বিবিএনিউজ.নেট | মঙ্গলবার, ২৫ জুন ২০১৯ | প্রিন্ট | 710 বার পঠিত
বাংকের মন্দ গ্রাহকদের নতুন ঋণ দেয়া যাবে না। তাদের নামে খেলাপি ঋণ থাকলে তা দু’বারের বেশি নবায়ন করা যাবে না। একই সঙ্গে ঋণের সীমা বাড়ানো যাবে না দু’দফার বেশি। ব্যাংকের ভালো গ্রাহকদের চাহিদামতো ঋণ দেয়া যাবে।
বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালা সার্কুলার আকারে জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গ্রাহকদের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকের ঝুঁকি নিরূপণ ও গ্রাহকদের মান বা রেটিং করতেই মূলত এ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। ‘গাইডলাইন্স অন ইন্টারনাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিং সিস্টেম ফর ব্যাংকস বা ব্যাংকের জন্য অভ্যন্তরীণ ঋণ ঝুঁকির মান নিরূপণ’ শীর্ষক এ নীতিমালাটি ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর হবে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নীতিমালাটি অবশ্যই ভালো। তবে এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য ব্যাংকে দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে। গ্রাহকের সক্ষমতা বিবেচনা করে ঋণ দিলে যেমন কোনো গ্রাহক অপ্রয়োজনে ঋণ পাবেন না, তেমনি মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নিয়ে ব্যাংককে ঝুঁকিতে ফেলতে পারবেন না। এটি আরও আগেই করা উচিত ছিল। তাহলে বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঠেকানো যেত। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, এ নীতিমালার শতভাগ প্রয়োগ হলে ব্যাংকিং খাতে জালিয়াতির প্রবণতা কমে যাবে। গ্রাহকের মান সহজে শনাক্ত করতে পারায় ব্যাংক আগে থেকেই বুঝতে পারবে গ্রাহক ঋণ শোধ করতে পারবেন কিনা। সে অনুযায়ী আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে। একই সঙ্গে নীতিমালা ভঙ্গ করে বা ভুল তথ্য দিয়ে গ্রাহকের অবস্থান ভালো দেখালে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন এ নীতিমালা কার্যকর হলে ব্যাংকগুলোর ঋণ ঝুঁকির প্রবণতা কমবে, একই সঙ্গে কমে যাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এতে ব্যাংকগুলোতে তারল্য প্রবাহ বেড়ে তহবিল সংকট নিরসন হবে।
ব্যাংকগুলোর ঋণ ঝুঁকি নিরূপণের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০০৫ সালে প্রথম একটি নীতিমালা জারি করে। ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি নিরূপণে এ নীতিমালা কার্যকর হচ্ছিল না। এ কারণে গত বছরের অক্টোবরে আরও একটি নীতিমালা জারি করা হয়। এটি ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এতেও কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি খুঁজে পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
পরে এটিকে আরও পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করে নতুন নীতিমালাটি জারি করা হয়। এটি ১ অক্টোবর থেকে পুরোপুরি কার্যকর হবে। তখন থেকে বর্তমানে চালু ঋণ ঝুঁকির নীতিমালাটি বাতিল হয়ে যাবে। নতুন নীতিমালাটি আগের চেয়ে আরও কঠোর করা হয়েছে। এতে গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা অনুযায়ী খাতভিত্তিক রেটিং করা হয়েছে। এ রেটিংয়ের ওপর নির্ভর করবে গ্রাহকদের ঋণপ্রাপ্তির সক্ষমতা। আগের নীতিমালায় এসব বিষয় ছিল না। যে কারণে ব্যাংকিং খাতে বড় বড় ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে।
একই সঙ্গে নতুন নীতিমালাটি ব্যাংকগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোকে সব ধরনের অবকাঠামোগত প্রস্তুতি ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে।
সার্কুলারে বলা হয়, নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যোগ্যতা অনুযায়ী ঋণ সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে। এতে প্রধান ৪টি খাতের আওতায় ২০টি উপখাত রয়েছে। প্রতিটি উপখাতের বৈশিষ্ট্য, ঝুঁকি, আর্থিক সক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বিবেচনায় নিয়ে ২০টি আলাদা মডেল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
নীতিমালায় শিল্প খাতের আওতায় ১৪টি উপখাত রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- তৈরি পোশাক, বস্ত্র, খাদ্য, ওষুধ, রাসায়নিক, সার, সিমেন্ট, সিরামিক, জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ ভাঙা, জুট মিলস, স্টিল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অন্যান্য শিল্প। দ্বিতীয় খাতে আছে ব্যবসা ও বাণিজ্য, তৃতীয় খাতে কৃষিভিক্তিক ও প্রসেসিং শিল্প এবং চতুর্থ খাতে রয়েছে গৃহায়ন ও নির্মাণ, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, টেলিযোগাযোগ ও অন্যান্য সেবা খাত। এসব খাতের গ্রাহকদের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে নীতিমালায় রেটিংয়ের মান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট মডেল তৈরি করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ নীতিমালার আওতা থেকে ভোক্তাঋণ, ৫০ লাখ টাকার কম ক্ষুদ্র শিল্পঋণ, স্বল্প মেয়াদি কৃষিঋণ, ক্ষুদ্রঋণ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বীমা কোম্পানিকে দেয়া ঋণের বিষয়টি অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এসব ঋণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের এর আওতায় কোনো রেটিং করতে হবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, এ নীতিমালাটি শতভাগ বাস্তবায়ন হলে কোনো গ্রাহক জালিয়াতি করে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নিতে পারবেন না। একই সঙ্গে এটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো কর্মকর্তার কি দায়িত্ব আছে সেটিও নিরূপণ করা যাবে। ফলে ব্যাংকিং খাতে জাল-জালিয়াতির প্রবণতা কমবে।
নীতিমালায় রেটিং করার ক্ষেত্রে গ্রাহককে কিভাবে নম্বর দিতে হবে তাও সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে গ্রাহক যে পরিমাণ ঋণের জন্য আবেদন করেছেন তার সক্ষমতার ওপর ৬০ নম্বর এবং প্রতিষ্ঠানের গুণগত মানের সক্ষমতার ওপর দিতে হবে ৪০ নম্বর। ঋণের পরিমাণের সক্ষমতার ৬০ নম্বরের মধ্যে মোট নেয়া ঋণ ও প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সক্ষমতায় ১০, চলতি দায় ও তরল সম্পদে ১০, মুনাফা অর্জনের সক্ষমতায় ১০, সুদ পরিশোধের সক্ষমতা ও নগদ অর্থের প্রবাহে ১৫, প্রতিষ্ঠানের পরিচালন দক্ষতায় ১০ এবং ব্যবসার মানের ওপর ৫ নম্বর দিতে হবে। প্রতিষ্ঠানের গুণগতমানের সক্ষমতায় ৪০ নম্বরের মধ্যে কর্ম দক্ষতার আচরণে ১০, ব্যবসা ও সংশ্লিষ্ট খাতের ঝুঁকিতে ৭, ব্যবস্থাপনার ঝুঁকিতে ৭, ঋণের জামানত ঝুঁকিতে ১১, ব্যবসায়িক সম্পর্ক ঝুঁকিতে ৩, ঋণের শর্ত পরিপালনের ঝুঁকিতে ২ নম্বর দিতে হবে। এসব বিষয় বিবেচনা করে গ্রাহকের সব খাতে নম্বর দিয়ে সেগুলো যোগ করে প্রাপ্ত নাম্বারের ভিত্তিতে গ্রাহকের রেটিং করতে হবে।
ওইসব খাত ও উপখাতের ওপর প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে গ্রাহকদের ৪টি ভাগে ভাগ করে মূল্যায়ন করতে হবে। এর মধ্যে কোনো গ্রাহক যদি ৮০ নম্বরের উপরে পান তাহলে তিনি এক্সিলেন্ট বা উত্তম গ্রাহক হিসেবে বিবেচিত হবেন। কোনো গ্রাহক ৭০-এর উপরে এবং ৮০-এর নিচে পেলে তিনি গুড বা ভালো গ্রাহক হিসেবে বিবেচিত হবেন। কোনো গ্রাহক ৬০-এর বেশি বা ৭০-এর কম পেলে তিনি মার্জিনাল বা প্রান্তিক গ্রাহক হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং কোনো গ্রাহক ৬০ নম্বরের কম পেলে তিনি আনএকসেপ্টেবল বা অগ্রহণযোগ্য গ্রাহক হিসেবে ব্যাংকের কাছে বিবেচিত হবেন।
উত্তম গ্রাহকদের সবুজ রঙের সংকেত দিয়ে শনাক্ত করতে হবে। তারা ব্যাংক থেকে চাহিদামতো ঋণ নিতে পারবেন। তাদের ঋণখেলাপি হলে তা নবায়ন বা তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঋণের সীমা বাড়ানো যাবে।
ভালো গ্রাহকদের নীল রঙের সংকেত দিয়ে শনাক্ত করতে হবে। তাদের নতুন ঋণ দেয়া যাবে। তবে ঋণের পরিমাণের ওপর ব্যাংককে বিশ্লেষণ বাড়াতে হবে। তাদের ঋণখেলাপি হলে নবায়ন ও আবেদন সাপেক্ষে ঋণ সীমা বাড়ানো যাবে। তবে সব ক্ষেত্রেই ব্যাংকের বিশ্লেষণী ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে।
প্রান্তিক গ্রাহকদের হলুদ রঙের সংকেত দিয়ে শনাক্ত করতে হবে। তাদের নতুন ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। তাদের খেলাপি ঋণ নবায়ন ও ঋণ সীমা বাড়ানোর ক্ষেত্রেও বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে ব্যাংকগুলোকে। কেননা তারা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার পরিচয় দিয়েছেন বলে প্রান্তিক পর্যায়ে চলে এসেছে। সতর্ক না হলে এ অবস্থা থেকে রেড বা লাল জোনে চলে যেতে পারেন। তখন ব্যাংকও তাদের ব্যাপারে পুরোপুরি ঝুঁকিতে চলে যাবে।
ব্যাংকের কাছে অগ্রহণযোগ্য গ্রাহকদের রেড বা লাল জোন (বিপজ্জনক গ্রাহক) হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। তাদের কোনো ক্রমেই নতুন ঋণ দেয়া যাবে না। এদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের বিষয়টি শতভাগ ঝুঁকিতে রয়েছে। এ কারণে তাদের নামে থাকা খেলাপি ঋণ কোনো ক্রমেই দু’বারের বেশি নবায়ন করা যাবে না। তাদের ঋণ সীমাও দু’দফার বেশি বাড়ানো যাবে না। ব্যাংককে চেষ্টা করতে হবে ঋণটি শতভাগ নগদ আদায় করতে বা সহজে নগদায়নযোগ্য- এমন কোনো শতভাগ জামানত নিয়ে ঋণের আদায় নিশ্চিত করতে। এটি সম্ভব হলে গ্রাহক ঋণখেলাপির দুর্নাম থেকে বেরিয়ে যাবেন। তখন তাদের ঋণ দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারবে ব্যাংক। তবে এক্ষেত্রে ব্যাংকের বিশ্লেষণী ক্ষমতা বেশি মাত্রায় প্রয়োগ ও সতর্ক হতে হবে।
Posted ৩:৪৩ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৫ জুন ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed