পান্না কুমার রায় রজত | শনিবার, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | প্রিন্ট | 970 বার পঠিত
আজ বাংলাদেশ-জাপান কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি। ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জাপান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। জাপান বাংলাদেশের পরীক্ষিত ও অকৃত্রিম বন্ধু দেশ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও জাপানের বন্ধুসুলভ আচরণ অনেক সহযোগী ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য জাপানের শিক্ষার্থীরা সেই সময়ে তাদের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলোর মতে, এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ও বঙ্গোপসাগরীয় সংযোগস্থলে অবস্থানের কারণে জাপানের কাছে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি। আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহযোগিতা (ওডিএ) কর্মসূচির আওতায় বিশে^র বিভিন্ন দেশে উন্নয়ন সহযোগিতা দিয়ে আসছে জাপান। বর্তমানে জাপানি (ওডিএ) সবচেয়ে বড় গন্তব্য বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক সম্পর্কবিভাগ (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে জাপানের মোট সহযোগিতার পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪২৫ কোটি ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরেও দেশটির কাছ থেকে আরো ২৬৩ কোটি ডলারের বেশি অর্থ সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে।
জাপান একটি শিল্পোন্নত দেশ, যার বাজারভিত্তিক অর্থনীতি বিশে^র ২য় বৃহত্তম অর্থনীতি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাথে সম্পর্কিত অর্থনৈতিক খাতগুলি অত্যন্ত দক্ষ ও প্রতিযোগিতাশীল। তবে সুরক্ষিত খাত যেমন কৃষি বিতরণ এবং বিভিন্ন পরিষেবার উৎপাদনশীলতা তুলনামূলকভাবে কম। বাংলাদেশ থেকে জাপানের আমদানিকৃত পণ্যগুলোর মধ্যে চামড়াজাত পণ্য, তৈরি পোশাক এবং চিংড়ি অন্যতম। জাপান বাংলাদেশে বহিবির্শে^র সরাসরি বিনিয়োগের চতুর্থ বৃহত্তম উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমসারিতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং মালয়েশিয়া। জাপান-বাংলাদেশের সাথে দৃঢ় সম্পর্কের পেছনে দু’দেশের সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির একটি হৃদ্যতাপূর্ণ বন্ধনই বেশি কাজ করছে। তাই জাপান বাংলাদেশের জন্য একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী উৎস। বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য যে জাপান বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রেখে চলা একটি বৃহত্তম দ্বি-পাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী। তারা সবসময়েই আমাদের সংকটময় খাতগুলোতে যেমন দারিদ্র্যদূরীকরণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং জনশক্তি উন্নয়ন উদার সহায়তা দিয়েছে। বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনের তথ্য মোতাবেক, কোভিড-১৯ এর কারণে অর্থনৈতিক দুর্দশা রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে জাপানে। বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক গত বছরের তুলনায় বিশে^র তৃতীয় বৃহৎ এই অর্থনীতির মোট দেশজ উৎপাদন কমেছে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। সাধারণত পরপর দুই প্রান্তিকে অর্থনীতি সংকুচিত হলে তা মন্দায় পড়েছে বলা হয়। এরপর করোনার কারণে সংকট আরো তীব্র হয়েছে। এপ্রিল থেকে জুন মাসে জিডিপি কমেছে আশঙ্কার অনেক বেশি। যা ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পতন। অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশার অন্যতম কারন হলো ভোক্তা ব্যয় ব্যাপক কমে যাওয়া। দেশটির অর্থনীতির অর্ধেক নির্ভরশীল এই ভোক্তা ব্যয়ের ওপর। বিশ^ব্যাপী বাণিজ্য মহামারি কবলে পড়ায় রফতানিও তীব্র হ্রাস পেয়েছে। তবে আমরা আশা করি করোনা পরবর্তী সময়ে পরিশ্রমী ও বিনয়ী এই জাতি প্রবৃৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ৩০ লাখেরও বেশি ডোজ অ্যাস্ট্রোজেনেকার টিকা এবং জরুরি সহায়তার জন্য ৭৫ বিলিয়ন ইয়েন ঋণ দিয়ে করোনা ঠেকানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের লড়াইকে সহায়তা করতে সক্ষম হয়েছে জাপান। এখন অর্থনৈতিক সুবিধার বিষয়ে যদি বলা যায় তাহলে বলবো, এ মুুহূর্তে আমাদের বাংলাদেশের অর্থনীতি অত্যন্ত গতিশীল। এখানে বিনিয়োগ করলে যা কিছু উৎপাদিত হবে তার একটা স্থিতিশীল বাজারও নিশ্চিত হয়ে আছে আর বাংলাদেশে লাভজনক বিনিয়োগ যৌথ অংশীদারিত্ব গড়ে তোলাই হচ্ছে অর্থনৈতিক কূটনৈতিক।
অর্থনৈতিক কূটনীতির মূল উদ্দেশ্য হল বৈদেশিক বিনিয়োগকে আকর্ষণ করা। রফতানি বৃদ্ধিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা শ্রম শক্তি বিদেশে রফতানিকল্পে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আমদানি রফতানি বিনিয়োগ, ঋণ সাহায্য, মুক্তবাজার অর্থনীতি, মুক্তবাণিজ্য চুক্তি ইত্যাদি অর্থনৈতিক কূটনীতির মূল বিষয়। অর্থনৈতিক কূটনীতি বৈদেশিক নীতির সেই অংশ যেখানে প্রত্যেক দেশ নিজ দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ বিবেচনা করবে। এক সময় আমাদের কূটনীতিটা ছিল রাজনৈতিক। বিশ^ব্যাপী প্রতিযোগিতার ধরণ আর সময়ের সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে আমাদের কূটনৈতিক কৌশলও। বলতে গেলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বাণিজ্য প্রসার, অধিকতর বিনিয়োগ, নতুন নতুন প্রযুক্তি আমদানি ও বিপুল রেমিট্যান্স আয় আর দেশের অব্যাহত উন্নয়ন কাজ এগিয়ে নিতে অর্থনৈতিক কূটনীতির প্রয়োজন। আমাদের সম্পর্কের গুরুত্ব এখন শুধু দ্বিপাক্ষিক নয়। এশিয়া এবং সামগ্রিকভাবে ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও বাড়ছে। বাংলাদেশ এখন উইন উইন ভিত্তিতে বিনিয়োগ করা যায়। অর্থাৎ বিনিয়োগে শুধু বাংলাদেশই লাভ হবে না। যারা বিনিয়োগ করবে তারাও লাভ হবে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) বাংলাদেশ অফিসটি ১৯৭৪ সালে স্থাপিত হয় এবং সে বছরই প্রথম জাপানি অফিসিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স (ওডিএ) ঋণ দেয়া হয় বাংলাদেশকে। বর্তমানে বাংলাদেশে গভীর সমুদ্র বন্দর প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি কক্সবাজারের মাতারবাড়ী ও ধলঘাট এলাকার সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিভিন্ন প্রকল্পে বাস্তবায়ন করবে জাইকা এবং ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে প্রাথমিক প্রস্তাব করেছে। যার মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলার ওডিএ (অফিসিয়াল ডেভেলপমেন্ট এইড) এবং ১০ বিলিয়ন ডলার বেসরকারি বিনিয়োগ।
দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্লোথ বেল্ট (বিগবি) উদ্যোগের আওতায় মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্র বন্দরসহ পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি হাব, লজিস্টিক হাব, ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব ও গভীর সমুদ্রবন্দর-কেন্দ্রিক অবকাঠামো হাব গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের, যা ২০১৪ সালে বাংলাদেশ এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী সম্মত হন। এনার্জি হাব গড়ে তুলতে এলএনজি টার্মিনাল, এলপিজি টার্মিনাল, অয়েল টার্মিনাল, গ্যাস ট্রান্সমিশন ও সিঙ্গেল পয়েন্ট মুবিং প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। অন্যদিকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব হিসেবে অয়েল রিফাইনারি, এনার্জি ও ফুড স্টোরেজ, ট্যুরিজম, এমব্যাংকমেন্ট ও ওয়াটার ফ্রন্ট ইকোনমিক জোন প্রতিষ্টার কাজও চলছে। এছাড়া ১০৬ কিলোমিটার দীর্ঘ চট্টগ্রাম- কক্সবাজার এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী জাপান। তবে জাপানি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেশটির সহযোগিতা সরকারি প্রকল্পেই সীমাবদ্ধ। বেসরকারি খাতে জাপানি বিনিয়োগ প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। স্বাধীনতার পর থেকে ৫০ বছরে জাপান বাংলাদেশকে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। আর বাংলাদেশে জাপানের বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমান প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার। যেসব জাপানি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে বিনিয়োগের ইচ্ছা পোষণ করেছে সেগুলো হলো- মিৎসু অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড, জাপান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন ফর মাতারবাড়ী রেগাস টার্মিনাল, এ জয়েন্ট ভেঞ্চার অব ইনপেক্স করপোরেশন, সোজিৎস করপোরেশন, কিউশু ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি অ্যান্ড লোকাল ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস লিমিটেড, জয়েন্ট ভেঞ্চার অব মারুবেনি করপোরেশন অ্যান্ড ওসাকা গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড এবং জয়েন্ট ভেঞ্চার অক সুমিটোমো করপোরেশন অ্যান্ড চুংকো ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি ইনক।
বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় আগের চেয়ে অনেক বেশি। মাথাপিছু আয়ে ভারতকে আমরা ছাড়িয়ে গিয়েছি। একইসঙ্গে এ অঞ্চলে ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক বড়। মাথাপিছু আয় ২ হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেলে ভোক্তারা দ্রুত উন্নতি করে। এ কারণে ফুডস আইটেমসহ নানাধরনের পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যকার কূূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন উপলক্ষে বাজারে আসছে ৫০ টাকা মূল্যমানের নতুন স্মারক রৌপ্য মুদ্রা। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাপানের মুদ্রা উৎপাদনকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জাপান মিন্টের যৌথ উদ্যোগে মুদ্রাটি বানানো হয়েছে। আজ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ নতুন এ রৌপ্য মুদ্রাটি বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয় এবং মিরপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা জাদুঘর থেকে বিক্রি করা হবে। এ ছাড়া জাপান মিন্টের মাধ্যমে জাপানেও বিক্রি করা হবে। স্মারক বক্সসহ মুদ্রাটির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। বাজার অর্থনীতি আর বিশ^ায়নের যুগে অর্থনৈতিক স্বার্থই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সাহায্য ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে জাপান উদার। এ সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় ও মজবুত হোক ৫০ বছর পূর্তিতে এই হোক আমাদের আশাবাদ।
Posted ১২:৪৩ অপরাহ্ণ | শনিবার, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২
bankbimaarthonity.com | rina sristy