নিজস্ব প্রতিবেদক | মঙ্গলবার, ০৬ অক্টোবর ২০২০ | প্রিন্ট | 395 বার পঠিত
নিজস্ব প্রতিবেদক : অনেক বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংককমিশন/চার্জ বাড়িয়েছে । কমিশন/চার্জ বাড়ায় আমদানি-রফতানি ব্যয়ও বেড়েছে। করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট মন্দায় বাড়তি এ খরচে বিপাকে পড়েছেন উদ্যোক্তা -ব্যবসায়ীরা।
এর মধ্যে বেসরকারি সাউথইস্ট ব্যাংক আগে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে কমিশন নিত ১০ থেকে ২০ পয়সা। এখন তা দুই থেকে তিনগুণ বাড়িয়েছে। এলসি খুলতে তারা এখন কমিশন নিচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ পয়সা। ব্যাংক গ্যারান্টার ও বিভিন্ন লোনের ক্ষেত্রে চার্জও দ্বিগুণ বাড়িয়ে এক টাকার বেশি আদায় করা হচ্ছে।
উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আগে ব্যাংকগুলো এলসির কমিশন সর্বোচ্চ ৫ থেকে ১০ পয়সা নিত। এখন ৪০ থেকে ৫০ পয়সা দাবি করছে। অনেক ব্যাংক এক থেকে দেড় টাকা পর্যন্ত কমিশন নির্ধারণ করে দিয়েছে। এতে আমদানি-রফতানিতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। চলমান করোনা পরিস্থিতিতে যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো তা থেকে উত্তরণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে তারা। ব্যাংকগুলো যেন অহেতুক বাড়তি কমিশন আদায় না করে, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশনা দেবে— এমনটা প্রত্যাশা করছেন উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা।
কমিশন/চার্জ বাড়ানোর বিষয়টি স্বীকার করে সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম কামাল হোসেন বলেন, ‘নরমালি শিডিউল অব চার্জ আমাদের কম। আমাদের এলসি চার্জ ছিল ৪০ পয়সা। চার্জ নামতে নামতে ৫ থেকে ১০ পয়সায় এসে ঠেকেছে। এখন ইন্টারেস্ট রেট কমানো হয়েছে। ব্যাংকগুলোর তো এখন আর কোনো ইনকাম নেই। যেহেতু ঋণের সুদ ৯ শতাংশে আনতে হয়েছে, আমাদের আয়ও কমে গেছে। ফলে শিডিউল অব চার্জ বাড়ানো ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই।’
‘শুধু আমরা নই, অনেক ব্যাংকই তাদের চার্জ, কমিশন, গ্যারান্টি কমিশন ও এলসি কমিশনে কিছুটা পরিবর্তন আনছে, টিকে থাকার জন্য। কারণ, আমাদের ১২ থেকে ১৩ শতাংশ ইন্টারেস্ট রেট থেকে সরাসরি ৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, এখন ব্যবসায় মন্দাভাব বিরাজ করছে। টাকা দিয়ে টাকা উঠানো যাচ্ছে না। ঋণ কমে গেছে। সরকার ঘোষিত বিশেষ প্যাকেজের যে ঋণছাড়া, বেসরকারি খাতে তেমন আসছে না। সরকার ব্যবসায়ীদের স্বার্থে সুদের হার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলেছে। সরকারের ইচ্ছায় ব্যাংকগুলো সেটা কমিয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমে গেছে। আগে যেখানে মাসে মুনাফা আসত ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা, এখন তা নেমে এসেছে ১৮ থেকে ২০ কোটি টাকায়। অর্থাৎ ব্যাংকের মূল আয় কমে গেছে। এখন টিকে থাকার জন্য সামান্য কমিশন/চার্জ বাড়ানো হচ্ছে।
পৃথিবীর কোনো দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার বেঁধে দেয়া হয়নি— জানিয়ে বেসরকারি ব্যাংকের এ প্রধান নির্বাহী বলেন, আমাদের সুদহার বেঁধে দেয়া হয়েছে। তারপরও ঋণ দিয়ে তা আদায় করা অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই অনেক ব্যাংক সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করছে। এটা তো অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। বাড়তি চার্জ আদায় প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অহেতুক চার্জ/কমিশন নেয়া কাম্য নয়। সুদহার কমিয়ে যদি চার্জ বাড়িয়ে দেয়— এটা তাদের একধরনের চালাকি। চার্জ/কমিশনের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে। তবে কত টাকা চার্জ নিতে পারবে, এলসির কমিশন, কোনো বিষয়ে যদি কাউকে ঋণের গ্যারান্টি দেয়া হয় তাহলে চার্জ কত হবে— নির্ধারিত কোনো রেট নেই। এখন যেসব ব্যাংক অহেতুক চার্জ বা কমিশন বাড়াচ্ছে তাদের বিষয়ে ব্যবসায়ীরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই পারেন।
তিনি বলেন, সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো কিছু চার্জ নেবে, সেটা ঠিক আছে। অহেতুক বেশি চার্জ নেয়ার কোনো যুক্তি নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করা, বর্তমান পরিস্থিতিতে (করোনা পরিস্থিতি) যেন ব্যবসায়ীদের ওপর বাড়তি চাপ প্রয়োগ না করা হয়।
সুদহার কমিয়ে বাড়তি চার্জ আদায় প্রসঙ্গে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল সামাদ জাগো নিউজকে বলেন, বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় যেসব বাধা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম ঋণের উচ্চ সুদহার। ঋণের সুদহার যত কম হবে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার সক্ষমতা তত বাড়বে। দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থাও আমাদের দেখতে হবে।
‘দেশের সার্বিক অর্থনীতি বিবেচনায় ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ করার নির্দেশনা দেয়া হয়। এছাড়া করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় সরকার বিশেষ প্যাকেজের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার ঘোষণা দেয়। এসব উদ্যোগ ভালো। তবে ঋণের সুদহার কমিয়ে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি যেন না হয় সে বিষয়েও নজর দিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে সুদ কমিয়ে বাড়তি কমিশন/চার্জ নেয়া হচ্ছে; এটা বন্ধ করতে হবে। কারণ একদিকে সুদহার কমিয়ে যদি চার্জ বাড়িয়ে দেয়া হয়, তাহলে ঠিক হবে না। একই সঙ্গে স্বাভাবিক ঋণপ্রবাহ ঠিক রাখার পাশাপাশি কোভিডের ক্ষতি মোকাবিলায় যেসব প্রণোদনার প্যাকেজ রয়েছে তার সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। এটি হলে মহামারির যে ক্ষতি, তা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারব আমরা’— বলেন পোশাক খাতের এ উদ্যোক্তা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, ইন্টারেস্ট রেট কমে যাওয়ার কারণে আয় কমে গেছে সরাসরি এটা বলা ঠিক না। কারণ তারা ডিপোজিট রেটও অনেক কমিয়েছে। আর ইন্টারেস্ট রেট কমেছে বলে ব্যাংক হঠাৎ সেবার চার্জ বাড়িয়ে দেবে এটা ঠিক নয়।
ইন্টারেস্ট রেট কমে যাওয়ার কারণে এখন ইনকাম অনেক কমে গেছে এই দাবি অযৌক্তিক জানিয়ে তিনি বলেন, লোন যদি ১৬ শতাংশে দেওয়া হয়; আর সেই লোন যদি আদায় না হয়, তাহলেই সেটা ‘লস’। ৯ শতাংশ হারে লোন দিয়ে যদি আদায় করা হয় তাহলে ক্ষতি কী? ব্যাংকগুলো যে বলছে তাদের আয় কমে গেছে এই কথার সঙ্গে আমি একমত না। বাস্তবতা হচ্ছে দেখে শুনে যাচাই-বাছাই করে সঠিক জায়গায় ঋণ দিতে হবে। ঋণের জামানত নিতে হবে। ঋণ যেন সঠিক সময় আদায় হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। সুদহার কমে গেছে এখন চার্জ বাড়িয়ে দিতে হবে এ ধরনের দুষ্টচিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
শুধু মুনাফা নয় সেবার মান বাড়াতে হবে জানিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ মুখপাত্র বলেন, ব্যাংকগুলো যে ব্যবসা করছে এখানে তাদের নিজস্ব কয় টাকা আছে? অধিকাংশ টাকাই সাধারণ মানুষের আমানতের অর্থ। ব্যাংক মানেই সেবা দেওয়া। এখানে শত শত কোটি টাকা মুনাফা করতে হবে এটা কেন? এই মনোভাব বাদ দিতে হবে সেবার মান বাড়াতে হবে।
উল্লেখ্য, ব্যবসায়ীদের দাবি ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এপ্রিল মাস থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া অন্যান্য সব ধরনের ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বেঁধে দেয় নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। ফলে সব ব্যাংক বাধ্য হয়ে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনে।
Posted ২:১৭ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৬ অক্টোবর ২০২০
bankbimaarthonity.com | saed khan