বিবিএনিউজ.নেট | মঙ্গলবার, ২১ মে ২০১৯ | প্রিন্ট | 645 বার পঠিত
বছরের প্রথম দিন সব শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যের পাঠ্যবই তুলে দেওয়া সরকারের অন্যতম অর্জন। কিন্তু নিম্নমানের কাগজে মুদ্রণ করা হচ্ছে বেশিরভাগ পাঠ্যবই। কাগজের জিএসএম, ব্রাস্টিং ফ্যাক্টর, ব্রাইটনেস অনেক কিছুই ঠিক থাকছে না। এতে সরকারের লক্ষ্য ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও পড়ছে বিপাকে।
বছরের অর্ধেক সময় পার হতে না হতেই ছিঁড়ে যাচ্ছে পাঠ্যবই। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) সনদবিহীন এসব কাগজ দিয়ে পাঠ্যবই ছাপানোয় বছরে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
এমতাবস্থায় ২০২০ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, ইবতেদায়ি, মাধ্যমিক, দাখিল ও ভোকেশনাল স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য ৩৫ কোটি ৪৫ লাখ ৯৫ হাজার ৭৭২টি বই ছাপছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এসব বই আগামী বছরের প্রথমদিন চার কোটি ৩৭ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেওয়া হবে।
জানা যায়, পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের জন্য এনসিটিবি দরপত্রের মাধ্যমে কাগজ ক্রয় করে মুদ্রণকারীদের সরবরাহ করে থাকে। আবার কাগজসহ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের জন্য মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করা হয়। বাস্তবে দেখা যায়, এ দু’টি ক্ষেত্রেই সব সময় দরপত্র অনুযায়ী মানসম্মত কাগজে বই ছাপানো হয় না।
সূত্র জানায়, প্রতিবছরই এনসিটিবির দরপত্রের বিপরীতে কিছু অসাধু প্রতিষ্ঠান ও বিএসটিআই’র মান সনদবিহীন নিম্নমানের মিল কাগজ সরবরাহ করছে। আর এ কাগজে বিদ্যমান বাজারদর এবং এনসিটিবির প্রাক্কলিত দরের তুলনায় অনেক কম দর দিয়ে মানহীন পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করে চলছে কিছু প্রতিষ্ঠান। বিএসটিআই আইন-২০১৮ অনুসারে, লেখা ও ছাপার কাগজ পণ্যটি সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ মান ‘(BDS 405:2012) অনুযায়ী ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মানসনদ অনুযায়ী বিক্রি, বিতরণ ও বাজারজাত করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু আইন মেনে ব্যবসা পরিচালনা করছে না ওই সব কাগজ উৎপাদনকারী মিল। এ ব্যাপারে বারবার বিএসটিআই সরকারি আইন মেনে চলার তাগিদ দিচ্ছে এনসিটিবিকে, কিন্তু এনসিটিবি তা মানছে না।
সর্বশেষ গত ২ এপ্রিল বিএসটিআই থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পত্র দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, দেশে বতর্মানে ১০৬টি পেপারমিল থাকলেও মাত্র ১৮টি মিল বিএসটিআইয়ের মানসনদ নিয়েছে, যারা নিয়মিত সরকারি রাজস্ব দিচ্ছে এবং মানসম্মত কাগজ ও কাগজজাতীয় পণ্য উৎপাদন করছে। প্রতিবছর এনসিটিবির ৩৫ কোটিরও বেশি বই মুদ্রণের জন্য প্রায় ৮০ হাজার মেট্রিক টন কাগজ প্রয়োজন হয়। টনপ্রতি ৮৪ হাজার টাকা প্রাক্কলিত দরে ওই কাগজের বিক্রয়মূল্য ৬৭২ কোটি টাকা। এ কাগজ থেকে বিএসটিআইয়ের মার্কিং ফি পাওয়ার কথা থাকলেও পাচ্ছে না। এতে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
এ ব্যাপারে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা জানান, ‘কাগজের মান দেখার জন্য আমরা ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগ দিয়েছি। দরপত্রের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী মানপরীক্ষা করে কাগজ ছাড় করে ইন্সপেকশন এজেন্ট। ফলে নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার কোনো সুযোগ নেই।’
জানা যায়, মূলত সিন্ডিকেট করেই এনসিটিবির বইয়ের কাজ পায় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান, যারা বিএসটিআইয়ের মান সনদ ছাড়াই কাগজের মিলে উৎপাদিত নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করে। সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়া এনসিটিবির কিছু কর্মকর্তাও সব কিছু জেনেশুনেও না জানার ভান করেন। এতে সরবরাহকারী ও মুদ্রাকররা নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করেও পার পেয়ে যায়। কিন্তু নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানো হলে ছাপার মান খারাপ হয় এবং বই টেকসই হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বইয়ে ছাপানো ছবি থেকে কালি উঠে যায়, ছবি বোঝা যায় না। এ ছাড়া নিম্নমানের কাগজে নানা ধরনের রোগজীবাণু থাকে, যা শিশুস্বাস্থ্য ও চোখের জন্য ক্ষতিকর।
জানা যায়, এনসিটিবিতে মুদ্রণকাজের তদারককারী প্রতিষ্ঠান থাকলেও সেখানেও নিয়মিতভাবে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে। এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের একটি অংশের সহায়তায় মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট করে রিসাইকেল্ড কাগজ ক্রয় করে নিম্নমানের বই ছাপাচ্ছে।
কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতি এনসিটিবির গুদামে সরবরাহ করা কাগজ বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) গবেষণাগারে পাঠায়। সেখানে দেখা যায়, এনসিটিবি তার দরপত্রে যে টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন উল্লেখ করেছিল, সরবরাহ করা কাগজের মান তার চেয়ে নিম্নমানের। কাগজের ‘বাস্টিং ফ্যাক্টর’ কমপক্ষে ১২ থাকার কথা থাকলেও পরীক্ষায় পাওয়া গেছে মাত্র ৮ দশমিক ৫৮, ‘ব্রাইটনেস’ কমপক্ষে ৮০ থাকার কথা অথচ আছে ৬৭ দশমিক ৭৮ এবং ‘জিএসএম’ ৬০-এর বেশি থাকার কথা থাকলেও আছে ৫৮ দশমিক ৮৯। আর কাগজ কতটা মজবুত, কত দিন টিকতে পারে সে জন্য কাগজের ‘ফেয়ার ফ্যাক্টর’ কত তা জানা জরুরি। অথচ স্পেসিফিকেশনে এ ধরনের কোনো চাহিদাই নেই।
সাম্প্রতিক সময়েও পরীক্ষা করে বইয়ে জিএসএম ৬০’র বদলে ৪৬ দশমিক ৫৬ এবং ব্রাইটনেস ৮৫ শতাংশের বিপরীতে পাওয়া যায় ৬৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
সিএম সনদহীন কারখানার কাছ থেকে নিম্নমানের কাগজ না কিনে শুধু বিএসটিআই মানসনদপ্রাপ্ত কারখানা থেকে কাগজ সংগ্রহ করার জন্য বাংলাদেশ পেপারমিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমএ) পক্ষ থেকেও বারবার শিল্পমন্ত্রীসহ অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, এনসিটিবি চেয়ারম্যান ও বিএসটিআই মহাপরিচালক বরাবর আবেদন জানানো হয়।
আবেদনে বলা হয়, এনসিটিবি আইনের তোয়াক্কা না করে বিএসটিআই মান ছাড়াই কাগজ ক্রয় ও বই মুদ্রণ করে চলছে। এতে একদিকে আইন অমান্য করা হচ্ছে, অন্যদিকে মুদ্রিত বইয়ের গুণগত মান বজায় থাকছে না। শিক্ষার্থীরা মানসম্মত বই না পাওয়ায় বই উৎসবের মতো সফল অর্জন সঠিকভাবে মূল্যায়ন হচ্ছে না। একইসঙ্গে ভাবমূর্তি নষ্ট ও সিএম লাইসেন্স ফি বাবদ বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
এমনকি দরপত্র আহ্বানের ক্ষেত্রে বিএসটিআই সনদ বাধ্যতামূলক করতে বিপিএমএ একাধিকবার এনসিটিবির কাছে আবেদন জানালেও এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
Posted ১২:০৯ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২১ মে ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed