| সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | প্রিন্ট | 322 বার পঠিত
যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স দেশের চতুর্থ প্রজন্মের বীমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে অন্যতম। বীমার মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মহান ব্রতকে সামনে রেখে দেশের ১০ জন শীর্ষস্থানীয় শিল্প উদ্যোক্তা ২০১৪ সালের ২০ মার্চ যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কার্যক্রম শুরু করেন। মজবুত আর্থিক ভিত্তি, উন্নত গ্রাহক সেবা ও জনগণের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশের শীর্ষ জীবন বীমা কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করাই যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে কোম্পানির বিভিন্ন কার্যক্রম, বাংলাদেশের বীমা খাতের চ্যালেঞ্জ, সম্ভাবনা ও উত্তরণের উপায় নিয়ে সম্প্রতি ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতিকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান খন্দকার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাসির আহমাদ রাসেল।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: আপনার দৃষ্টিতে বীমা কী এবং গ্রাহকদের কেন বীমা করা উচিত বলে মনে করেন?
কামরুল হাসান খন্দকার: বীমা হচ্ছে একটি আধুনিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতিপূরণের নিশ্চয়তা। প্রত্যেক ব্যক্তির জীবন ও অর্জিত সম্পদ সবসময় বীমার আওতায় থাকা উচিত। যদিও বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় জীবনযাপনের প্রয়োজনীয়তার সাথে বীমার প্রয়োজনীয়তা আমরা উপলব্ধি করি না বা বীমা এখনও সেভাবে জনপ্রিয় হয়নি। কিন্তু প্রত্যেকেরই বীমা পলিসি করা উচিত, কারণ এখানে দারুণ একটি বিষয় রয়েছে। সেটি হচ্ছে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে কোনো সংকট বা ক্ষতি পলিসিগ্রহীতার; কিন্তু ক্ষতি পূরণের দায় বীমা কোম্পানির। আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কোম্পানির। সুতরাং নিশ্চিত জীবনযাপনের জন্যই প্রত্যেকের বীমার আওতায় আসা উচিত।
আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের ধারণা বীমা এক ধরনের সঞ্চয়ী প্রকল্প। আসলে বীমার মূল উদ্দেশ্য সঞ্চয় নয়, ক্ষতিপূরণ। এরপর সঞ্চয়। সঞ্চয়ের জন্য ব্যাংক, সমিতি বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বীমার মূল ফোকাস হচ্ছে ক্ষতিপূরণ। কর্মকর্তারা গ্রাহক আকৃষ্ট করতে বীমায় লাভের কথা বলে থাকেন। বীমা আসলে লাভ দেয় না। ক্ষতিপূরণ দেয়। এটি লাভের জায়গা নয়। এটি একটি ক্ষতিপূরণের কৌশল।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: আপনার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের বীমা খাতের সম্ভাবনা কতটা?
কামরুল হাসান খন্দকার: বাংলাদেশের বীমা খাতের সম্ভাবনা ব্যাপক। বাংলাদেশের বীমা খাত বিশ্বের অন্যান্য দেশের বীমা খাতের মতো জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারছে না। যেখানে উন্নত দেশে বীমা খাতের গড় অবদান ৭ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশের বীমা খাতের অবদান মাত্র ০.৫৫ শতাংশ। এই অবদান বাড়ানোর টার্গেটই সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা। বীমা উন্নয়নের একটি মৌলিক বিষয়।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বীমা শিল্পে ইমেজ সংকট কাটিয়ে ওঠা এবং আস্থা ফিরিয়ে আনতে আপনার কোম্পানি কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
কামরুল হাসান খন্দকার: বীমা খাতের এই ইমেজ সংকট একদিনে তৈরি হয়নি। গ্রাহকরা জমা দেয়া টাকা ফেরত না পাওয়ার কারণেই ধীরে ধীরে এটি তৈরি হয়েছে। কোম্পানি যেখানে নিশ্চয়তা দিচ্ছে ক্ষতিপূরণ করে দিবে। সেখানে ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা, নিজের জমাকৃত টাকাই ফেরত পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। কিছু কিছু জায়গায় তারা টাকা ফেরত পাওয়ার ন্যায্য অধিকার থেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন। পলিসি গ্রাহকরা যথাসময়ে ন্যায্য বীমা দাবি বুঝে পেলে ইমেজ সংকট হতো না। সুতরাং এই খাতে ইমেজ ফিরিয়ে আনতে গ্রাহক এখানে যে টাকা জমা রাখেন, তা যথাযথভাবে ফেরত দিতে হবে। গ্রাহকরা সঠিক সময়ে টাকা ফেরতের নিশ্চয়তা চায়। আমরা সেই পদক্ষেপ নিয়েছি। আমাদের কোনো ক্লেইম বাকী নেই। দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমরা ক্লেইম নিষ্পত্তি করি। এমনকি মাত্র তিন কার্যদিবসের মধ্যে মৃত্যু দাবি নিষ্পত্তির বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করি।
বীমা খাতের আরেকটি বড় সমস্যা কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়। গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে হলে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের ক্ষেত্রে আইডিআরএ’র সীমা অতিক্রম করা যাবে না। অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে হবে। যদিও এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আইডিআরএ অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। কিন্তু এই চেষ্টা তখনই সফল হবে; যখন আমরা সবাই এতে শামিল হবো। কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমিয়ে আনতে আইডিআরএ’র নির্ধারিত কমিশন শিডিউল মানতে হবে। তাহলে অতিরিক্ত খরচ বন্ধ হবে। এটি নিশ্চিত করতে আইডিআরএ’র পক্ষ থেকে নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। প্রয়োজনে প্রতিমাসে অডিট করতে হবে।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশের বীমা খাতের চ্যালেঞ্জগুলো কী কী এবং উত্তরণের উপায় কী?
কামরুল হাসান খন্দকার: বাংলাদেশের বীমা খাতের সবচয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মানুষ বীমাকে সাদরে গ্রহণ করতে চায় না। বীমা পেশা জনপ্রিয় নয়, এটি আরেকটি চ্যালেঞ্জ। সুতরাং এ পর্যায় থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে কিছু কিছু জায়গায় বীমা বাধ্যতামূলক করে দিতে হবে। যেমন লঞ্চ, ট্রেন, বাসসহ সব ধরনের যানবাহনের যাত্রীদের বীমা বাধ্যতামূলক করা উচিত। সেক্ষেত্রে এসব যানবাহনের টিকিট সংগ্রহের সময়ই একটি অংশ বীমার জন্য কেটে রাখা যেতে পারে। কারণ যানবাহনের যাত্রীদের দুর্ঘটনাজনিত জীবন ঝুঁকি রয়েছে। পেশার ক্ষেত্রে পেশাজীবীদেরও বীমা থাকতে হবে। কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে চাইলে তার বীমা থাকতে হবে। কারণ এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। পরিবারের আর্থিক নিশ্চয়তার জন্য পেশাজীবীদের বীমা থাকা উচিত। ট্রেড লাইসেন্সপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও বীমা বাধ্যতামূলক করা উচিত। স্কুলভিত্তিক শিক্ষা বীমা বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার সময় থেকেই প্রত্যেক শিশু বীমার আওতায় চলে আসবে। স্কুলের বেতনের সঙ্গে মাত্র ৫০ টাকা প্রিমিয়াম বাবদ জমা দিয়ে একজন শিক্ষার্থী বীমার আওতায় চলে আসতে পারে। ভবিষ্যতে পরিবার আর্থিক সংকটে পড়লে এই বীমাই তার পড়াশুনা চালিয়ে নেয়ার নিশ্চয়তা দেবে। এতে ভবিষ্যতে তারা বীমাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখবে। এভাবেই সব শ্রেণি-পেশার মানুষ বীমার আওতায় চলে আসবে। সুফল পেলে বীমা সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক ধারণা দূর হবে।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: কী কী বৈশিষ্ট বা সুবিধার কারণে গ্রাহক আপনার কোম্পানিকে পলিসির জন্য বেছে নেবে?
কামরুল হাসান খন্দকার: গ্রাহকের টাকা ফেরত পাওয়ার যে নিশ্চয়তা বা আস্থা সেই জায়গাটিতে আমরা শীর্ষস্থানীয়দের কাতারে রয়েছি। একজন গ্রাহক শতভাগ আস্থা নিয়ে যমুনা লাইফের পলিসি গ্রহণ করতে পারেন। এছাড়া যমুনা লাইফের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবস্থাপনা ও গ্রাহক সেবা রয়েছে শুরু থেকেই। গ্রাহক যে কোনো সময় কোম্পানির ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে মোবাইল ব্যাংকিং, ব্যাংক ট্রান্সফার ও ডেবিট কার্ড বা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে প্রিমিয়াম জমা দিতে পারেন। পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় বসে প্রবাসীরাও খুব সহজে এসব ডিজিটাল পেমেন্ট মেথডের মাধ্যমে প্রিমিয়াম জমা দিতে পারেন। প্রিমিয়াম জমা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহককে নিশ্চিতকরণ এসএমএস পাঠানো হয়। এমনকি পরবর্তী প্রিমিয়াম প্রদানের তারিখও এসএমএস’র মাধ্যমে গ্রাহক জানতে পারছেন। এছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ২৪০ টি হাসপাতালের সঙ্গে আমাদের কর্পোরেট চুক্তি রয়েছে। আমাদের পলিসি হোল্ডাররা এসব হাসপাতাল থেকে হ্রাসকৃতমূল্যে উন্নত চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: আপনাদের কী কী পরিকল্প রয়েছে?
কামরুল হাসান খন্দকার: আমাদের উল্লেখযোগ্য পরিকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে মেয়াদী বীমা, সঞ্চয়ী বীমা, দেনমোহর বীমা, হজ্জ বীমা, সহজ বীমা, পেশাজীবী পলিসি, শিশু নিরাপত্তা বীমা, নিরাপদ পলিসি ইত্যাদি।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য সর্বপ্রথম গ্রুপ স্বাস্থ্যবীমা চালু করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই স্বাস্থ্যবীমার মাধ্যমে তারা কীভাবে উপকৃত হচ্ছে?
কামরুল হাসান খন্দকার: এটি একটি যুগান্তকারী ঘটনা। যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সই সর্বপ্রথম দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য গ্রুপ স্বাস্থ্যবীমা চালু করেছে। যেটি শুরু হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫ হাজার শিক্ষার্থী এই স্বাস্থ্য বীমার আওতায় রয়েছে। প্রতিদিন একটাকার চেয়েও কম, বছরে মাত্র ২৭০ টাকা প্রিমিয়াম জমা দিয়ে শিক্ষার্থীরা এই স্বাস্থ্য বীমার আওতায় এসেছে। এই বীমার আওতায় থাকা গ্রাহক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা চিকিৎসা ব্যয় পাবেন, অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাপত্র নিলে ১০ হাজার টাকা আর অসুস্থতাজনিত মৃত্যু ঘটলে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। গত বছরের জুলাই থেকে শিক্ষার্থীরা যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের এই পলিসির আওতায় এসেছে। আগামী দিনে এই শিক্ষার্থীরাই দেশ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকে বীমার বেনিফিট পাওয়ায় বীমা সম্পর্কে তাদের মাঝে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। যা আগামীদিনের বীমাখাতকে সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রাখবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ব্যবসায়িক অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাই।
কামরুল হাসান খন্দকার: দেশের ১৫ টি জেলায় যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ২৫ টি শাখা অফিস রয়েছে। যেখানে স্থায়ী ও খণ্ডকালীন মিলিয়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি ব্যক্তির কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০২১ সালে আমাদের নেট প্রিমিয়াম ছিলো ১৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। গত বছরের ইস্যুকৃত পলিসি ৪ হাজার ২৮ টি ও নবায়নকৃত পলিসি ৫ হাজার ৮১৯। বর্তমানে কোম্পানির বিধিবদ্ধ বিনিয়োগ ১৫ কোটি ৫০ লাখ।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: আইডিআরএ অনুমোদনের ৩ বছরের মধ্যে একটি বীমা কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আসতে হয়, আপনারা কবে নাগাদ আসছেন?
কামরুল হাসান খন্দকার: চলতি বছরের সেপ্টেম্বরেই পুঁজিবাজারে শেয়ার অবমুক্ত করার প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
কামরুল হাসান খন্দকার: আপনাকেও ধন্যবাদ। ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি’র পাঠকদের জন্য শুভ কামনা।
Posted ৪:২৬ অপরাহ্ণ | সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২
bankbimaarthonity.com | rina sristy