শুক্রবার ২৬ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মানি লন্ডারিং অর্থনীতির জন্য ক্ষরণ জাতীয় একটি সমস্যা-ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

  |   বৃহস্পতিবার, ২৫ নভেম্বর ২০২১   |   প্রিন্ট   |   454 বার পঠিত

মানি লন্ডারিং অর্থনীতির জন্য ক্ষরণ জাতীয় একটি সমস্যা-ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সচিব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বহুমুখী প্রতিভাধর একজন ব্যক্তি। তিনি একজন সুলেখকও বটে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন। বিশেষ করে অর্থনীতির নানা বিষয় নিয়ে তিনি নিয়মিত লিখছেন। দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি পত্রিকার পক্ষ থেকে ড. মজিদের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন এম এ খালেক। সাক্ষাৎকারের বিবরণ এখানে উল্লেখ করা হলো:

দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: মানি লন্ডারিং একটি দেশের অর্থনীতির জন্য কতটা ক্ষতিকর বলে মনে করেন?

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: মানি লন্ডারিং প্রত্যেক দেশের জন্যই একটি ক্ষরণ জাতীয় জটিল সমস্যা। বিশেষ করে যে সব দেশ বৈদেশিক মুদ্রা ও বিনিয়োগের সংকটে ভোগে তাদের জন্য মানি লন্ডারিং উভয় সংকট ও বহুমুখী মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করে। যে দেশে বিনিয়োগযোগ্য পুঁজির অভাব সেসব অর্থনীতি মানি লন্ডারিং এর কারণে বেশি সমস্যায় পতিত হয়। কারণ পুঁজি সংকটগ্রস্ত দেশ থেকে টাকা যদি বিদেশে চলে যায় তাহলে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়। বোঝা যায় আমরা পুঁজি ধরে রাখতে পারছি না। পুঁজি ধরে রাখতে না পারার কারণে সব সময়ই প্রয়োজনীয় পুঁজির জন্য পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হচ্ছে। পুঁজি স্বল্পতার দেশ থেকে মানি লন্ডারিং বা পুঁজি পাচার অর্থই হচ্ছে অর্থনীতির জন্য ইন্টারনাল হ্যামারেজ বা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ। জাপান বা আমেরিকার মতো বড় অর্থনীতির একটি দেশ থেকে মুদ্রা পাচার বা মানি লন্ডারিং হলে তাদের হয়ত খুব একটা ক্ষতি হয় না। কারণ এই ক্ষতি তারা পুষিয়ে নিতে পারে। তাদের উদ্বৃত্ত পুঁজি আছে। তথাপি সে সব দেশে মানিলন্ডারিংকে কঠোর পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা হয় । আমাদের মতো একটি দেশ থেকে পুঁজি পাচার বা মানি লন্ডারিং হলে সেই ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব হয় না। কস্টার্জিত কিংবা দুর্নীতিজাত যে অর্থ নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবহৃত হতে পারতো সেই অর্থ বিদেশে বিনিয়োগে ব্যবহৃত হতে দেয়াটাই আত্মঘাতী। এটা কোনোভাবেই একটি দেশের জন্য কাম্য হতে পারে না। উন্নয়নশীল দেশগুলো সব সমযই পুঁজি স্বল্পতায় ভোগে। তাই তাদের দেশ থেকে পুঁজি যদি কোনোভাবে বাইরে চলে যায় তাহলে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। মানি লন্ডারিং হলে এটা বোঝা যায় যে, আমাদের কস্টার্জিত টাকা ধরে রাখার সক্ষমতা কম। সেই জন্য টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। একটি দেশে মানি লন্ডারিং এবং অর্থ পাচারের মতো ঘটনা কখন ঘটে? যখন কোনো দেশে অবৈধ বা অস্বচ্ছভাবে অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকে কিন্তু অভ্যন্তরীণভাবে সেই টাকা ব্যবহারের অবাধ সুযোগ নেই তখনই ব্যাপকভাবে মানি লন্ডারিং হয়। অর্থ পাচার হয়। কোনো দেশের অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনকারীগণ যদি তাদের অর্থ অভ্যন্তরীণভাবে বিনিয়োগ বা ব্যবহারের সুযোগ পায় তাহলে পাচার বা মানি লন্ডারিং হবার সম্ভবনা কম থাকে। কোনো দেশ যদি অবৈধ অর্থ অর্জনের সুযোগ কম এবং বিদেশে পাচারের ও বিনিয়োগের সুযোগ কম সেই দেশ থেকে সাধারণত অর্থ পাচার হয় না। যেহেতু অধিকাংশ দেশই অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ ব্যবহারের অনুমতি দেয় না তাই যারা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করেন তারা সেই অর্থ ব্যবহারের জন্য বিদেশে পাচার করে। পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে যারা বিদেশ থেকে অর্থ আহরণকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। সেই অর্থ বৈধ কি অবৈধ তা নিয়ে তারা ভাবে না। মানি লন্ডারিং এবং অর্থ পাচার ঠেকাতে হলে বিশে^র সবগুলো দেশকে একযোগে উদ্যোগ নিতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে কোনো দেশের পক্ষে মানি লন্ডারিং এবং অর্থ পাচার ঠেকানো সম্ভব নয়। দেশেরঅভ্যন্তরে বিনিয়োগের পরিবেশ যদি ভালো থাকে তাহলে মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচার কম হবে। আমাদের মতো দেশে অবৈধ অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকা এবং বিনিয়োগের অনুকূল ও কার্যকর পরিবেশ না থাকার কারণেই সাধারণত অর্থ পাচার হয় । অর্থনীতিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ অবৈধভাবে অর্জিত টাকা আছে কিন্তু সংগত কারণে সেই টাকা বিনিয়োগ করা হয় না বা যায় না। ফলে মানি লন্ডারিং বাড়ছেই। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের উপায় উৎসমুখে বন্ধ না হলে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ অর্থবহ হবে না। মানি লন্ডারিং একটি দেশের অর্থনীতির জন্য রক্তক্ষরণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে।

দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: মানি লন্ডারিং কি কোনো একক দেশের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নাকি সব দেশ মিলে উদ্যোগ নিতে হবে?

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: মানি লন্ডারিং কোনো একক দেশের সমস্যা নয়। এটা বিশ^ব্যাপী অধিকাংশ দেশেরই সমস্যা। কাজেই কোনো একটি দেশ চেষ্টা করলেই মানি লন্ডারিং এবং মুদ্রা পাচার বন্ধ হবে না। সবদেশকে মিলেই এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কোনো দেশ থেকে যাতে মুদ্রা পাচার এবং মানি লন্ডারিং হতে না পারে তার ব্যবস্থা যেমন করতে হবে তেমনি যে দেশে মুদ্রা পাচার হয়ে যাবে সেই দেশেরও উচিত হবে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা তাদের অর্থনীতিতে প্রবেশ ও ব্যবহার হতে না দেয়া। কোনোভাবে মানি লন্ডারিং এর মাধ্যমে টাকা চলে গেলেও সংশ্লিষ্ট দেশেও সেই টাকা ফেরত দানের ব্যবস্থা থাকা। এক দেশ মানি লন্ডারিং ঠেকানোর ব্যবস্থা করল কিন্তু অন্য দেশে পাচারকৃত টাকা ব্যবহারের অবাধ সুযোগ থাকলে তো মানি লন্ডারিং কখনোই বন্ধ হবে না। কাজেই যে দেশ থেকে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে মুদ্রা পাচার হয় এবং পাচারকৃত মুদ্রা যে দেশে যায় উভয় দেশকেই এটা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে। এধরণের একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনা (গ্লোবাল প্রোগ্রাম এগেনেস্ট মানি লন্ডারিং) আছে, বাংলাদেশও ইউএন এর সে ব্যবস্থাপনা সাথে সংযুক্ত সদস্য দেশ।

দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: এমনিতেই দেশে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কম। তার উপর করোনার কারণে দেশের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হয়েছে তা কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: করোনার কারণে দেশের অর্থনীতি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এটা আগেই বলা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে। করোনাকালীন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রায় সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু তাই নয় বিদ্যমান কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলোও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন অনেক প্রতিষ্ঠানই ব্যাপকভাবে কর্মী ছঁটাই করেছে। ব্যয় সংকোচনের লক্ষ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম সীমিত করেছে। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কিন্তু করোনার কারণে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে অথবা তাদের কার্যক্রম সীমিত করতে বাধ্য হয়েছে। ফলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সীমিত হয়েছে যদিও প্রতিনিয়তই দেশে বেকার মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আগামীতে দেশে বেকারত্বের হার অনেকটাই বেড়ে যাবে। বিদেশ থেকে অনেকেই কর্মচ্যুত হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। তারাও বেকার সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে তুলছেন। বেকার সমস্যা বেড়ে গেলে দারিদ্র্যের হারও বৃদ্ধি পাবে। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা দেশে ফিরে আসার ফলে দু’ধরনের ক্ষতি হচ্ছে অর্থনীতিতে। প্রথমত, তারা দেশে ফিরে আসার কারণে বেকার সমস্যা আরো তীব্রতর হবে। একই সঙ্গে তারা যে রেমিট্যান্স প্রেরণ করতেন তা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আগামীতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে যে উন্নয়নের ধারা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছিল তার পেছনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত অর্থ একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করতো। আগামীতে এটা অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়বে। করোনার কারণে আবাসন খাতের যে ক্ষতি হয়েছে তা বলতে গেলে অপূরণীয়। কারণ মানুষের হাতে উদ্বৃত্ত অর্থ না থাকলে তারা আবাসন খাতে বিনিয়োগ করতে চায় না। কিন্তু করোনার কারণে মানুষের হাতে অর্থ কমে যাবার কারণে তারা ফ্লাট ক্রয় করতে মোটেও আগ্রহী হচ্ছেন না। ফলে আবাসন খাতে যারা বিনিয়োগ করছেন তারা এখন সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। আগামীতে দেশের অর্থনীতি পুরোপুরি চাঙ্গা না হওয়া পর্যন্ত আবাসন খাতের পরিস্থিতি ভালো হবে বলে মনে হয় না। আবাসন খাতের সঙ্গে অনেকগুলো সেক্টর জড়িত। তাদের অবস্থায় এখন খুবই খারাপ। অভ্যন্তরীণভাবে দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যে বর্তমানে চরম বিপর্যয়কর অবস্থা বিরাজ করছে। যারা এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান করতেন তারা চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। যারা বিভিন্নভাবে চাকরিচ্যুত বা পেশাচ্যুত হয়েছেন তাদের অনেকেই শহরের থাকার মতো সামর্থ্য নেই। তাই তারা নিজ নিজ গ্রামে চলে গেছেন। কিন্তু গ্রামে গিয়েও তারা কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারছেন না। হাতে জমানো অর্থ ব্যয় করে পরিবারের ভরণ-পোষণ করতে হচ্ছে। তারা দীর্ঘ দিন এভাবে গ্রামে থাকতে পারবেন না। তাদের আবারো কর্মসংস্থানের জন্য শহরে চলে আসতে হবে। কারণ তারা যে সব কাজের জন্য অভিজ্ঞ গ্রামে সেই কাজের সুযোগ নেই। কর্মচ্যুত হবার ফলে তাদের আর্থিক সামর্থ্যও কমে গেছে। তাই তারা চাইলেও আগের মতো পরিবারের পেছনে ব্যয় করতে পারবেন না। সবচেয়ে অসুবিধায় রয়েছেন যারা শহরের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট দোকান দিয়ে তার আয় থেকে সংসার চালাতেন তারা। তারা সম্পূর্ণরূপে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। অনেকেই ছিলেন যারা করোনার আগে শহরের বিভিন্ন ফুটপাথে পসরা সাজিয়ে আয় করতেন। তারা এখন আর আয় করতে পারছেন না। কারণ ফুটপাথের সব দোকানই এখন বলতে গেলে বন্ধ রয়েছে। যারা এ ধরনের ছোট ছোট ব্যবসায়ের মাধ্যমে তাদের সংসার চালাতেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও তাদের অনেকেই আর আগের ব্যবসায় ফিরে আসতে পারবেন না। কারণ তারা ইতোমধ্যেই সংসারের ব্যয় নির্বাহের জন্য সঞ্চিত ব্যবসায়ের পুঁজি খুঁইয়ে বসেছেন। তাদের যদি প্রয়োজনীয় পুঁজি সরবরাহ করা না যায় তাহলে তাদের পক্ষে আর পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু তারা কোথা থেকে প্রয়োজনীয় পুঁজি পাবেন সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই শ্রেণির ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বর্তমানে অত্যন্ত হতাশ অবস্থার মধ্যে দিন যাপন করছেন। অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরের সঙ্গে পরোক্ষভাবে যারা যুক্ত ছিলেন তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যারা বিভিন্নভাবে যুক্ত ছিলেন তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কারণ বড় প্রতিষ্ঠানের কাজ কমে গেলে সম্পৃক্ত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা একটি সিস্টেমের মধ্যে ছিলেন। সেই সিস্টেম পুরোপুরি ভেঙ্গে গেছে। আমাদের দেশের কর্মসংস্থানের প্রায় ৭৫ শতাংশই হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। কিন্তু করোনার কারণে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক সেক্টর আছে যেখানে ‘কাজ নাই তো বেতন নাই’ ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। এসব খাতে অনেকেই বেকার হয়ে পড়েছেন। কারণ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কাজ কমে গেছে। কর্মক্ষেত্রে এদের কোনো সুরক্ষা দানের ব্যবস্থা নেই। বড় বড় প্রতিষ্ঠানে যারা চাকরি করেন তাদের চাকরির নিশ্চয়তা থাকলেও ছোট প্রতিষ্ঠানে যারা চাকরি করেন তাদের চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নেই। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে অনেক লোক যুক্ত থাকার ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর সে কারণেই অর্থনীতি বিশেষভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে।

দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: করোনা কারণে আমাদের প্রচলিত সামাজিক-পারিবারিক সংহতি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করেন?

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: আপনি একটি চমৎকার প্রশ্ন করেছেন। আমাদের দেশে করোনার ক্ষতিকর প্রভাব আলোচনায় প্রধানত অর্থনেতিক ক্ষতির দিকটিই আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু করোনার কারণে আমাদের দেশের প্রচলিত সামাজিক সম্প্রীতি কীভাবে বা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা তেমন একটা আলোচনা হচ্ছে না। আমাদের দেশের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা অবস্থা অত্যন্ত মানবিক এবং সহানুভূতি সম্পন্ন। একজনের বিপদে আর একজন এগিয়ে আসবেন এটাই চলে আসছে যুগের পর যুগ ধরে। একজনের আনন্দে অন্য জন আনন্দিত হয়। কিন্তু করোনার কারণে আমাদের সেই হাজার বছরের প্রচলিত সামাজিক এবং পারিবারিক বন্ধন অনেকটাই শিথিল হয়ে গেছে। পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ কার্যত সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে। একজনের বিপদে আর একজন এগিয়ে আসতে পারছে না। ইউরোপীয় উন্নত দেশগুলোর সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং বন্ধন এক রকম। আর আমাদের দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ সম্পূর্ণ অন্য রকম। আমাদের সামাজিক সংস্কৃতি মানবতাবাদী এবং পরস্পর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ^াসী। ইউরোপীয় সংস্কৃতি হচ্ছে একক পরিবার প্রথায় বিশ^াসী। আর আমাদের দেশের সামাজিক প্রথা হচ্ছে যৌথ পরিবারে বিশ^াসী। পরিবারের এক জনের কস্টে অন্য জন এগিয়ে আসে। কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদ এতটাই প্রবল যে সেখানে কেউ কারো খবর রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। করোনা আমাদের প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থায় এবং ধারণায় প্রচন্ডভাবে আঘাত হেনেছে। আমাদের পারিবারিক ব্যবস্থা হচ্ছে একান্নবর্তী পরিবার ব্যবস্থা। ফলে পরিবারের মধ্যে মমত্ববোধ বেশি থাকে, যা উন্নত দেশগুলোতে কল্পনাও করা যায় না। করোনার কারণে আমাদের দেশের সামাজিক ব্যবস্থার এই দিকটি সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের প্রচলিত সামাজিক বন্ধন আগামীতে কীভাবে ফিরিয়ে আনা যাবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। পরস্পরের প্রতি মমত্ববোধই হচ্ছে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার মূল কাঠামো। করোনা আমাদের একেবারেই ব্যক্তি নিষ্ঠ করে দিয়েছে। আমরা ব্যক্তি কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি। এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে কেউ যদি বিপদে পড়ে তাহলে অন্য জন তা দেখেও না দেখার ভান করে। কারো বিপদে কেউ এগিয়ে যেতে চায় না। করোনায় মৃত বাবার লাশ সন্তান রাস্তায় ফেলে গেছে-এমন নজীরও বিরল নয়। অথচ এই ব্যক্তি কেন্দ্রিকতা আমাদের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সমাজ থেকে মানবতাবোধ যেনো উধাও হয়ে গেছে। কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে তাকে পরিবার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হচ্ছে। ইচ্ছে করলেও করোনার ভয়ে কেউ কারো সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারছে না। এটা আমাদের সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। প্রতিটি পরিবারের মধ্যে প্রচণ্ডমানসিক অশান্তি বিরাজ করছে। কেউ ফ্রিভাবে বাইরে যেতে পারছে না। সবাই ঘরের মধ্যে এক ধরনের বন্দি জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে পরস্পরের মধ্যে একটা বিভেদ সৃষ্টি হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের স্বরূপ এখনো আবিস্কৃত হয়নি। এমন কী কীভাবে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ছড়ায় তাও নিশ্চিত নয়। কেউ বলছে হাঁচির মাধ্যমে কেউ বলছে কাশির মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। আবার কেউ বলছে বাতাসের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়ায়। আবার কেউ বলছে পানির মাধ্যমেও এই রোগ ছড়ায়। কেউ বলছেন, শীত কালে এই রোগ বেশি সংক্রমিত হয়। যেহেতু করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণ এবং এর প্রভাব সম্পর্কে মানুষ এখনো পরিপূর্ণভাবে অবহিত নয় তাই ভীতির পরিবেশ ক্রমশ ভারি হচ্ছে। করোনার কারণে মানুষের পারস্পরিক বন্ধন সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে গেছে। সামাজিক সম্প্রীতি সহযোগিতা সব নষ্ট হয়ে যাবার পথে। আমাদের সমাজের দীর্ঘ দিন ধরে যে মূল্যবোধগুলো গড়ে উঠেছিল তা ইতোমধ্যেই বিনষ্ট হবার পথে। মানুষের জীবনী শক্তি কমে গেছে। মানুষ আর আগের মতো উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করতে পারছে না। দীর্ঘ দিন ঘরে বন্দী থাকার ফলে তারা এখন অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। মানুষের সৃজনশীল ক্ষমতা বা শক্তি আগের চেয়ে অনেকটাই কমে গেছে। অনেকের মাঝেই এমন একটি অনুভূতি কাজ করছে যে, বেঁচে থেকে কি লাভ? অনেকেই আছেন যারা করোনা আক্রান্ত হয়ে কোনোভাবে বেঁচে উঠেছেন তারা দেখেছেন জীবন কতটা ঠুনকো। যে মানুষটি এক সময় সম্পদ অর্জনের জন্য লালায়িত ছিল সে এখন সম্পদ অর্জনের মাঝে কোনো উদ্দীপনা খুঁজে পাচ্ছেন না। আল্লাহ্র ক্ষমতার নিকট মানুষ কতটা যে অসহায় এবারের করোনা সংক্রমণ আমাদের সেটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সমাজে বিত্তবান এবং ক্ষমতাবান এমন অনেক ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছেন। এটা দেখে মানুষ তাদের অসহায়ত্ব অনুধাবন করতে পারছে। অনেকেই জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছেন। মানুষের সৃজনশীল ক্ষমতা এবং ভবিষ্যতমুখী চিন্তা-ভাবনা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। মানুষের মূল্যবোধ এবং সৃজনশীল চিন্তায় আঘাত পড়েছে। মানুষের আত্মসম্মান,মর্যাদাবোধে প্রচন্ড আঘাত লেগেছে। কারণ তারা দেখেছে সব কিছুই মূল্যহীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি বা এ ধরনের উন্নত দেশগুলোও এবার প্রত্যক্ষ করেছে যে প্রকৃতির শক্তির নিকট তারা কতটা অসহায়। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো ভালো চিকিৎসার জন্য আমেরিকা গমন করে। আর সেই আমেরিকার মানুষ এবার করোনায় অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের নিকট উন্নত দেশগুলোর অসহায় আত্মসমর্পন আমাদের মতো দেশের মানুষের আত্ম বিশ^াসে প্রচন্ড রকমের ঝাঁকুনি দিয়েছে।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৪:৪৫ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৫ নভেম্বর ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।