আদম মালেক | বুধবার, ০৬ জানুয়ারি ২০২১ | প্রিন্ট | 3836 বার পঠিত
বেসরকারি বীমা কোম্পানি প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সে চলছে লুটপাটের মহোৎসব। এজন্য কোম্পানিটি ১০ বছর ধরে কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি। এ দুর্নীতির জন্য দায়ী করা হয় কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ করিম, চেয়ারম্যান নাসির আলী শাহ, তার শ্যালক কোম্পানির পরিচালক নাজিম তাজিক এবং তাদের সহযোগীদের। তাদের কারসাজিতে এখানে পিআরের মাধ্যমে প্রিমিয়াম আত্মসাৎ করে অবলোপন হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়। জমি ও ফ্ল্যাট ক্রয়ের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়ে কোম্পানির বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটে। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই বীমার টাকা নামে-বেনামে ঋণ দেয়া হয়, যা আর কখনো ফেরত আসে না বলে হাইকোর্ট কর্তৃক নিয়োজিত অডিট ফার্ম হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সম্প্রতি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) বরাবর এ প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে অভিযোগ করেন প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সে কর্মরত লোকজন।
দুর্নীতির প্রকৃতি প্রসঙ্গে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থ আত্মসাতের জন্য ব্যবহৃত হয় পিআর। পিআর হারিয়েছে বলে থানায় মামলা হয়। অথচ পরে এসব পিআর ব্যবহার করে টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ভুয়া জমি দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়। সরেজমিন দেখা যায়, ওইসব সম্পত্তি খাসজমি। গ্যারান্টি ছাড়াই ঋণ নেয়া হয়, যা কখনো ফেরত আসে না। পরে অবলোপনের খাতায় প্রদর্শন করা হয় এসব অনাদায়ী ঋণ। অযৌক্তিকভাবে কোম্পানির এমডির বেতন বাড়ানো হয় বলেও হুদা ভাসি কোম্পানির প্রতিবেদনে উঠে আসে।
নিয়োগ পদোন্নতিতেও নিয়মনীতির বালাই নেই বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়। মাস্টার্স ডিগ্রিধারীদের বেতন কোনো কোনো কোম্পানির টি-বয়ের চেয়েও কম। আবার এসএসসি পাসেও অনেক মোটা অঙ্কের বেতন দেয়ার মতো ঘটনা প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সে ঘটেছে।
আইডিআরএ দাখিলকৃত অভিযোগপত্রে হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলা হয়, প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক চেয়ারম্যান নাসির আলী শাহ, তার শ্যালক নাজিম তাজিক ও সাবেক এমডি এনায়েত আলী খান ৩৯৭টি পিআরের মাধ্যমে ১ম বর্ষ প্রিমিয়ামের ৩০ কোটি টাকাসহ ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। আত্মসাতের পর অবলোপন হিসেবে সমন্বয় করা হয়। এ পিআর হারিয়ে গেছে বলে পল্টন থানায় মামলা হয়। পরে এ পিআর ব্যবহার করেই ৩০ কোটি টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে সেই টাকা কোম্পানিতে জমা না দিয়ে নিজেরা আত্মসাৎ করেন। ২০১২ সালের পূর্বেও ৮৩৭টি পিআর বইয়ের কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি।
হুদা ভাসি চৌধুরী প্রতিবেদনে আরো অনেক অনিয়মের তথ্য উল্লেখ করা হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে, ২০১০ সালে ঢাকার আফতাব নগরে ২৫ কোটি টাকা মূল্যে ২২ কাঠা জমি ক্রয়ে ১৭ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা। যাচাই-বাছাই করে দেখা যায় কাঠাপ্রতি জমির মূল্য ৩০-৪০ লাখ টাকা বেশি নয়। অথচ এসব সম্পত্তি ছিল খাসজমি। তাই আজও রেজিস্ট্রি হয়নি। এর দুর্নীতির মূলে নাসির আলী শাহের আরেক শ্যালক, যিনি সে সময় ইস্টার্ন হাউজিংয়ে পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তার হাত রয়েছে। তাদের কারসাজিতে এ লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এর বাইরে চট্টগ্রামেও ১৩ কোটি টাকা মূল্যে একটি ফ্লোর কিনে, যা আজও অন্যের দখলে।
আরেক ঘটনায় দেখা গেছে, নাসির শাহ ও নাজিম তাজিক চক্র নিয়ম অমান্য করে নিজেরাই বেনামে ৬ কোটি টাকা ঋণ দেয়, যা আজও ফেরত আসেনি। ২০১৩ সালে এ অনাদায়ী অর্থ অবলোপনের খাতায় চলে যায়। এ চক্রের সদস্যরা ডাবল কমিশন বাবদ ৮০ লাখ টাকা লোপাট করেছে এবং পিআরের পাতা দিয়ে ৪১ লাখ টাকা সংগ্রহ করে আত্মসাৎ করে। এছাড়া কোম্পানির পরিচালক ও সাবেক এমডি এমএ করিম এ চক্রের সহযোগিতায় অবৈধভাবে গ্যারান্টি বাবদ কোম্পানি থেকে ৪৪ লাখ টাকা উত্তোলন করে নিয়ে গেছে। এ চক্রের আশীর্বাদেই এমডি থাকাকালীন এমএ করিম তার বেতন ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার স্থলে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত উত্তোলন করতে পেরেছিলেন। যারা এই অপকর্মের সহযোগী তাদের কাউকে এসএসসি পাস হলেও ডিএমডি হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে মোটা অঙ্কের বেতন ধরিয়ে দেয়া হয়। আর দুর্নীতিতে সাড়া না পাওয়ায় দীর্ঘদিন কোম্পানিতে কর্মরত অনেক মাস্টার্সকেও কোনো পদোন্নতি ছাড়াই সামান্য বেতন পরিশোধ করা হচ্ছে।
অডিট রিপোর্টের বরাত দিয়ে আইডিআরএ দাখিলকৃত অভিযোগপত্রে বলা হয়, প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি প্রতারণার মাধ্যমে আলফা ক্যাপিটাল ও গ্যালাক্সি লিমিটেড নামে দুটি সহযোগী কোম্পানি গঠন করে। এ কোম্পানি দুটির ৫১ শতাংশ প্রগ্রেসিভ লাইফের আর ৪৯ শতাংশ নাসির আলী শাহ, এমএ করিম ও নাজিম তাজিক চক্রের। এখান থেকেও চক্রটি ৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়।
Posted ২:৩২ অপরাহ্ণ | বুধবার, ০৬ জানুয়ারি ২০২১
bankbimaarthonity.com | Sajeed