| বৃহস্পতিবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২১ | প্রিন্ট | 459 বার পঠিত
জাতির পিতার স্মৃতিধন্য দেশের বীমা খাতটি বিগত ৫০ বছর ছিলো অনেকটাই নিরবে নিভৃতে। ছিল সবচেয়ে অবহেলার পাত্রও। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও জাতির পিতার কন্যা ২০০৯ সালে দেশের দায়িত্বভার গ্রহনের পর থেকেই এ খাতের উন্নয়নে নিয়েছেন নানা উদ্যমী পদক্ষেপ। ফলে ঘুরে দাঁড়াতে থাকে বীমা কোম্পানিগুলো। অর্থনীতির অন্যতম এই খাত নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সেই কার্যক্রম এখন আরো বেগবান।
স্বাধীনতার গৌরবোজ্জ্বল ৫০ বছরে বীমা খাতের উন্নয়ন, অগ্রগতি, অন্তরায় ও সম্ভাবনা নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরাম-এর প্রেসিডেন্ট বিএম ইউসুফ আলী-এর সাথে। নিম্নে সাথে তার কথোপকথনটি তুলে ধরা হলো:
ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৭তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। কিন্তু বীমায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ৮৬তম। ২০২০ সালে জিডিপিতে বীমার অবদান ০.৪০ শতাংশ, যা আগের বছর ছিল ০.৪৯ শতাংশ, অর্থাৎ কমেছে। অথচ প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা ১.২%, ভারত ৪.২৫%, থাইল্যান্ডের ৫.৩% এবং মালয়েশিয়ার ৫.৪%। এমনকি ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন অব পাকিস্তান (এআইপি) রিপোর্ট অনুযায়ি পাকিস্তানও (০.৯২%) আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১০০ ডলার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ি বর্তমানে এটা ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। স্বাধীনতপূর্ব থেকে স্বাধীনতাত্তোর বীমা কেন পিছিয়ে পড়লো?
বিএম ইউসুফ আলী: আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে এটা সত্য, কিন্তু শতাংশের দিক থেকে বীমায় অবদান বাড়েনি এর কারণ হলো- আমাদের দেশের মানুষ বীমা সচেতন নয়। দুই বছর আগেও ১ কোটি ৭০ লাখ লোক বীমার আওতায় ছিল, এখন বরং কমছে। ফলে বীমার অবদানও কমছে। জীবন বীমা সেক্টরের মানের কারণেও আমাদের বীমা সেক্টরে অবদান কমছে। আমরা যদি পলিসির তামাদির দিকে লক্ষ্য করি তামাদির হার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। এর মানে হলো ১’শ জন লোক জীবন বীমা করলে দুই তিন বছর পর ৬০ থেকে ৭০ জন লোক পলিসি বন্ধ করে দেয়, প্রিমিয়াম দেয় না। অথচ জীবন বীমা পলিসি একটি দীর্ঘমেয়াদী পলিসি। দুই তিন বছর পরই এখান থেকে ফল পাওয়ার আশা করা যায় না। তামাদি হওয়ার কারণ হলো আমরা তাদের যথাযথভাবে বীমার কল্যাণ বুঝাতে পারিনি। আমাদের যারা বীমা বিষয়ে মাঠে কাজ করছে তারা মানুষকে বা গ্রাহককে আলোকিত করার পরিবর্তে সাময়িকভাবে প্রলুব্ধ করে। কিন্তু তারা যদি গ্রাহককে বুঝাতে পারতো এটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ। দীর্ঘমেয়াদে এর ফল পাওয়া যাবে এই ধারণা তারা তৈরী করতে পারলে এমনটা হতো না। কিন্তু বীমা আসলে আমাদের দেশের মানুষ তো বুঝেই না; এমনকি আমাদের যারা মাঠকর্মী তারাও বুঝেনা। ফলে গ্রাহক বঞ্চিত হয়, কোম্পানি বঞ্চিত হয়, বীমা খাত বঞ্চিত হয় এবং সামগ্রিকভাবে দেশ বঞ্চিত হওয়ায় বীমার অবদান কমছে। পলিসি তামাদি হওয়ার পেছনেও কমপক্ষে ১৫-২০টি কারণ রয়েছে। এগুলো যদি দূর করা যায় তাহলে আমাদের অবদান বাড়বে। অপরদিকে নন-লাইফে আমাদের যে ব্যবসা ছিল তা কিন্তু বেশি বাড়েনি। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, এই খাতে ব্যবসার প্রবৃদ্ধি হলো ৫ শতাংশ। এটা কখনো ৭ শতাংশ, আবার কখনো সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ পর্যন্ত হচ্ছে, এর বেশি বাড়ছে না। যেখানে আমাদের জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ৭ থেকে ৮ শতাংশ, সেখানে ব্যবসার প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ কোন আশানুরূপ দিক নয়। এখানে অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে। আমাদের বীমা সেক্টরে যারা আছে, সকল বীমা কোম্পানি, উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাকাডেমি, সরকারসহ সকলের কিছু করার সুযোগ আছে। আমি মনে করি আমরা যদি ওই জায়গা চিহ্নিত করতে পারি যে, কোথায় কি করণীয় আছে তাহলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। চিকিৎসকরা কাউকে ভালো করতে প্রথমে রোগটি চিহ্নিত করে, এরপর সে অনুযায়ি ওষুধ দিলে রোগী ভালো হয়। এটাও তেমনিভাবে চিহ্নিত করতে হবে।
ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: বীমাকে এগিয়ে নিতে কোন কোন দিক থেকে এবং কার কার সাপোর্ট দরকার বলে মনে করেন?
বিএম ইউসুফ আলী: বীমাকে এগিয়ে নিতে সরকার তথা সকল মন্ত্রণালয়েরই সহযোগিতা করার সুযোগ আছে। যেমন: স্বাস্থ্যবীমা। টাঙ্গাইলে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ নামে একটি কর্মসূচি চলছে। সেটি ওই জেলার তিন থানায় শুরু হলেও বর্তমানে সকল থানায় বাস্তবায়ন হচ্ছে। একইভাবে বিদেশে যে শ্রমিক যাচ্ছে তাদের জন্য প্রবাসী কল্যাণ বীমা চালু করা হয়েছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই আমাদের প্রায় ২০ লাখ শ্রমিক রয়েছে। এটা যদি ওই মন্ত্রণালয় সহযোগিতা না করতো তাহলে হতো না। এরকমভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ও আবহাওয়া মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়, পর্যটন মন্ত্রণালয়, রেল মন্ত্রণালয়, নৌ-পরিবহন মন্ত্রনালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যদি এগিয়ে আসে, তাহলে সেক্টর ভিত্তিক বীমায় অনেক বড় বড় কাজ হবে।
ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: এটাতো গেলো সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কী ধরনের সাপোর্ট দরকার?
বিএম ইউসুফ আলী: প্রতিষ্ঠানের কথা বললে প্রথমেই আসবে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের ভূমিকার কথা। তাদের বেশ অবদান রয়েছে। যেমন: বাংলাদেশ ব্যাংক। তারা মানি মার্কেটের রেগুলেটর। তারা সহযোগিতা করলে ব্যাংকাসুরেন্স চালু করা সম্ভব। এটা চালু হলেই বীমার পেনিট্রেশন অনেক বেড়ে যাবে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে আইডিআরএ’র কাজ চলছে। এছাড়া ক্যাপিটাল মার্কেটের রিস্ক নিয়ে এসইসি’র সাথে আইডিআরএ’র কাজ চলছে। এগুলো বীমার আওতায় আনা যায় কিনা। এটি বাস্তবায়ন হলে ভবিষ্যতে আমাদের বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হবে। আরেকটি বড় সেক্টর হলো আমাদের মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ)। তাদের নিয়ন্ত্রণে যে এনজিও, এমএফআই আছে তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রাহকদের বীমা করছে এই অথরিটি। অথচ আইনগতভাবে এটা তাদের করার কথা নয়। যদিও তারা একটি আইনের অধীনে এটি পরিচালনা করছে। কিন্তু বীমা আইনে বলা হয়েছে- বীমা লাইসেন্স ছাড়া কেউ বীমা করতে পারবে না। কেউ বীমা করতে চাইলে তাকে বীমা কোম্পানির লাইসেন্স নিতে হবে। কিন্তু এমআরএ’তে যারা বীমা নিচ্ছে করাচ্ছেন তাদের লাইসেন্স নেই। ফলে এ নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরী হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে আইডিআরএ, এমআরএ এবং এফআইডি কাজ করছে। আশা করি ভবিষ্যতে এই ক্ষুদ্র ঋনদান প্রতিষ্ঠানগুলো বীমা কোম্পানির মাধ্যমে বীমার আওতায় আসবে। আমি ধারণা করছি, এমআরএ থেকে যে বীমা করানো হচ্ছে তা দেশের বীমা হিসাবের বাইরে রয়েছে। এটা আগামীতে বীমা কোম্পানির আওতায় আসলে বীমার অবদান অনেক বেড়ে যাবে। আবার সিটি করপোরেশন থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বীমার আওতায় আনা যেতে পারে। এই করপোরেশনগুলোর বিভিন্ন দায়বদ্ধতা থাকে। বিভিন্ন দুর্ঘটনায় তারা ক্ষতিপূরণ হিসেবে বীমাকে কাজে লাগাতে পারে। তাদের গ্রাহকদের তারা বলতে পারে যে আপনার বাড়ি বা মার্কেট বা দোকানের বীমা সুবিধা নিলে ট্যাক্স কিছুটা কম নেয়া হবে। মূলত সকলে মিলে প্রচেষ্টা চালালে বীমা এগিয়ে যেতো। আর আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকপক্ষরা অনেক সময় মনে করে প্রতিষ্ঠানের যে টাকা সেটা বোধহয় তাদের। কিন্তু এগুলো আসলে তাদের সম্পদ নয়। গ্রাহকের আমানত তারা গচ্ছিত রাখছে। নির্দিষ্ট সময় পর তাদেরকে এগুলো বোনাসসহ ফেরত দিতে হবে। তাই এ রকম ধারণা যাদের রয়েছে তাদের এখান থেকে বের হতে হবে। এজন্য আমাদের যে আইন ও নীতিমালা রয়েছে তা বাস্তবায়নের উপর জোর দিতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এগুলো যথাযথভাবে মনিটরিং করার জন্য যে সংখ্যক লোকবল দরকার তা আইডিআরএ’র নেই।
এখানে ৮১টি কোম্পানির জন্য আইডিআরএ’র ৮১ জন লোকও বলা যায় নেই। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকে ৫৭টি ব্যাংক মনিটরিং করার জন্য সাড়ে ৭ হাজার জনবল রয়েছে। তাই আইডিআরএকে শক্তিশালী করতে জনবল দরকার। ইতোমধ্যে আইডিআরএ’র অর্গানোগ্রাম পাশ হয়েছে। এই অর্গানোগ্রামে ১৫৫ জনবল রয়েছে। অনতিবিলম্বে এই জনবল নিয়োগ দেয়া দরকার। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থায় দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব তৈরীতে কিছু ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে মনে করছি। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকে সহকারী পরিচালক হিসেবে ঢুকে নির্বাহী পরিচালক থেকে ডেপুটি গভর্নর পর্যন্ত হয়। বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থায়ও এমন সংস্কার আনলে ভালো হবে। এখানে সহকারী পরিচালক ঢুকে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে করতে এক সময় সদস্য পর্যন্ত যেন হতে পারে।
ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে নিয়ে ইন্স্যুরেন্স ফোরাম প্রতিষ্ঠা হয়েছে তার কতটুক অর্জিত হয়েছে? এবং বীমা খাতের উন্নয়নে আপনার সংগঠন কি কি পদক্ষেপ গ্রহন করেছে?
বিএম ইউসুফ আলী: এখানে একটা বিষয় আগে বলা দরকার। বীমা খাতের উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণে যে আইন ও বিধি রয়েছে তা কিন্তু যারা সিইও (মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা) রয়েছেন তাদের মাধ্যমেই প্রয়োগ হয়। তাই বলা যায়, বীমার উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণে সিইওদের একটা বড় অবদান রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে সেই সিইওরাই নিদারুণ বঞ্চনার শিকার। তাই তাদের স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য এই খাতটিকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়েই বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা সে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধনে নিরলস ও নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে এর সুফল পেতে শুরু করেছে বীমা খাতের গ্রাহক ও আমানতকারীরা। একইসাথে সিইওদের সুরক্ষায় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষসহ বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সাথে যৌথভাবে কাজ করছে আমাদের সংগঠন। এর মাধ্যমে আশা করি ভবিষ্যতে বীমাকে অর্থনীতির একটি প্রধান স্তম্ভ হিসেবে দাঁড় করানোর পাশাপাশি জিডিপিতে আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক হবে।
Posted ১:২৬ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২১
bankbimaarthonity.com | rina sristy