ওয়াহেদ হোসেন (নিউইয়র্ক থেকে) | সোমবার, ২৭ এপ্রিল ২০২০ | প্রিন্ট | 1187 বার পঠিত
বাংলাদেশ, আমার মাতৃভূমি। আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা সেখানে। কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসে সেই প্রিয়ভূমিকে ছেড়ে এক সময় আমাকে পরবাসী হতে হলো। আমার একমাত্র ছেলে তার স্ত্রী, বড় ও ছোট মেয়েকে নিয়ে ২০০৭ সালে ডাইভার্সিটি ভিসা নিয়ে নিউইয়র্ক এসেছিলো। পরে তার আরেক ছেলে হয়, যে জন্মসূত্রে আমেরিকান নাগরিক। আমার একমাত্র মেয়ে ২০১৪ সালে আমেরিকার টেক্সাসে এসে তার স্বামীর ঘর করছে।
২০১৭ সালের জুন মাসের ১৯ তারিখ বাংলাদেশের মাটি ছেড়ে ২০ তারিখ নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমান বন্দর নামলাম। এক সময়ে পাক-ভারত উপমহাদেশের মানুষের স্বপ্ন ছিলো ইংল্যান্ড। যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডন নগর। এখন সারা পৃথিবীর মানুষের জন্যে আকর্ষণস্থল আমেরিকা। বিশেষত উত্তর আমেরিকা।
দেশটির উত্তরে কানাডা, দক্ষিণে মেক্সিকো ও দক্ষিণ আমেরিকা ও ছোট বড় কিছু দ্বীপ, দক্ষিণ-পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর এবং পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর। প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী প্রেসিডেন্ট। মোট ৫০টি রাষ্ট্রের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এদেশের নাম যুক্তরাষ্ট্র (United States)। United States of America নয়। মানুষ এমনি এমনি লিখে থাকে। ইংরেজি বর্ণের ক্রম অনুসারে রাষ্ট্রগুলোর (পোস্টাল কোডসহ) নাম ১. অ্যালাবামা (Alabama-AL) ২. আলাস্কা (Alaska-AK) ৩. এ্যারিজোনা (Arizona-AZ) ৪. আরকানসাস (Arkansas-AR) ৫. ক্যালিফোর্নিয়া (California-CA) ৬. কলোরাডো (Colorado-CO) ৭. কানেটিকাট (Connecticut) ৮. দেলাওর (Delware) ৯. ফ্লোরিডা (Florida-FL) ১০. জর্জিয়া (Georgia-GA) ১১. হাওয়াই (Hawaii-HI) ১২. আইডাহো (Idaho-ID) ১৩. ইলিনয় (Illionois-IL) ১৪. ইন্ডিয়ানা (Indiana-IN) ১৫. আইওয়া (Iowa-IA) ১৬. ক্যানসাস (Kansas-KS) ১৭. কেন্টাকি (Kentucky-KY) ১৮. লুজিয়ানা (Louisiana-LA) ১৯. মেইন (Maine-ME) ২০. মেরিল্যান্ড (Maryland-MD) ২১. ম্যাসাচুসেটস (Massachusetts-MA) ২২. মিশিগান (Michigan-MI) ২৩. মিনেসোটা (Minnesota-MN) ২৪. মিসিসিপি (Mississippi-MS) ২৫. মিসৌরি (Missouri-MO) ২৬. মনটানা (Montana-MT) ২৭. নেবরাস্কা (Nebraska-NE) ২৮. নেভাডা (Nevada-NV) ২৯. নিউ হ্যাম্পশায়ার (New Hampshire-NH) ৩০. নিউজার্সি (New Jersey-NJ) ৩১. নিউ মেক্সিকো (New Mexico-NM) ৩২. নিউইয়র্ক (New York-NY) ৩৩. নর্থ ক্যারোলিনা (North Carolina-NC) ৩৪. নর্থ ডাকোটা (North Dakota-ND) ৩৫. ওহাইও (Ohio-OH) ৩৬. ওকলাহোমা (Oklahoma-OK) ৩৭. অরিগন (Oregon-OR) ৩৮. পেনসিলভানিয়া (Pennsylvania-PA) ৩৯. রোড আইল্যান্ড (Rhode Island-RI) ৪০. সাউথ ক্যারোলিনা (South Carolina-SC) ৪১. সাউথ ডাকোটা (South Dakota-SD) ৪২. টেনিসি (Tennessee- TN) ৪৩. টেক্সাস (Texas-TX) ৪৪. । ইউতাহ (Utah-UT) ৪৫. ভারমন্ট (Vermont-VT) ৪৬. ভার্জিনিয়া (Virginia-VA) ৪৭. ওয়াশিংটন (Washington-WA) ৪৮. ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া (West Virginia-WV) ৪৯. উইসকনসিন (Winconsin-WI) ৫০. ওয়াইওমিং (Wyoming-WY)।
এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত। সুযোগ সুবিধা ভালো। আইন-শৃঙ্খলা যথাযথ নিয়মানুগ। চিকিৎসা ব্যবস্থাও সুন্দর। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সার্বক্ষণিক। সাপ্লাইয়ের পানি সরাসরি পান করা যায়, বাংলাদেশে পানি ফুটিয়ে না খেলে চলে না। এখানে চাকরিজীবীদের কর্মদিবস হচ্ছে সোম-শুক্র। শনি ও রবি ছুটির দিন। এই দু’দিনে মানুষজন ঘুরে বেড়ায়। বেড়ানোর বহু জায়গা। হয় সমুদ্র তীর, না হয় বন-বাদাড়, পাহাড়-পর্বত, পার্ক-মিউজিয়াম, পারিবারিক বা পার্টির অনুষ্ঠান। দু হাতে আয়, দেড় হাতে ব্যয়। জীবনময় হৈ হুল্লোড়। মোটামুটি এই হলো উত্তর আমেরিকার জীবনযাত্রা।
এখানে প্রায় প্রত্যেক পরিবারের রয়েছে এক বা একাধিক মোটরযান। বাংলাদেশে কয়েকটা ইউনিয়ন নিয়ে একটা থানা এলাকা গঠিত। নিউইয়র্ক নগরকে তেমনি পাঁচটি বরোতে ভাগ করা। কুইন্স, ম্যানহাটন, ব্রনক্স, ব্রুকলিন ও স্ট্যাটান আইল্যান্ড। রোড, স্ট্রীট, বুলেভার্ড ; এ হলো দূরত্ব ও পুব-পশ্চিম অনুযায়ী রাস্তার নাম। মাটির নিচ দিয়ে আছে বিশাল যাতায়াত ব্যবস্থা সাবওয়ে, অর্থাৎ রেলপথ।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশান এলাকায় দেশের সবকিছু পাওয়া যায়, তেমনি পৃথিবীর তাবৎ জিনিষ ও খাদ্যখাবার মেলে এখানে। আছে রোপওয়ে। ম্যানহাটনের সীমিত এলাকায় বাংলাদেশের রিকশার মত যানও দেখা যায়, যা মূলত ভ্রমণবিলাসীরা ব্যবহার করে থাকেন। জাতিসংঘ সদর দফতর সহ বহু বাণিজ্যিক কর্মকান্ড ও বিশাল বিশাল দালান-কোঠার সমাহার ম্যানহাটন এলাকায়।
ইলিয়নইস প্রদেশের শিকাগো শহরে আছে বাংলাদেশের স্থপতি ফজলুর রহমানের সুকীর্তি সিয়ার্স টাওয়ার। যার বর্তমান নাম উইলস টাওয়ার। ১১০ তলাবিশিষ্ট এই স্থাপনার উচ্চতা ১৪৫০ ফুট যা ১১০ তলার।
নিউইয়র্কের পুবদিকে আটলান্টিক মহাসাগর ও পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর, যা মাছে সমৃদ্ধ। সামুদ্রিক মাছ ধরার জন্যে মহাসাগর দুটি বিস্তৃত জলাশয়। বহু মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস। নিউইয়র্কের সাথে পৃথিবীর অনেক দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। কূটনেতিক সম্পর্ক তো আছেই। বিশ্বসুন্দর নগরীর মধ্যে নিউইয়র্ক অন্যতম।
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারী ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হন। তিনি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন যা বিদেশীদের জন্যে সুখকর নয়। এক সময় বিদেশীদের এখানে আগমনের হিড়িক ছিলো, যা ঠেকাতে বদ্ধপরিকর বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ন্যায়ানুগ ও চোরাপথে বিদেশীদের আসার হিড়িক তা বলে থেমে নেই। নানান কারণে ট্রাম্পের বিপক্ষে এক সময় অনাস্থা জ্ঞাপনের ঝড় ওঠে, যা পরিশেষে পরিত্যক্ত হয়।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অনুযায়ী সেখানে ঋতু ছ’ ভাগে বিভক্ত, বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য (গ্রীষ্ম), আষাঢ়-শ্রাবণ (বর্ষা), ভাদ্র-আশ্বিন (শরৎ), কার্তিক-অগ্রহায়ণ (হেমন্ত), পৌষ-মাঘ (শীত) ও ফাল্গুন-চৈত্র (বসন্ত)। পক্ষান্তরে আমেরিকায় রয়েছে চারটি ঋতু। শরৎ, শীত, বসন্ত ও গ্রীষ্ম। প্রতি তিন মাসে এক ঋতু। সামগ্রিকভাবে সারা বছরের বেশি সময় এখানে শীত সাত মাস, গ্রীষ্ম পাঁচ মাস। অন্য দুই ঋতু শীত ও গ্রীষ্মকালের মধ্যে জড়িয়ে থাকে যা আসলে তত বোঝা যায় না।
প্রতি শতাব্দির ২০ সাল অর্থাৎ ১৭২০ সালে মার্সেলিতে মহামারী আকারে প্লেগ, ১৮২০ সালে কলেরা, ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লু। ২০২০ সালে করোনা ভাইরাস পৃথিবীর মানুষকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবী থমকে গেছে। সারা পৃথিবীর মানুষ আজ গৃহবন্দী। চীনের উহান শহরে শুরু হওয়া করোনার টোটকা চিকিৎসায় সেখানে এখন মৃত্যুর সংখ্যা খুবই কম। পৃথিবীব্যাপী এ রোগে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় দুই লাখের কাছাকাছি। স্কুল-কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি অফিস আদালত বন্ধ। কলকারখানা-গার্মেন্টস সবই বন্ধ। এক সময়ের কর্মচাঞ্চল্যের নগর, পথঘাট এখন নিরব-নিস্তব্ধ শ্মশান।
২০১৯ সালের অক্টোবরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে শুরু হয়ে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতী নভেল করোনা ভাইরাস। এ রোগের জীবাণু প্রথম চার দিন মুখের মধ্যে থাকে। ব্যবস্থা না নিলে তা শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষত যারা বয়স্ক ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি কম থাকায় সহজেই এই রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। মরণকে কাছে টেনে পরপারে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
প্রতিকার হিসেবে কোন ওষুধ এখনও বাজারে আসেনি। এন্টিবায়োটিক বা জীবাণুনাশক হিসেবে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষ পালন করছে। প্রতিষেধক হিসেবে গরম পানি, গরম চা, গরম কফি, গরম দুধ এবং গরম খাবার ব্যবহার হচ্ছে। যা বেশ কার্যকর। যারা আক্রান্ত হচ্ছে তাদেরকে কোয়ারেন্টাইন অর্থাৎ আলাদাভাবে রেখে চিকিৎসা করা হচ্ছে। চিকিৎসা শেষে তাদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে সহজ চলাচলের জন্যে।
বর্তমানে স্বেচ্ছানির্বাসনই হলো প্রতিকারের প্রক্রিয়া। বিভিন্ন দেশের সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করছে। মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিরন্ন মানুষের জন্যে সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য সামগ্রী বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। অপেক্ষাকৃত ধর্ণাঢ্য মানুষও থেমে নেই। তারাও দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন।
আমাদের দেশে খেটে খাওয়া মানুষের দুর্দশা চিরকালই ছিলো। এখনও আছে। এক ধরনের মানুষ নিবেদিতপ্রাণ হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করে চলেছেন সেবা। অন্য এক শ্রেণীর মানুষ আছে চুরি ও খেয়ানতে। তারা শোনেনা ধর্মের কাহিনী। গরীবের হক- সাহায্য সামগ্রীতে বসাচ্ছে ভাগ। সাহায্য দানের নামে তারা আছে লুটপাটে। সরকার এদের বেলায় অনেকটা অসহায়ের মত।
বিশ্বের সর্বোন্নত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় আমাদের সক্ষমতা প্রায় নেই বললেই চলে। এরপরও প্রিয় বাংলাদেশে ইতিমধ্যে এই রোগে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় দেড় শতাধিক। আক্রান্ত প্রায় ছয় হাজারের কাছাকাছি। এই সুদূর প্রবাস থেকে প্রিয় মাতৃভূমির মানুষের জন্য দিনশেষে এই প্রার্থণা, করোনায় জর্জরিত মানুষের আলয় পরিনত হোক সুখালয়ে।
(আগামী পর্বে সমাপ্ত)
লেখক: আমেরিকায় অবস্থানরত বাংলাদেশী সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
Posted ১১:২৯ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ২৭ এপ্রিল ২০২০
bankbimaarthonity.com | rina sristy