নিজস্ব প্রতিবেদক | মঙ্গলবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২২ | প্রিন্ট | 100 বার পঠিত
আরো একটি স্বপ্ন সত্যি হতে যাচ্ছে আজ। রাজধানী ঢাকার বুকে প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রেন উদ্বোধন হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাত ধরে। ঢাকাবাসীর বহুল কাক্সিক্ষত প্রথম মেট্রোরেল উদ্বোধনের আয়োজনে চলছে উচ্ছ্বাস ও আনন্দ। মেট্রোরেলের কল্যাণে নিত্যদিনের যানজটের খড়গ থেকে মুক্তির প্রত্যাশায় উচ্ছ্বসিত নগরবাসী। গত কয়েক মাস ধরে মেট্রোরেল উদ্বোধনের অপেক্ষা প্রহর গুণছেন নগরবাসী। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণে প্রথম যাত্রীর গর্বিত অংশীদার হওয়ার প্রতীক্ষায় রয়েছেন অনেকে। উদ্বোধনের দিন রাজধানীজুড়ে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্য সদস্যদের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া বিশেষ নিরাপত্তায় পুরো এলাকাজুড়ে টহলরত অবস্থায় থাকবে র্যাবের হেলিকপ্টার।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) মেট্রোরেল-এর প্রতিটি স্টেশনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ‘ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট পুলিশ’ বা ‘এমআরটি পুলিশ’ নামে একটি বিশেষায়িত নতুন পুলিশ ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই ইউনিট গঠনের আগে ডিএমপি অন্তর্বতী সময়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। আগামী ২৯ ডিসেম্বর থেকে স্বাভাবিকভাবে যাত্রী নিয়ে মেট্রোরেল চলাচল করবে। তখন পুলিশ এবং কিছু আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করবে। মেট্রোরেলে পুরুষের পাশাপাশি ছয় নারী চালক নিয়ে যাত্রা করার পরিকল্পনা করেছে। মরিয়ম আফিজা উদ্বোধনী দিনই চালকের আসনে বসার পরিকল্পনা রয়েছে।
ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, বহুল প্রতীক্ষিত মেট্রোরেলের এমআরটি লাইন-৬-এর প্রথম অংশ বেলা ১১ টায় উদ্বোধন করা হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে উত্তরার ১৫ নম্বর সেক্টরের সি-১ ব্লকের খেলার মাঠে। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী ফলকের একটি প্রতিকৃতি উন্মোচন করবেন। এরপর শুরু হবে সুধী সমাবেশ। এতে অতিথিদের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বিপুল জমায়েতের উদ্যোগ নিয়েছে। অনুষ্ঠানে বক্তব্য উপস্থাপনের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী স্মারক ডাকটিকিট ও নোট উন্মোচন করবেন। সমাবেশস্থল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্তরা উত্তর স্টেশনে আসবেন। সেখান থেকে মেট্রোরেল ছাড়বে। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী মূল ফলক পরিদর্শন এবং স্টেশন প্রাঙ্গণে বৃক্ষ রোপণ করবেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী স্থায়ী কার্ড কিনে ভাড়া পরিশোধ করে প্ল্যাটফর্মে যাবেন। সেখানে অপেক্ষমাণ ট্রেন সবুজ পতাকা নেড়ে চলাচলের সংকেত দেবেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী মেট্রোরেলে চড়ে আগারগাঁওয়ে আসবেন। উদ্বোধনী যাত্রায় মেট্রোরেলে প্রায় ২০০ অতিথি থাকতে পারেন বলে জানা গেছে।
এদিকে মেট্রোরেল উদ্বোধন উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে উত্তরা থেকে মতিঝিল এবং ২০২৫ সালে মতিঝিল হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত চলবে মেট্রোরেল। ২৯ ডিসেম্বর হতে উত্তরা থেকে আগারগাঁওয়ে যাতায়াত করতে পারবেন যাত্রীরা। তিনি বলেন, আপাতত উত্তরা স্টেশন থেকে আগারগাঁও স্টেশন পর্যন্ত চলবে মেট্রোরেল। পরবর্তীতে ২৬ মার্চ ২০২৩ থেকে সব স্টেশনেই মেট্রোরেল থামবে। মেট্রোরেলে কোনো হাফ পাস (ভাড়া) নেই। তবে মেট্রোরেল পাস নিলে ১০ শতাংশ ডিসকাউন্ট পাওয়া যাবে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, উত্তরা থেকে কমলাপুরের দূরত্ব ২১.২৬ কিলোমিটার। এই পথের মোট ব্যয় হবে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এই পথের মোট স্টেশন ১৭টি। মেট্রোরেল পুরোদমে চালু হলে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পারাপার করা সম্ভব হবে। তখন মোট ২৪ সেট ট্রেন চলাচল করবে। ট্রেইলার কোচ দু’টিতে ৩৭৪ জন যাত্রী চলাচল করতে পারবে। আসন থাকবে ৪৫টি। অন্যদিকে মাঝের ৬টি কোচে ৩৯০ জন যাত্রী চলাচল করতে পারবে, সেখানে ৫৪টি আসন থাকবে। একটি ট্রেনে সর্বমোট যাত্রী পরিবহন করতে পারবে ২ হাজার ৩০৮ জন। ট্রেন সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে।
মেট্রোলের ভাড়া সম্পর্কে জানা যায়, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া সর্বোচ্চ ১০০ টাকা ও সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা ধার্য করা হয়। প্রথম পর্যায়ে উত্তরা দিয়াবাড়ি (উত্তরা নর্থ স্টেশন) থেকে আগারগাঁও স্টেশন পর্যন্ত ভাড়া ঠিক করা হয়েছে ৬০ টাকা। উত্তরা নর্থ স্টেশন থেকে উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা সাউথ স্টেশনে যেতে সর্বনিম্ন ভাড়া ওই ২০ টাকাই দিতে হবে। সিঙ্গেল জার্নি টিকিট স্টেশনের কাউন্টার থেকে কাটা যায়, চাইলে ‘টিকিট বিক্রয় মেশিন’ থেকে নিজে নিজেও কাজটি সেরে ফেলা যায়। উত্তরা নর্থ থেকে পল্লবী ও মিরপুর-১১ স্টেশনের ভাড়া ৩০ টাকা, মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনের ভাড়া ৪০ টাকা এবং শেওড়াপাড়া স্টেশনের ভাড়া ৫০ টাকা। আর পল্লবী থেকে মিরপুর-১১, মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনের ভাড়া একই, ২০ টাকা। পল্লবী থেকে শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁও স্টেশনের ভাড়া ৩০ টাকা। মেট্রোরেলের দ্বিতীয় ধাপ চালু হলে মিরপুর-১০ নম্বর থেকে ফার্মগেট যেতে গুণতে হবে ৩০ টাকা, আর কারওয়ান বাজার যেতে লাগবে ৪০ টাকা। মিরপুর ১০ স্টেশন থেকে শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাড়া ৫০ টাকা, সচিবালয় ও মতিঝিল স্টেশনে যেতে লাগবে ৬০ টাকা। তবে মিরপুর-১০ থেকে কমলাপুর স্টেশনে যেতে লাগবে ৭০ টাকা ভাড়া। তবে দীর্ঘমেয়াদি পাস নিলে ভাড়ায় ১০ শতাংশ ছাড়ের ব্যবস্থা নিতে মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কোম্পানি ডিএমটিসিএলকে নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিনা ভাড়া এবং বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য ছাড়ের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
মেট্রোরেলে চলাচলের জন্য স্টেশনে লিফট, এস্কেলেটর ও সিঁড়ি দিয়ে ওঠা যাবে। তিনতলা স্টেশন ভবনের দ্বিতীয় তলায় টিকিট কাটার ব্যবস্থা, অফিস ও নানা সরঞ্জাম থাকবে, যাকে বলা হচ্ছে কনকোর্স হল। তিনতলায় থাকবে রেললাইন ও প্ল্যাটফরম। শুধু টিকিটধারী ব্যক্তিরাই ওই তলায় যেতে পারবেন। দুর্ঘটনা এড়াতে রেললাইনের পাশে বেড়া থাকবে। স্টেশনে ট্রেন থামার পর বেড়া ও ট্রেনের দরজা একসঙ্গে খুলে যাবে। আবার নির্দিষ্ট সময় পর তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হবে। মেট্রোরেলের প্রতিটি ট্রেনে ৬টি কোচ রয়েছে। এর মধ্যে দু’ প্রান্তের দু’টি কোচকে বলা হচ্ছে ট্রেইলর কার। এতে চালক থাকবেন। এসব কোচে ৪৮ জন করে যাত্রী বসতে পারবেন। মাঝখানের চারটি কোচ হচ্ছে মোটরকার। এতে বসার ব্যবস্থা আছে ৫৪ জনের। সব মিলিয়ে একটি ট্রেনে বসে যেতে পারবেন ৩০৬ জন। প্রতিটি কোচ সাড়ে ৯ ফুট চওড়া। মাঝখানের প্রশস্ত জায়গায় যাত্রীরা দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করবেন।
মেট্রোরেলে যাতায়াতের জন্য দু’ প্রান্তে নামা যাত্রীদের শাটল বাস সেবা দেবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)। আগারগাঁও ও উত্তরা থেকে দুটি পথে মেট্রোরেলের যাত্রী পরিবহনের জন্য বিআরটিসির ৫০টি বাস চলবে। একটি পথে আগারগাঁও থেকে ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, গুলিস্তান হয়ে মতিঝিল যাবে। একইভাবে মতিঝিল থেকে গুলিস্তান, শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট হয়ে আগারগাঁও পর্যন্ত আসা যাবে। আর দিয়াবাড়ী থেকে উত্তরার হাউস বিল্ডিং বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আসা-যাওয়া করবে বিআরটিসির আরেক পথের বাস।
মেট্রোরেল প্রকল্পের পরিচিতি সম্পর্কে জানা যায়, ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট তথা মেট্রোরেল প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন লাভ করে। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য এমআরটি-৬ নামক ২০.১০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথকে নির্ধারণ করা হয়। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রকল্প সহায়তা হিসেবে জাইকা দেবে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। রুট বাড়ানো ও ব্যয় বাড়ার আগে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল স্থাপনে চলমান এ প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এরপর কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল এগিয়ে নেয়ায় মোট ব্যয় বেড়ে হয় প্রায় ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এমআরটি-৬ এর রুটের ১৭টি স্টেশন হচ্ছে-উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর ১১, মিরপুর ১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয়, মতিঝিল ও কমলাপুর। ট্রেন চালানোর জন্য ঘণ্টায় দরকার হবে ১৩.৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যা নেওয়া হবে জাতীয় গ্রিড থেকে। এর জন্য উত্তরা, পল্লবী, তালতলা, সোনারগাঁ ও বাংলা একাডেমি এলাকায় পাঁচটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র থাকবে।
Posted ৮:২৫ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২২
bankbimaarthonity.com | rina sristy