বিবিএ নিউজ.নেট | বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ | প্রিন্ট | 560 বার পঠিত
রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান আমি। আমার দাদা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শহীদ এম মনসুর আলীর দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীর রাজনৈতিক জীবন থেকেই আমাদের রাজনৈতিক পরিবারের পথচলা শুরু। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও একাধিকবারের মন্ত্রীও ছিলেন দাদা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের জঘন্য হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আসলে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী রাজনীতির শুরু। দাদার মৃত্যুর পর আমার পিতা মোহাম্মদ নাসিম ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি দেশে আসার সঙ্গে সঙ্গে জিয়াউর রহমান তাকে গ্রেফতার করেন। তারপর থেকেই জেল-জুলুম, নির্যাতন, রাজপথের আন্দোলন সবকিছুর মধ্য দিয়ে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাবা উঠে এসেছেন।
জাতির জনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকে তার বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে রাজপথে ছিলেন। পরবর্তী সময়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন বহুগুণ বেড়ে যায়। জামায়াত-বিএনপিকে মোকাবেলায় এবং তাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন।
দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। সে সময় আমাদের প্রিয় নেতা, আমার পিতা একাধিক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। দীর্ঘদিন পর সিরাজগঞ্জকে উন্নয়নের ধারায় নিয়ে আসেন। নদীভাঙন থেকে রক্ষা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কর্মসংস্থানসহ সার্বিক কাজ করেন। আর ১৯৯৬ সালেই সর্বপ্রথম আমার রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়া। ওই নির্বাচনে আমি সর্বপ্রথম প্রচারণার কাজে অংশগ্রহণ করি। সেই নির্বাচনে আমার পিতা সিরাজগঞ্জ-১ (কাজীপুর) ও সিরাজগঞ্জ-২ (সদর) আসনে নির্বাচন করেন।
এরপর ’৯৬ সালে তার মন্ত্রিত্বের সময় আমি যেহেতু পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে ছিলাম, তাই সে সময় আর রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম না। ২০০১ সালে দেশে ফিরে আসি। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হারিয়ে দেয়া হয়েছিল। সে সময় দেশের অবস্থা ভয়াবহ ছিল, আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল। নেতাকর্মীদের নামে একাধিক মামলা দেয়া হয়েছিল। সে সময়ে আমি আমার পিতার পক্ষে আইনি লড়াইয়ে কাজ করেছি। পরবর্তী সময়ে এক-এগারোর সরকারের সময় জননেত্রী শেখ হাসিনা, আমার পিতাসহ বড় বড় রাজনীতিবিদকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল। সে সময় আমার পিতাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
আমাদের পরিবারকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়। সে সময়ও পিতার পক্ষে আইনি লড়াই আমি চালিয়েছি। নির্যাতনের কারণে আমার পিতা জেলখানায় অসুস্থ হয়ে যান। তার জামিনের ব্যবস্থা করা, চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোসহ সব কার্যক্রম আমি পরিচালনা করি।
জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোবলের কারণে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হলো। কিন্তু মিথ্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে আমার পিতার সাজা হয়। সে কারণে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি এবং আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি। ওইভাবে বলতে গেলে নির্বাচনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে আমার রাজনীতিতে প্রবেশ। সেই নির্বাচনে আমি রেকর্ড সংখ্যক ভোটে জয়লাভ করি। সেটা ছিল আমার পিতা, পরিবার ও আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। কারণ আমার তো রাজনীতিতে অভিজ্ঞতা ছিল না। সেই থেকে আমার রাজনীতির পথচলা। ২০০৯ সালে তাকে আমরা দেশে নিয়ে আসি। তিনি আবারো রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তার নির্দেশনা, উপদেশ, পরামর্শ নিয়ে রাজনীতিতে আমার পথচলা শুরু হয়। নির্বাচিত হয়ে এলাকার উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। ২০১২ সালে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হই।
২০১৪ সালের নির্বাচনে আমার পিতা আবারো এমপি নির্বাচিত হন, মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সে সময় আমি সংসদ সদস্য না হলেও আমার নির্বাচনী এলাকার রাজনীতিতে সংযুক্ত থেকেছি। কারণ তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, ১৪ দলের সমন্বয়কসহ অনেক দায়িত্ব তাকে পালন করতে হয়েছে। ফলে এলাকার সমস্যা সমাধানে সময় দেয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তখন তার নির্দেশনায় এলাকার রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছি। এলাকার উন্নয়ন ও রাজনীতি দুটোকে সচল রাখতে চেষ্টা করেছি।
২০২০ সালে করোনায় আমাদের পরিবারের বিশাল বিপর্যয় ঘটেছে। করোনার মধ্যেও আমার পিতা ত্রাণ বিতরণে এলাকায় গিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এটি আমাদের জন্য বড় ক্ষতি। এ ক্ষতি আমরা আসলে পূরণ হওয়ার নয়। আমার পিতার মৃত্যুতে রাজনীতির ক্ষতি হয়েছে। আমাদের সিরাজগঞ্জের যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হবে না। এটি অপূরণীয়, যা সিরাজগঞ্জবাসী উপলব্ধি করছে। তিনি ১৪ দলের সমন্বয়ক হিসেবে সবাইকে আগলে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতেন, জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করতেন।
আমাদের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদকে একটি প্লাটফর্মে নিয়ে আসেন। এ কাজগুলো আমার বাবা দলীয় রাজনীতির বাইরে গিয়েও করতেন। এ বিশাল শূন্যতা আসলেই অপূরণীয়। তার সব কর্মের প্রভাব আমার ওপর রয়েছে। আমি সেই বিষয়গুলো মেনে চলতে সাধ্যমতো চেষ্টা করি। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে ধারা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতি সেটি আমার দলের বাইরে হলেও তাদের সাথে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলার চেষ্টা করি। এসব কিছু পিতার আদর্শ অনুসরণ করে করতে চাই। এলাকার উন্নয়ন আমার পিতার সবসময় স্বপ্ন ছিল। এলাকার মানুষই প্রথম। সেটাও আমি অব্যাহত রাখতে চাই।
আমার পিতার সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগের যে একটা বড় গুণ ছিল, সেটি আমাকে রাজনীতিতে আসার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। আব্বা যখন ’৯৬ সালে প্রথম মন্ত্রী হন তখন দেখা যেত মন্ত্রিপাড়ায় আমাদের বাসা ঘিরে একটা হাটবাজারের মতো অবস্থা। হাজার হাজার লোক বাইরে অপেক্ষা করত, ভেতরে যেত। তার সাথে দেখা করত। মন্ত্রণালয় ও বাসা সবার জন্য অবারিত ছিল।
আমরা দেখেছি যিনিই তার কাছে আসতেন তিনিই সুখ-দুঃখের কথা বিনিময় করতেন। আব্বা যতটুকু পারতেন সহযোগিতা করতেন। আর সহযোগিতা করতে পারুক না পারুক কথা শোনা, পাশে দাঁড়ানোর জন্য কর্মী ও জনগণবান্ধব যে নেতৃত্ব তার ছিল এটি আমাকে রাজনীতির অনুপ্রেরণা জোগায়। এটি দেখেই আমি রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। আমি খেয়াল করে,ি মানুষের কতটুকু উপকার করতে পেরেছেন, তার চেয়েও বেশি তার পাশে কীভাবে দাঁড়ালেন, আপনি তাকে কতটুকু ধারণ করলেন, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি আব্বার ওই বিষয়গুলো দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি। আমি চেষ্টা করেছি ওই কাজগুলো করার এবং আমার দরজা যেন সবার জন্য অবারিত থাকে সে চেষ্টাই করি।
আমার কাছে এলাকা প্রথম। এলাকার সর্বোচ্চ উন্নয়ন আমাকে করতে হবে। আমাদের এলাকা অনেক বঞ্চিত হয়েছে। পঁচাত্তরের পর বঞ্চিত হয়েছে, নদীভাঙনে জর্জরিত হয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। সেই অবস্থা থেকে বিগত ১২ বছরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমি জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে অব্যাহত রাখতে চাই। এলাকার নদীভাঙন রোধ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বেকারত্ব দূর করা।
আমাদের এলাকায় বড় কোনো মিল-কারখানা নেই। আমার পিতা অনেক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। এখন আমি যদি কিছু প্রতিষ্ঠান করতে পারি তাহলে এলাকার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হবে। তরুণ যুবসমাজ চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠে এলাকার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি করতে পারে। সে অনুযায়ী কাজ করছি।
আমার দাদার স্মৃতি মনে নেই। রাজনীতিতে আমার কাছে সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা মনে হয় ১৯৯৬ সালে যেদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ওই সময় আমি সিরাজগঞ্জে ছিলাম। ফলাফল প্রকাশের পরদিন সকালবেলা হাজার হাজার মানুষ আমাদের বাসায় এসেছিল। তখন তাদের চোখে ছিল আনন্দাশ্রু। পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রজন্ম তো শুধু দেখেই এসেছিল নির্যাতন। বিজয়ের পর নেতাকর্মীদের চোখে-মুখে যে আনন্দ, ভালোবাসা ছিল আমার পিতাকে ঘিরে তা আমাকে খুব নাড়া দিয়েছিল।
Posted ২:১৯ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০
bankbimaarthonity.com | rina sristy