে ঠেকত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে অভিঘাত সহিষ্ণুতার দিক দিয়ে দেশের এনবিএফআইগুলোর মধ্যে ১২টি প্রতিষ্ঠান ছিল লাল অঞ্চলে। আর হলুদ অঞ্চলে ছিল ১৮টি প্রতিষ্ঠান। মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান ছিল সবুজ অঞ্চলে।
প্রসঙ্গত, ওই প্রতিবেদনে কোনো এনবিএফআই’র নাম উল্লেখ করে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে পিপলস লিজিং অবসায়িত হওয়ায় বর্তমানে দেশে এনবিএফআই’র সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৩টিতে। এসব প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সূচকগুলো বিশ্লেষণ করে বেশ কয়েকটি এনবিএফআইকে আলাদা করা গেছে, যেগুলোর অধিকাংশের বিরুদ্ধে পিপলস লিজিংয়ের মতো গ্রাহকের আমানত ফেরত দেওয়া নিয়ে টালবাহানার অভিযোগ উঠছে।
এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে খেলাপিতেও পরিণত হয়েছে। জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত তথ্যে দেখা যায়, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড ৮৩৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, এর মধ্যে ৫৩ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে। এফএএস ফাইন্যান্সের নেওয়া ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৭৭ কোটি টাকা। অবসায়িত পিপলস লিজিংয়ের নেওয়া ২৭৫ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৪৭ কোটি টাকা।
বিআইএফসির নেওয়া ২০১ কোটি টাকা ঋণের পুরোটাই এখন খেলাপি রয়েছে। প্রাইম ফাইন্যান্স ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের ২০৭ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ২২ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
এর বাইরে ফার্স্ট ফাইন্যান্স, বে লিজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও ইউনিয়ন ক্যাপিটালসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এখনও বিভিন্ন আর্থিক সূচকে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে।
যদিও নীতিগত কারণে এ প্রতিষ্ঠানগুলোই লাল অঞ্চলে আছে কি না, সে বিষয়ে কিছু বলতে নারাজ কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ১০ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে পিপলস লিজিংয়ের অবসায়ন নিয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম বলেন, ‘আর কোনো এনবিএফআই টাকা ফেরত দিতে পারছে না এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।’ অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, অন্য কোনো এনবিএফআই অবসায়নেরও কোনো উদ্যোগ তাদের নেই।
এদিকে পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নে গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন অনেকেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগে দীর্ঘ সময়ে কাজ করেছেন এমন এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সম্প্রতি বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্দশার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংক এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম বন্ধে কার্যত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।’
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান রেড জোনে আছে তা আমার জানা নেই। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকই পিপলস লিজিংয়ের অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। পরিদর্শনে অনিয়ম পাওয়ার পরপরই পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। পর্যবেক্ষক বসানো হয়েছে। শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির অবসায়নের কার্যক্রমও শুরু হয়েছে।’
তবে এর আনেক আগে থেকেই প্রতিষ্ঠানটির ক্ষয় শুরু হয়। জানা গেছে, গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ উঠতে শুরু করায় ২০১৫ সাল থেকে এনবিএফআইগুলোয় পর্যবেক্ষক দিতে শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রথম যে তিনটি এনবিএফআইতে পর্যবেক্ষক বসানো হয়, সেগুলোর একটি ছিল পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড। অন্য দুটি হলো বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) লিমিটেড এবং ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড। অবশ্য তাতে কোনো ফল দেয়নি।
এনবিএফআইগুলো তদারকির কাজে নিয়োজিত থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর গত চার-পাঁচ বছরের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সংস্থাটির সাবেক ও বতর্মান কর্মকর্তাদের অনেকে। এনবিএফআইগুলো নিয়ন্ত্রণের মৌলিক নীতি কাঠামো তৈরি ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের। পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে আলাদা একটি বিভাগ। ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন মো. শাহ আলম। বর্তমানে তিনি পদোন্নতি পেয়ে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে থেকে ওই বিভাগের কার্যক্রম দেখভাল করছেন। মহাব্যবস্থাপক হিসেবে রয়েছেন মো. সহিদুল ইসলাম।
এদিকে গত রোববার উচ্চ আদালত পিপলস লিজিংয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন উপমহাব্যবস্থাপককে অবসায়ক নিয়োগের আদেশ দেন। অবসায়িত এই প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালকদের ঋণ-অনিয়মের কারণে তারল্য সংকটে পড়ে গ্রাহকের আমানত ফেরত না দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে গ্রাহকরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শুরু করে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দ্বারস্থ হয়েছিলেন।
Posted ২:৪৮ অপরাহ্ণ | শনিবার, ২০ জুলাই ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed