বিবিএনিউজ.নেট | সোমবার, ০৩ জুন ২০১৯ | প্রিন্ট | 669 বার পঠিত
এটিএম-বুথনিরাপত্তা বলয় ভেঙে এটিএম বুথ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশকে আগেই সতর্ক করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা—এফবিআই। পুলিশের পক্ষ থেকে বিষয়টি জানিয়ে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ সংক্রান্ত একটি চিঠিও দেওয়া হয়েছিল। জোরদার করতে বলা হয়েছিল নিজেদের ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কিন্তু বিষয়টিতে গুরুত্ব না দেওয়ায় বিদেশি সাইবার ক্রিমিনালরা ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেদ করে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিল। মাস দুয়েক আগেও অন্য একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে একই পদ্ধতিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয় সাইবার ক্রিমিনালরা।
পুলিশ ও ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, এমন অভিনব ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাইবার ক্রিমিনালরা অর্থ হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, যা সৌভাগ্যক্রমে তাদের চোখে ধরা পড়ে। এটিএম বুথের ভেতর অর্থ পড়ে না থাকলে এবং দ্বিতীয় দিনে বিদেশি নাগরিকরা দীর্ঘ সময় নিয়ে টাকা উত্তোলন না করলে তাদের চোখে বিষয়টি ধরাই পড়তো না। এই চক্রটি সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। সম্প্রতি সারা দুনিয়ায় এই চক্রটি এটিএম বুথ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়। এফবিআইয়ের পক্ষ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই এ বিষয়ে সতর্কতা জারি করা হয়।
শনিবার সন্ধ্যায় খিলগাঁও এলাকার ডাচ বাংলা ব্যাংকের একটি বুথ থেকে অভিনব পদ্ধতিতে জালিয়াতি করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সময় ইউক্রেনের এক নাগরিককে আটক করেন বুথের নিরাপত্তাকর্মী। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই দিন রাতেই পান্থপথের হোটেল ওলিও ড্রিম হ্যাভেনে অভিযান চালিয়ে ইউক্রেনের আরও পাঁচ নাগরিককে আটক করা হয়। তারা হলো—ভ্যালেনটাইন (পাসপোর্ট নম্বর ইওয়াই ০৫১৫৬২), ওলেগ (পাসপোর্ট নম্বর ইএক্স ০৮৯৯৬৩), ডেনিস (পাসপোর্ট নম্বর এফএল ০১৯৮৩৪) নাজেরি (পাসপোর্ট নম্বর এফটি ৫০০৫০১), সার্গি (পাসপোর্ট নম্বর এফএইচ ৪২৪৩৯৪) ও ভোলোবিহাইন (পাসপোর্ট এফটি ৩৭৯৯৮৩)।
এ ঘটনায় রোববার রাতে ডাচ বাংলা ব্যাংকের ইন্টারনাল ডিভিশনের হেড মশিউ রহমান বাদী হয়ে খিলগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। সোমবার (৩ জুন) আসামিদের আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, ‘গ্রেফতারকৃত বিদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে তথ্য জানার চেষ্টা চলছে। কিন্তু ইংরেজি ভাষা ভালো বলতে পারে না। এ জন্য একজন দোভাষী আনা হয়েছে। কিন্তু তারা জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য দিতে অসহযোগিতা করছে। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’
ডিবি পুলিশ সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃতরা সবাই প্রকৃতই সাইবার ক্রিমিনাল। প্রযুক্তি সম্পর্কে তাদের জানাশোনা উচ্চ পর্যায়ের। ৩০ মে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। একসঙ্গে সাত জন এসেছিল। অভিযানের বিষয়টি টের পেয়ে ভিটালি (পাসপোর্ট নম্বর এফই ৮০৪৪৪৮) নামে এক ইউক্রেনিয়ান পালিয়ে গেছে। সে যেন দেশ ছেড়ে চলে যেতে না পারে, সেজন্য দেশের সবকটি ইমিগ্রেশন পয়েন্টে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। তার পাসপোর্ট নম্বরটি ব্লকড করে রাখা হয়েছে।
ডিবির কর্মকর্তারা জানান, গ্রেফতারকৃতরা সবাই আন্তর্জাতিক জালিয়াত চক্রের সদস্য। তারা এবারই প্রথম বাংলাদেশে এসেছে। আগামী ছয় জুন টার্কিশ এয়ারলাইন্সে তাদের ভারতে যাওয়ার কথা ছিল। এজন্য তারা টিকিট কেটেও রেখেছিল। তারা ধারণা করছেন, ভারতে গিয়েও তারা একই পদ্ধতিতে এটিএম বুথ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল।
পুলিশ, ব্যাংক ও ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্সপার্টরা বলছেন, এই চক্রটি এমনভাবে এটিএম বুথ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়, যা ব্যাংকের কোনও কর্মকর্তা কোনোভাবেই জানতে পারেন না। তারা এটিএম কার্ডের মাধ্যমে এমন একটি চিপস স্থাপন করে বুথের ভেতরে ঢোকায়, যেন বুথের ডিজিটাল নিরাপত্তার সবকিছুই তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এ সময় তারা যে কোনও পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করতে পারে। সাধারণভাবে এটিএম কার্ডে অর্থ উত্তোলন করলে বিষয়টি ব্যাংক ও গ্রাহকের কাছে অটোমেটিক একটি বার্তা চলে যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে কারও কাছেই অটোমেটিক বার্তা যায় না। ফলে ব্যাংক কর্মকর্তারাও সহজেই বুথের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বিষযটি ধরতে পারেন না। বুথের অর্থ শেষ হলে হিসাব মেলাতে গিয়ে বিষয়টি ধরা পড়ে।
পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, দুই মাসে বেসরকারি একটি ব্যংকের এটিএম বুথ থেকে দশ লাখেরও বেশি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ওই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের সুনামের কারণে বিষয়টি চেপে গেছে। এমনকী তারা পুলিশের কাছেও লিখিত কোনও অভিযোগ করেনি। এর আগেও বাংলাদেশে এটিএম জালিয়াতি চক্রের আন্তর্জাতিক সদস্য হিসেবে বিদেশি নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু তারা সাধারণত কোনও গ্রাহকের ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের তথ্য চুরি করে ক্লোন কার্ড তৈরি করে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ হাতিয়ে নিতো। কিন্তু এই চক্রটি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে খোদ ব্যাংকের অর্থই হাতিয়ে নিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, অত্যাধুনকি প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন এই চক্রটি গত এক মাসে বিশ্বের প্রায় একশ ত্রিশটি দেশের এটিএম বুথ থেকে জালিয়াতি করে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে এফবিআই তাদের জানিয়েছে। গত কয়েকমাস ধরে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহিদুর রহমান রিপন বলেন, ‘গ্রেফতার হওয়া ইউক্রেনিয়ান নাগরিকরা আন্তর্জাতিক সাইবার ক্রিমিনাল চক্রের সদস্য। সারা দুনিয়ায় তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত বলে মনে হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য জানার চেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক এই চক্রের সঙ্গে দেশীয় কেউ জড়িত কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
ডাচ বাংলা ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, তাদের বুথ থেকে মোট চার লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই জালিয়াত চক্রটি। তারা এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে যেন ব্যাংকের সার্ভারে কোনও তথ্য যায়নি।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যংকের পক্ষ থেকে সব ব্যাংকের ডিজিটাল সিকিউরিটি উন্নীতকরণ বিষয়ে একটি সার্কুলার জারি করে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এই বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘ঈদের সময় ব্যাংক বন্ধ থাকে। এই বন্ধের সময় যেন কোনও দুষ্টচক্র কোনও ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটায়, সে জন্য ব্যাংকগুলোকে সাইবার নিরাপত্তাসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
এদিকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের একটি সূত্র জানায়, ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সবসময়ই সাইবার ক্রিমিনালরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে থাকে। এ জন্য সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেই সবসময়ই উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে ডিজিটাল সিকিউরিটি জোরদার করতে বলা হয়। বিশেষ করে যে কোনও লেনদেনের ক্ষেত্রেই ‘টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন’ ব্যবহার করতে বলা হয়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি গুরুত্ব দিতে চায় না।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কিছুদিন আগে একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি আমাদের জানিয়েছিল। আমরাও বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকগুলোকে জানিয়েছিলাম।’ বিষয়টি নিয়ে তারা কাজ করছেন বলেও তিনি জানান।
Posted ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ০৩ জুন ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed