আবুল কাশেম | বুধবার, ২৪ নভেম্বর ২০২১ | প্রিন্ট | 241 বার পঠিত
জনবল সংকটে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) রাজস্ব আদায় ও কাক্সিক্ষত নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। হোল্ডিং ট্যাক্সসহ ১৭ খাত থেকে চলতি অর্থ বছরে ১ হাজার ৫৮ কোটি ২০ লাখ টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছে ডিএনসিসি। এ লক্ষ্যে মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও জনবল সংকটে তা শতভাগ সফল হচ্ছে না।
জানা যায়, ডিএনসিসিতে রাজস্ব বিভাগে অভিজ্ঞ ও পরিশ্রমী জনবল সংকট ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। চাকরির নিয়ম অনুযায়ী ৫৯ বছর বয়সী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অবসরে যাচ্ছেন। আগামী ডিসেম্বরে এক রাজস্ব কর্মকর্তা (আরও) ও সুপারভাইজারাসহ বিভিন্ন পদের ৬ জন অবসরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এদিকে জনবল সংকটের কারণে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য যেমন পূরণ হচ্ছে না পাশাপাশি কাক্সিক্ষত নাগরিক সেবা নিশ্চিত করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। ডিএনসিসির পুরোনো ৫টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের ১ হাজার ৫৮ কোটি ২০ লাখ টাকা আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত আদায় হয়েছে হোল্ডিং ট্যাক্স খাতে ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে ১৬৭ কোটি ৩৩ লাখ ৫৩ হাজার ৫৬০ টাকা, ট্রেড লাইসেন্স খাতে ১৭৫ কোটি টাকার মধ্যে ৪৭ কোটি ৩৫ লাখ ৪৩ হাজার ৫০২ টাকা, বাজার সালামি খাতে ২৫ লাখ টাকার মধ্যে আদায় নেই, বাজার ভাড়া খাতে ১০ কোটি টাকার মধ্যে ৭৯ লাখ ৫২ হাজার ১৫৪ টাকা, রিকশা লাইসেন্স ফি খাতে ২৫ কোটি টাকার মধ্যে কোন আদায় নেই, প্রমোদ কর ১ কোটি টাকার মধ্যে ৫০ হাজার ৩৯৯ টাকা, সম্পত্তি হস্তান্তর কর ৩০০ কোটি টাকার মধ্যে ৭৫ কোটি ৫৫ লাখ ৮০ হাজার ৯৯৭ টাকা, তারকা খচিত হোটেল কর ৫ কোটি টাকার মধ্যে কোনো আদায় নেই, ক্ষতি পূরণ (অকট্রয়) খাতে ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার মধ্যে আদায় ৪৮ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, মোবাইল টাওয়ার কর ১৫ কোটি টাকার মধ্যে আদায় ১ কোটি ৯৪ লাখ ২৪ হাজার ৩৬ টাকা, ইমারত নির্মাণের উপর কর ২ কোটি টাকার কোন আদায় নেই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-ট্রেনিং সেন্টারের উপর কর ৫০ লাখ টাকার মধ্যে কোন আদায় নেই, মেলা এবং বাণিজ্যিক প্রদর্শনীর উপর কর ২০ লাখ টাকার মধ্যে কোনো আদায় নেই, টিউটোরিয়াল স্কুল, কোচিং সেন্টার ইত্যাদির উপর কর এক কোটি টাকার মধ্যে কোন আদায় নেই, বাজারের উপর ইজার (ফি) ৫০ লাখ টাকার মধ্যে কোন আদায় নেই, এয়ারপোর্ট এবং রেলষ্ট্রেশন হতে আয় ১ কোটি টাকার কোন আদায় নেই এবং বিজ্ঞাপন খাতের আয় ২০ কোটি টাকার মধ্যে আদায় ১ কোটি ৪৭ লাখ ৭৬ হাজার ৮৭৮ টাকা। চলতি অর্থ বছরে গত অক্টোবর পর্যন্ত মোট আদায় হয়েছে ২৯৪ কোটি ৯৫ লাখ ২৪ হাজার ৫২৬ টাকা।
দক্ষ জনবলের অভাবে একদিকে হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়, নতুন বাসা বাড়ি, মার্কেট, অ্যাপার্টমেন্টের হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্য করার পাশাপাশি ওই ট্যাক্স আদায়ের উদ্যোগ গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না। একই সাথে পুরোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন এবং নতুন প্রতিষ্ঠানের ট্রেডলাইসেন্স ইস্যু, মার্কেটে দোকান ভাড়া আদায়ের কাজও সঠিক ভাবে করা যাচ্ছে না।
এরপর যুক্ত হয়েছে ডিএনসিসিতে আরো ৫টি নতুন আঞ্চলের বিশাল এলাকার হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্যের জন্য প্রাথমিক কার্যক্রম। ওইসব এলাকায় কয়েক লাখ বাসা-বাড়ি, ভবন, অ্যাপার্টমেন্ট, মার্কেট এবং দোকানের জরিপ কার্যক্রম এখনো শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না।
পুরোনো আঞ্চলিক কার্যালয়ের সীমিত জনবলকে নতুন অঞ্চলের রাজস্ব বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনার অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে এক জনের উপর দুই তিনটি দায়িত্বে থাকার কারণে কাজের গতি থমকে গেছে।
সূত্র মতে, ডিএনসিসিতে ১০ আঞ্চলিক কার্যালয় এবং মার্কেট শাখাসহ রাজস্ব বিভাগের নতুন অর্গানোগ্রামে জনবলের প্রায় ৬০০ পদ আছে। কিন্তু বর্তমানে কর্মরত আছে মাত্র ১৭৬ জন। এর মধ্যে আগামী ডিসেম্বরে রাজস্ব কর্মকর্তাসহ ৬ জন অবসরে যাচ্ছেন।
ডিএনসিসির বর্তমান জনবল কাঠামোতে ১০ আঞ্চলিক কার্যালয়ে রাজস্ব শাখায় কর কর্মকর্তার পদে ২টি করে মোট ২০ পদ রয়েছে। এর মধ্যে একজন হোল্ডিং ট্যাক্স এবং অপরজন ট্রেডলাইসেন্সসহ বিবিধি কাজ করবে। উপ-কর কর্মকর্তার ৭০ টি পদের স্থলে আছেন ১৯ জন। রাজস্ব আদায়কারী সুপারভাইজার ১২০টি পদের ৩৫ জন। ইতোমধ্যে ১৯ উপ-কর কর্মকর্তার মধ্যে ৭ জনকে অতিরিক্ত কর কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি আঞ্চলিক কার্যালয়ে রাজস্ব বিভাগে ৫৭/৫৮ জন জনবল থাকার কথা। কিন্তু জনবল ৫ ভাগের একভাগ কর্মরত। এছাড়া প্রত্যেক কর্মকর্তাকেই নিজস্ব দায়িত্বের বাইরে আরো ২-৩টি অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়ার ফলে তারা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মাঠে থাকার পরেও লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। এদিকে ডিএনসিসিতে যুক্ত হওয়া নতুন ৮টি ইউনিয়ন নিয়ে আরও ১৮টি ওয়ার্ড হয়েছে। সেখানে আরও ৫টি অঞ্চল করা হয়েছে। এগুলোর জন্য জনবল নিয়োগের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, রাজস্ব খাতে ৩০৪ জনের স্থলে মাত্র ১২৮ জনকে দিয়ে কাজ করানোর কারণে রাজস্ব আদায়ের এই বেহাল দশা।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণসহ সব সিটি করপোরেশনকে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি এবং নিজস্ব অর্থায়নে উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশের আলোকে ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
ডিএনসিসির পুরোনো ৫টি আঞ্চলিক কার্যালয়ে জমে থাকা হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ সংক্রান্ত (নয়াবাদী) নথি পর্যালোচনা করে দ্রুত নিষ্পত্তি, হোল্ডিং ট্যাক্সের বাইরে থাকা নতুন ভবন, বাড়ি ও মার্কেট ট্যাক্সের আওতায় আনা, বকেয়া হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ের নিয়মিত তদারকি, আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করা, পুরোনো ৫টি অঞ্চলে সঠিকভাবে নতুন হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্য করে আদায় এবং বকেয়া ট্যাক্স আদায় হলে রাজস্ব আদায় বাড়বে আরো ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকা।
এই জরিপ কাজ শেষ হবার পরই ডিএনসিসির নির্ধারিত রেটে হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্য করে আদায়ের উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা রয়েছে। তবে সঠিকভাবে নতুন ৫টি আঞ্চলে হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্য এবং আদায় বাস্তবায়ন হলে রাজস্ব আয় বাড়বে কমপক্ষে আরো ৬০০ কোটি টাকা। ডিএনসিসিতে নতুন ও পুরোনো ১০টি আঞ্চল এবং মার্কেটসহ রাজস্ব আয়ের বিভিন্ন খাত থেকে বছরে প্রায় ১৩শ’ কোটি টাকা রাজস্ব আয় সম্ভব হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
মেয়রের রাজস্ব বিষয়ক পরামর্শক, সাবেক উপ-প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মহসীন আলী এই প্রতিবেদককে জানান, প্রচলিত নিয়মে হোল্ডিং ট্যাক্সের রেট না বাড়িয়ে, বকেয়ার ট্যাক্স শতভাগ আদায় এবং ট্যাক্স ধার্যের (নয়াবাদী) আবেদনের জমে থাকা নথি দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছেন মেয়র। আর সেই নির্দেশনা অনুযায়ী রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ করছেন।
তিনি বলেন, নতুন ১৮টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত আরো ৫টি অঞ্চলে কয়েক লাখ বাসা-বাড়ি, বড় বড় ভবন, মার্কেট ও স্থাপনার হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্যের জন্য প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। হোল্ডিং মালিকদেরকে সাতদিনের মধ্যে ডিএনসিসির চিঠিসহ ফরমের চাহিদা মোতাবেক সঠিক তথ্য দিতে বলা হচ্ছে। ফরম পাঠানোর পাশাপাশি হোল্ডিং জরিপের কাজ দ্রুত শেষ করার টার্গেট রয়েছে। আর এ কাজে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিল এবং এলাকার গণ্যমান্য লোকজনও বেশ সহযোগিতা করছেন। নতুন ৫টি অঞ্চলে হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্য করে দ্রুত আদায়ের কাজ পুরোদমে চলছে। ইতোমধ্যে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বেশ কয়টি বড় ভবনের ট্যাক্স ধার্য করে তা আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন ৫ অঞ্চল থেকে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পুরোনো ৫টি অঞ্চলে চলতি অর্থ বছরে ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের টার্গেট দেওয়া হয়েছে। পুরোনো ৫টি অঞ্চলে সঠিকভাবে নতুন হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্য এবং আদায় করতে পারলে আরো ৩০০ কোটি টাকার রাজস্ব আয় বাড়বে। অর্থাৎ শুধু পুরোনো ৫ অঞ্চলেই বকেয়া ট্যাক্স এবং নতুন ট্যাক্স ধার্য করে আদায় করতে পারলে ৮০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় বাড়বে।
তিনি বলেন, প্রতিমাসে মেয়র এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্ব আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা. উপ প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা, রাজস্ব কর্মকর্তা, কর কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নিয়ে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, প্রতিবন্ধকতা এবং করণীয় বিষয়ে নিয়মিত সভা করা হচ্ছে।
এছাড়াও ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার উদ্যোগে আঞ্চলিক কার্যালয়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রতি মাসে পৃথক সভা ও মনিটরিং কার্যক্রম চলছে।
মেয়রের রাজস্ব বিষয়ক পরামর্শক বলেন, ডিএনসিসিতে প্রয়োজনীয় জনবল নেই। যার ফলে মেয়রের উদ্যোগ এবং জোরালো মনিটরিং সত্বেও রাজস্ব আদায়ের নির্ধারিত লক্ষ্য বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ছে। কিন্তু আইনের মারপ্যাঁচের কারণে দ্রুত জনবল নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে মেয়র, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সচিব স্যার ইচ্ছে করলে কোন ধরনের শর্তারোপ না করে ডিএনসিসির রাজস্ব বিভাগের সদস্য বিদায়ী দক্ষ, সৎ এবং পারিশ্রমিক কয়েকজন কর্মকর্তাকে পরামর্শক ও রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে নিয়োগ দিতে পারেন। বিদায়ী রাজস্ব কর্মকর্তারা মেয়রের এই উদ্যোগে সাড়া দিলে একদিকে যেমন রাজস্ব আদায় বাড়বে অন্যদিকে নগরবাসীর মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
Posted ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ২৪ নভেম্বর ২০২১
bankbimaarthonity.com | rina sristy