মো. মাহমুদুল ইসলাম | শনিবার, ২৭ জুন ২০২০ | প্রিন্ট | 651 বার পঠিত
করোনায় অনেকেই মারা গেছে, অনেক মৃত্যু সংবাদ শুনেছি কিন্তু এমন কষ্টের অনুভূতি কেন আগে হয়নি? এর মধ্য দিয়ে বুঝতে পারছি তিনি আমার কতটা আপন ছিলেন। এখন বুঝতে পারছি তিনি আমার রক্তের কেউ না হলেও, এটি বলতে পারি তিনি ছিলেন বীমাগুরু ও অভিভাবক, আমার পরম আত্মার আত্মীয়।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন- ‘জীবন বলে আমি তোমার মরণ তরী বাই’। সেই তরীর যাত্রী হয়ে অজানা-অচেনা এক জগতে পাড়ি দেয়া বীমা শিল্পের অহংকার, একজন সফল ও মেধাবী বীমাবিদ ও ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব জামাল এমএ নাসের শুধু একটি নাম নয়, তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে বীমাশিল্পের উন্নয়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা রেখে গেছেন, যা বাংলাদেশের বীমা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২১ জুন ২০২০ তারিখে ভোর ৩টা ৪৫ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সংবাদটি শুনে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন’ পড়তে খানিকটা সময় লেগেছিল। কোনোভাবেই বিশ্বাস করে যেন মেনে নিতে পাড়ছিলাম না। নিজের অজান্তেই দু’চোখের কোনণ খানিকটা জল এসে ভিড় জমালো।
তখন ভাবছিলাম এই পৃথিবীতে চিরদিন কেউ থাকবে না, এ সত্য আমাদের মেনে নিতেই হবে। কবিগুরু লেখা করেটি লাইন খুব মনে পড়তে লাগলো-
যেদিন প্রথম তুমি, এসেছিলে ভবে।
তুমি মাত্র কেঁদেছিলে, হেসেছিল সবে।
এমন জীবন হবে করিতে গঠন।
মরণে হাসিবে তুমি, কাঁদিবে ভুবন।
আমার শ্রদ্ধেয় বীমাগুরু জামাল এমএ নাসের কবিতার মতোই ভুবন কাঁদিয়ে গেলেন। সবচেয়ে বেশি আমার মনে পড়ছে, করোনায় অফিস বন্ধের কিছুদিন আগে, ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের হেড অফিসে স্যারের সাথে আনন্দময় কিছু মুহূর্তের কথা। আমার জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে ছুটে যেতাম স্যারের কাছে, তিনি কখনই আমাকে নিরাশ করেননি। বরং সবসময় ‘বলতেন যখনি কাওরান বাজার আসবে, তখন আমার অফিস হয়ে যাবে। যে কোনো কিছু জানার জন্য ফোন দিবে’। আমার জানার কৌতূহলী স্বভাব তার ভালো লাগতো।
আমার লেখা ২য় বই “বীমা ব্যবসায় অগ্রগতির কৌশল”-এর কপি যখন স্যারের হাতে তুলে দিয়েছিলাম, তখন তার অফিস রুমে অনেকেই ছিলেন। হাস্যোজ্জ্বলভাবে আমার প্রশংসা করে বলেন ‘আমার ৩৫ বছর কর্মজীবনে অনেক কিছু করেছি কিন্তু এখনো নিজের লেখা একটি বই প্রকাশিত করা হলো না, মাহমুদের তো দুইটা বই প্রকাশিত হলো’ ঐ সময়ে স্যারের রুমে উপস্থিত থাকা পিআরও জনি ভাইকে স্যার বললেন ‘এই বইটি আমাদের সকল সার্ভিসিং অফিসগুলোতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন’। এই সুখকর স্মৃতি যেন কখনই ভুলবার নয়।
জামাল এমএ নাসের স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে ১৯৮৪ সালে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর তিনি ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে অ্যাকচ্যুয়ারিয়াল সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৮৬ সালে। পরবর্তীতে বিভিন্ন বীমা কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। তন্মধ্যে সন্ধানী লাইফ, প্রগ্রেসিভ লাইফ, গোল্ডেন লাইফ এবং সর্বশেষ ন্যাশনাল লাইফে ২০১২ সাল থেকে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
যদিও স্যারের খুব বেশি সান্নিধ্য পাবার সুযোগ আমার হয়নি, তবে যতটুকু দেখেছি তাকে একজন মিষ্টভাষী, সদালাপী, উৎসাহী, গোছানো স্বভাবের, মেধাবী ও দক্ষ বীমা সংগঠক বলেই আমার মনে হয়েছে। আমি বীমা পেশায় প্রায় একযুগ সময় ধরে থাকার ফলে এবং বিশেষ করে বীমা সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সৃষ্ট বাংলাদেশের সর্বপ্রথম বীমা ব্লগ ওয়েবসাইট ইন্স্যুরেন্সবিডিনিউজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে অনেক কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ আমার হয়েছে। আমার দেখা জামাল এমএ নাসের স্যার বাংলাদেশের বীমাশিল্পে অদ্বিতীয়।
জামাল এমএ নাসের স্যার সেমিনারে খুবই চমৎকারভাবে পেপার প্রেজেন্টেশন করতেন। তার অনেক সেমিনারে আমি অংশগ্রহণ করেছি। বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমি ও বিআপিডির অনুষ্ঠানে স্যারের আলোচনা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের মিটিংয়ে দেখেছি সবসময় স্যার যৌক্তিক বিষয় তুলে ধরতেন। আমি অনেক সময়ে স্যারকে প্রশ্ন করতাম, ‘স্যার কীভাবে এতো সুন্দর করে যৌক্তিক বিষয়গুলো তুলে ধরেন’ স্যার সামান্য হেসে উত্তর দিতেন ‘অনেক পড়াশোনা করতে হয়’। আমি যখন স্যারকে বলতাম ‘স্যার কীভাবে আপনার মতো বক্তব্য দিতে পারবো? কীভাবে আপনার মতো করে বীমাশিল্পে অবদান রাখতে পারবো’? স্যার সবসময় হেসে উত্তর দিতেন, একদিন বললেন ‘তুমিও বাংলাদেশের বীমাশিল্পে অবদান রাখতে শুরু করেছ’। আমি বিস্মিত হয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আস্তে করে বললাম, স্যার কীভাবে? স্যার বললেন, ‘তুমি বীমাবিষয়ক বই লিখছ, আবার তুমিই প্রথম বাংলাদেশে ইউটিউবে অগ্রগতি অনলাইন টিভি’র মাধ্যমে বীমাবিষয়ক প্রশিক্ষণ দিচ্ছ’। স্যারের মতো এতো বড় গুণ বীমাব্যক্তিত্বের মুখে আমার প্রচেষ্টার স্বীকৃতিস্বরূপ কথা শুনে শিহরিত হয়ে উঠলাম।
এখন আর এমন করে কে আমার প্রশংসা করবে? কে আমাকে সাহস দিবে? কে আমাকে পরামর্শ দিবে?
বর্তমানে লেখা চলমান বীমাবিষয়ক আমার ৪র্থ বইয়ে স্যারের সাফল্যগাথা অনেক স্মৃতি কথা ও সাক্ষাৎকার লিখা আছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য স্যার আমার এই বইটি দেখে যেতে পারলেন না। স্যার জীবিত থাকলে কতই না খুশি হতেন। আর আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতেন। আমার জন্য কতইনা আনন্দঘন হতো সেই মুহূর্ত, কিন্তু এখন আমাদের দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
করোনার আগে যখন স্যারের সাথে শেষবার আমার দেখা হয়, তখন স্যারকে বলেছিলাম ‘স্যার অগ্রগতি অনলাইন টিভির জন্য আপনার সুদীর্ঘ ইন্স্যুরেন্স ক্যারিয়ার সম্পর্কে ভিডিও সাক্ষাৎকার নিতে চাই’। স্যার আমাকে বলেছিলেন পরে একসময় এসো ভিডিও সাক্ষাৎকার দিবো। সেদিন তিনি জানতে না, সেই দেখাই হবে শেষ দেখা।
বাংলাদেশে বীমাশিল্পের অহংকার, সফল ও মেধাবী বীমাবিদ জামাল এমএ নাসেরের বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে বীমাশিল্পে তার অবদান জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। বীমা জগতে তিনি অনুস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার মৃত্যুতে দেশের বীমাশিল্প অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন, আমিন। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশসহ তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি ৷
-মো. মাহমুদুল ইসলাম
বীমা পরামর্শক ও প্রশিক্ষক
ইমেইলঃ mahmud.adviser@gmail.com
Posted ১১:২২ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২৭ জুন ২০২০
bankbimaarthonity.com | Sajeed