নাসির আহমাদ রাসেল | মঙ্গলবার, ১৭ মে ২০২২ | প্রিন্ট | 380 বার পঠিত
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: আপনার নেতৃত্বে ইতিমধ্যে ইসলামি বীমা বিধিমালা’র একটি খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। আইডিআরএ এটিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে রেখেছে। এই বিধিমালায় ইসলামি বীমা ব্যবস্থার কোন বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে?
অধ্যাপক মাও. এবিএম মাছুম বিল্লাহ: ইসলামি বীমা বিধিমালার খসড়ায় ইসলামি শরীয়াহ পরিপালনের উপরেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। শরীয়াহর আলোকে বিনিয়োগ, গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং বিনিয়োগ যাতে শরীয়াহ পরিপন্থি না হয় সেসব বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এক কথায় ইসলামি বীমা বিধিমালায় শরীয়াহর উপরে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। শরীয়াহ বলতে কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াস। শরীয়াহ অডিট, শরীয়াহ কাউন্সিলের তদারকির ক্ষমতা বেশি দেয়া হয়েছে। কোম্পানি সঠিকভাবে বিনিয়োগ করেছে কী না তা দেখার জন্য। শরীয়াহ বিষয়ে বিজ্ঞ অথবা যাদের শরীয়াহ ও বীমা সম্পর্কে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের মধ্য থেকে আইডিআরএ যাতে এক বা একাধিক পূর্ণকালীন বা খন্ডকালীন শরীয়াহ পরামর্শক বা উপদেষ্টা নিয়োগ দেয় খসড়া বিধিমালায় সেই বিষয়টি এসেছে।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইসলামি বীমাকে জনপ্রিয় এবং শরীয়াহর আলোকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণযোগ্য করতে এই বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কতটা জরুরি বলে মনে করেন?
অধ্যাপক মাও. এবিএম মাছুম বিল্লাহ: ইসলামি বীমাকে জনপ্রিয় এবং শরীয়াহর আলোকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণযোগ্য করতে এই বিধিমালা প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের জনগণ ইসলাম প্রিয়। ইসলাম ভাবাপন্ন। কোম্পানিগুলো বীমার জন্য মানুষের কাছ থেকে যে টাকা আনবে, তা শরীয়াহ মোতাবেক হতে হবে। কিন্তু আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে শরীয়াহ অনুসরণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রচলিত আইনের কাঠামো সেটি সুদভিত্তিক। কোম্পানির আমানতের ৩০ শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখতে হবে, যেটি সুদভিত্তিক। এজন্য ইসলামি বীমা বিধিমালা জরুরি। ইসলামি (তাকাফুল) বীমা কোম্পানি করতে হলে পারস্পরিক সহযোগিতা, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের নীতিমালার ভিত্তিতে পরিচালিত বীমা স্কীম থাকতে হবে। যা রিবা (সুদ), ঘারার (অসচ্ছতা) ও মাইসির (জুয়া) এর উপাদান মুক্ত হতে হবে। শরীয়াহর কথা আমরা যতই বলি না কেন, বীমার জন্য প্রচলিত আইন বা সিস্টেমটি তো সুদভিত্তিক।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ইসলামি বীমা পদ্ধতি বাস্তবায়নে শরীয়াহ কাউন্সিলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সে লক্ষ্যে প্রত্যেক বীমা কোম্পানি স্বতন্ত্র শরীয়াহ কাউন্সিল গঠন করেছে। গড়ে তোলা হয়েছে সেন্ট্রাল শরীয়াহ কাউন্সিল ফর ইসলামিক ইন্স্যুরেন্স অব বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সেন্ট্রাল শরীয়াহ কাউন্সিলের নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় রয়েছেন আপনি। কোন প্রেক্ষাপটে, কী লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এর যাত্রা?
অধ্যাপক মাও. এবিএম মাছুম বিল্লাহ: ১৯৮৩ সালে ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের সাফল্যজনক যাত্রার পর ইসলামি বীমার প্রয়োজনীয়তা অনুভব হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সাল থেকে বাংলাদেশে ইসলামি বীমার কার্যক্রম শুরু হয়। প্রত্যেকটি ইসলামি বীমা কোম্পানি ও বীমা কোম্পানির ইসলামি উইংয়ের একটি করে শরীয়াহ কাউন্সিল/বোর্ড রয়েছে। এসব শরীয়াহ কাউন্সিলের কার্যক্রম একই নীতিমালার আলোকে পরিচালনার জন্য এবং ইসলামি বীমার উন্নয়নে একটি কেন্দ্রীয় শরীয়াহ কাউন্সিল গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই প্রেক্ষাপটে ২০০২ সালের ২০ জুন আমাদের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের তৎকালীন খতিব আল্লামা ওবায়দুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সেন্ট্রাল শরীয়াহ কাউন্সিল ফর ইসলামিক ইন্স্যুরেন্স অব বাংলাদেশ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ইসলামি বীমা পদ্ধতি বাস্তবায়নে যথাযথ ভূমিকা পালনে শরীয়াহ কাউন্সিল বা সেন্ট্রাল শরীয়াহ কাউন্সিল কতটা সুযোগ পাচ্ছে?
অধ্যাপক মাও. এবিএম মাছুম বিল্লাহ: বীমা আইনে ইসলাম শব্দটি যতটুকু এসেছে এটি শরীয়াহ কাউন্সিলের অবদান। ২০০৩ সাল থেকে তাকাফুল অ্যাক্টের প্রস্তাবনা দাখিলসহ এটি কার্যকরের দাবি নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
এছাড়া কোম্পানিগুলোকে শরীয়াহসংক্রান্ত যেসব পরামর্শ দেয়া হয়, তাদের ইচ্ছা থাকলেও আইনি বাধ্য-বাধকতার কারণে অনেক কিছুই গ্রহণ বা বাস্তবায়ন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ইসলামি বীমা বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদানে শরীয়াহ কাউন্সিলের কী উদ্যোগ রয়েছে?
অধ্যাপক মাও. এবিএম মাছুম বিল্লাহ: শরীয়াহ সংক্রান্ত বিষয়ে কাউন্সিল ইসলামি বীমা কোম্পানি /প্রকল্পসমূহে জড়িত ব্যক্তি ও উদ্যোক্তাকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করে আসছে।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: তাকাফুল বা ইসলামি জীবন বীমা ব্যবস্থা সম্পর্কে সংক্ষেপে আমাদেরকে বলুন।
অধ্যাপক মাও. এবিএম মাছুম বিল্লাহ: তাকাফুল বা ইসলামি জীবন বীমা হচ্ছে পারস্পরিক সহযোগিতা, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের নীতিমালার ভিত্তিতে পরিচালিত বীমা স্কীম, যেখানে কোনো ধরনের রিবা (সুদ), ঘারার (অসচ্ছতা) ও মাইসির (জুয়া) থাকতে পারবে না। ইসলামি জীবন বীমার বিনিয়োগ হতে হবে শরীয়াহসম্মত অর্থাৎ কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসে বর্ণিত নীতিমালা ও বিধিনিষেধের আওতাধীন এবং রীতিনীতির মাধ্যমে পরিচালিত। গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হবে। এছাড়া অংশগ্রহণকারীর তাকাফুল তহবিল (পার্টিসিপেন্টস তাকাফুল ফান্ড-পিটিএফ) বা তাবাররু তহবিল থাকতে হবে। যেটি মূলত একটি পৃথক যৌথ ঝুঁকি তহবিল, যেখানে অংশগ্রহণকারীদের ঝুঁকি সম্পর্কিত চাঁদাসমূহ প্রদান করা হবে এবং যেখান হতে ঝুঁকি সম্পর্কিত সুবিধাসমূহ পরিশোধ করা হবে। ইসলামি বীমার ক্ষেত্রে এই ফান্ড অবশ্যই থাকতে হবে।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ইসলামি বীমা ব্যবস্থা কী ভূমিকা রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
অধ্যাপক মাও. এবিএম মাছুম বিল্লাহ: বর্তমান সময় ইসলামি বীমার জন্য স্বর্ণালী সময়। একের পর এক ব্যাংক ইসলামি ব্যাংকিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বেশিরভাগ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ইসলামি উইং করেছে। ইসলামি কোম্পানিগুলো লাভজনক জায়গায় পৌঁছে পুঁজিবাজারেই হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। সুতরাং ইসলামি ইন্স্যুরেন্স পদ্ধতির উন্নতি হলে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এ খাত ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সম্ভব হবে।
ইসলামি বীমা কোম্পানিগুলো ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে সেখানকার আর্ত-মানবতার সেবায় ব্যয় করার সুযোগ রয়েছে। জাকাতের অর্থও এখানে যুক্ত করার সুযোগ রয়েছে।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশে ইসলামি জীবন বীমা পদ্ধতি বাস্তবায়নে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
অধ্যাপক মাও. এবিএম মাছুম বিল্লাহ: বাংলাদেশে ইসলামি জীবন বীমা পদ্ধতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ইসলামি বীমা আইন বা বিধিমালা না থাকাটাই সবচেয়ে বড় বাধা। আইন হলে অন্তত ৯৯ শতাংশ বাঁধা দূর হবে।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে ব্যাপকহারে শরীয়াহভিত্তিক বীমা বিপণনে কোম্পানিগুলোর কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে মনে করেন?
অধ্যাপক মাও. এবিএম মাছুম বিল্লাহ: ঘরে ঘরে ব্যাপকহারে শরীয়াহভিত্তিক বীমা বিপণন করতে হলে কোম্পানিগুলোর প্রচার-প্রচারণা যথেষ্ঠ থাকতে হবে। আমানতদারিতার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। দ্রুত বীমা দাবি নিষ্পত্তি করতে হবে। সন্তোষজনক ও মানসম্পন্ন গ্রাহক সেবা দিতে হবে। যদিও অনেক কোম্পানিই এসব ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ইসলামি বীমাকে জনপ্রিয় করতে আইডিআরএ’র ভূমিকাকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
অধ্যাপক মাও. এবিএম মাছুম বিল্লাহ: ইসলামি বীমা পদ্ধতি বাস্তবায়নের বিষয়ে আইডিআরএ’র সার্বিক উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। বিশেষ করে বর্তমান চেয়ারম্যানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
Posted ৭:১০ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১৭ মে ২০২২
bankbimaarthonity.com | rina sristy