বিবিএনিউজ.নেট | রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | প্রিন্ট | 599 বার পঠিত
মেঘনা নদী দখল ও ভরাট করে একের পর এক কারখানা স্থাপন করছে মেঘনা গ্রুপ। নদীতীরে মেঘনা গ্রুপের দখলে থাকা এক হাজার ১৪০ বিঘা জমির মধ্যে এক হাজার ৭৪ বিঘাই অবৈধভাবে দখল করা বলে অভিযোগ স্থানীয় লোকজনের। শুধু জমি দখল করেই ক্ষান্ত হয়নি প্রতিষ্ঠানটি; শিল্প-কারখানার দূষিত বর্জ্যে নদীটিকে মেরে ফেলার খেলায়ও মেতেছে। মেঘনা গ্রুপের দৌরাত্ম্যে এরই মধ্যে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে প্রায় দুই কিলোমিটার নদী। জাল দলিলে হাতিয়ে নিয়েছে বহু সাধারণ মানুষের ভূমি। শনিবার নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার মেঘনা নদীর পারে গিয়ে এবং এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মেঘনার শাখা নদী মারিখালী। মারিখালী নদীটির মোহনায় আষাঢ়িয়ার চর মৌজায় ৩৫০ বিঘা জমি মাটি দিয়ে ভরাট করেছে মেঘনা গ্রুপ। এর মধ্যে মাত্র ১০০ বিঘা জমি কিনেছে প্রতিষ্ঠানটি। বাকি ২০০ বিঘা জমি তৈরি করা হয়েছে নদী ভরাট করে এবং ৫০ বিঘার মতো জমি এলাকাবাসীর কাছ থেকে জাল দলিল দিয়ে জবরদখল করা হয়েছে।
আষাঢ়িয়ার চরের পূর্ব দিকে গঙ্গানগর গ্রামে ১৫০ বিঘা জমির ওপর ‘ফ্রেশ চা’ কারখানা তৈরি করেছে মেঘনা গ্রুপ। ‘চররমজান ও চরসোনাউল্যা’ মৌজার এই জমির মধ্যে মাত্র ১৬ বিঘা জমি কিনেছে প্রতিষ্ঠানটি। বাকি ১৩৪ বিঘা জমি নদী ভরাট করে তৈরি করেছে। একই মৌজার ঝাউচর এলাকায় মেঘনা গ্রুপের দখলে থাকা ৩০০ বিঘা জমির মধ্যে কেনা দেড় শ বিঘা, নদী থেকে দখল করেছে প্রায় ১০০ বিঘা এবং বাকি ৫০ বিঘা স্থানীয় আব্দুল মান্নানের জমি জবরদখল করেছে।
এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উত্তর দিকে নদীর জমি দখল করে বিশাল এলাকায় শিল্প-কারখানা গড়ে তুলেছে মেঘনা গ্রুপ। নদীটির পশ্চিম তীরে মেঘনা গ্রুপের মালিকের ভাগ্নে তৈরি করেছেন কারখানা। নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে পূর্ব-উত্তর প্রান্তে মেঘনা গ্রুপের কারখানা তৈরি করা হয়েছে। মেঘনা গ্রুপের পশ্চিম পাশের চরহিস্যা মৌজায় ৮০০ বিঘা জমি বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রুপটি মাত্র ৩০০ বিঘা জমি কিনেছে বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী। বাকি ৫০০ বিঘা জমি নদী ও স্থানীয়দের। স্থানীয় লোকজনের জমি জবরদখল করে ভরাটের কাজ এখনো চলমান। এ ছাড়া কারখানার উত্তর পাশে প্রভিটা ফিডের ৪০ বিঘার বেশি জমি দখলে নিয়েছে মেঘনা গ্রুপ। চররমজান ও চরলাউয়াদি মৌজার জমিগুলো দখলে নিতে টিনশেডের ঘর নির্মাণ করেছে মেঘনা গ্রুপ। শ্রমিকদের জন্য তৈরি এসব ঘর দিয়ে জমিটি দখলে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। মেঘনা গ্রুপের এসব দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী থানায় মামলা করেছে। কেউ কেউ উচ্চ আদালত থেকে ভরাটের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ নিয়েছেন। কিন্তু এর পরও থামছে না দখল ও ভরাট।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পিরোজপুর ইউনিয়নের ছয়হিস্যা, কান্দারগাঁও, জৈনপুর, চরভবনাথপুর, দুধঘাটা, কুরবানপুর এলাকার নদী, সরকারি খাসজমি দখল এবং সাধারণ মানুষের বহু জমি দখল করেছে প্রতিষ্ঠানটি। সোনারগাঁও উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের ছয়হিস্যা গ্রামের আহসান উল্লাহ মাস্টার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মেঘনা প্রুপ ভুয়া দলিলের মাধ্যমে আমার ১৬ শতাংশ জমি দখল করে নিয়েছে। একই কায়দায় হাকিমুনের ২০-১০-১৬ ইং তারিখে ১৬ শতাংশ জমি (দলিল নং-১২৯৬০) জাল দলিল করে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আব্দুল জব্বারের ০.১৩৮০ শতাংশ জমি (দলিল নং ৯৭৬৫) ভুয়া মালিক সাজিয়ে কম্পানির নামে দখলে নেয় মেঘনা গ্রুপ। এ ছাড়া তমিজের ০.২৮০০ শতাংশ জমি (দলিল নং-১২৯৬১) নিজেদের নামে লিখে নিয়েছে তারা।’
জানা গেছে, মহরাজের ০.০৪০০ শতাংশ, রহমত আলীর ০.১৮২০ শতাংশ, মজিবর ও আয়েশার ০.৪৩০০ শতাংশ এবং ০.১০২৫, ০.২৮০০ শতাংশ, মোহাম্মদ আলীর ০.০৭৫৪ শতাংশ, নাছিম উদ্দিনের ০.১৯৭০ শতাংশ , আবু সাঈদের ০.২০৫০ শতাংশ, আলাউদ্দিনের ০.২৮০০ শতাংশ জমি জাল দলিলের মাধ্যমে মেঘানা গ্রুপ দখলে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নদীখেকো মেঘনা গ্রুপের সঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ জেলা, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনারসহ (ভূমি) অসাধু কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে। সরকারের এই তিন সংস্থার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে প্রকাশ্যে চলছে মেঘনা গ্রুপের দখলের উৎসব।
প্রতিনিয়ত নদীতে পাইলিং, সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ ও বালু ফেলে নদীগর্ভে প্রবেশ করছে মেঘনা গ্রুপ। নদী দখলের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে মেঘনা গ্রুপের এক সংস্থা অন্য সংস্থার ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করে। নদী দখলের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পরিবেশ অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয় ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। অন্যদিকে সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নদী দখলের বিষয়ে বাকি দুই সংস্থার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। অবৈধভাবে নদী দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা প্রশাসনের কাছে ঘুরেও কোনো প্রতিকার পায়নি ভুক্তভোগীরা। নদী দখল, সরকারি খাল ও কৃষিজমি রক্ষার প্রতিবাদে এলাকাবাসী ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর আন্দোলন-সংগ্রাম, কয়েক দফা বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ, সড়ক অবরোধ ও বিভিন্ন দপ্তরে স্মারকলিপি প্রদান করেও কোনো ফল পায়নি।
ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, নদী দখলের অভিযোগে মেঘনা ঘাট এলাকার মেঘনা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নদী ও সরকারি সম্পত্তি এবং খাসজমির দখল ছেড়ে দিতে চূড়ান্ত নোটিশ প্রদান করা হয়েছে। ওই নোটিশের প্রায় এক বছর অতিবাহিত হলেও রহস্যজনক কারণে ব্যবস্থা নেয়নি তারা। সোনারগাঁয়ে নদীতীরবর্তী এলাকায় গড়ে ওঠা মেঘনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নদী ও খাল দখলের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও প্রমাণাদি পাওয়ার পরও নোটিশ প্রদান ছাড়া কার্যত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি উপজেলা প্রশাসন। এ ছাড়া পরিবেশ আইন অমান্য করে এবং কোনো ধরনের ছাড়পত্র ছাড়াই নদী ভরাটের কাজ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। নদী দখল করে নির্মিত অবৈধ সব স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেন বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ও সচিব ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদারও।
সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অঞ্জন কুমার সরকার বলেন, কাউকে নদী দখল করতে দেওয়া হবে না। দখলকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে সোনারগাঁ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাজমুল হোসাইন বলেন, ‘কর্মস্থলে আমি নতুন যোগদান করেছি। খোঁজখবর নিয়ে নদী দখলকারীদের উচ্ছেদ করা হবে।’
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন (বিআইডাব্লিউটিএ) নারায়ণগঞ্জের সহকারী পরিচালক বলেন, নদী দখলকারীদের চিহ্নিত করতে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়েছে। প্রতিবেদন পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. সাঈদ আনোয়ার বলেন, ‘কেউ যদি বেআইনিভাবে নদী দখল করে থাকে তাহলে আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে তা উচ্ছেদ করব।’
Posted ১২:৩০ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed