| বুধবার, ০১ জুন ২০২২ | প্রিন্ট | 335 বার পঠিত
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ইসলামি বীমার সমস্যা-সম্ভাবনা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ইসলামি বীমার ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি ইসলামি বীমা বিশেষজ্ঞ, বীমা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, মুখপাত্র ও বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাসির আহমাদ রাসেল। পাঠকদের জন্য এসব সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি।
প্রশ্ন: ইসলামি বীমা বিধিমালা প্রণয়নের জন্য ইতিমধ্যে কাজ শুরু করছে আইডিআরএ। বিধিমালার একটি খসড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাই।
ডা. কিশোর বিশ্বাস: আইডিআরএ’র বিধিমালা প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে আমি আন্তরিকভাবে সাধুবাদ জানাই। এই ইসলামি বীমা বিধিমালা প্রয়োগ হলে বীমা শিল্প একটি অন্য উচ্চতা পাবে বলে আমার বিশ^াস।
প্রশ্ন: তাকাফুল বা ইসলামি জীবন বীমা ব্যবস্থা সম্পর্কে সংক্ষেপে আমাদেরকে বলুন।
ডা. কিশোর বিশ্বাস: ইসলামি জীবন বীমার অপর নাম তাকাফুল জীবন বীমা। যা ইসলামি শরীয়াহভিত্তিক পরিচালিত। মুসলিম প্রধান দেশে ইসলামি জীবন বীমা শিল্প একটি অন্য মাত্রা যোগ করেছে। কেননা ইসলামি জীবন বীমা প্রচলনের মাধ্যমে প্রচলিত বীমা ব্যবস্থায় শরীয়াহ পরিপন্থী বিষয়গুলোকে পরিহার করা সম্ভব হয়েছে। প্রচলিত বীমা ব্যবস্থায় মানুষ প্রধানত তিনটি বিষয়ে সন্ধিহান থাকে যা হলো অনিশ্চয়তা, জুয়া এবং সুদ। যেহেতু এই তিনটি বিষয় দূর করার মাধ্যমে শরিয়াহ অনুসারে ইসলামি বীমার সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়, তাই ইসলামি জীবন বীমার গ্রহণযোগ্যতা মানুষের কাছে বেশি। যে কারণে গ্রাহক নিশ্চিন্তে ইসলামি বীমা ক্রয় করে।
প্রশ্ন: প্রচলিত বীমা এবং ইসলামি বীমার মধ্যে পার্থক্য কী ?
ডা. কিশোর বিশ্বাস: প্রচলিত বীমা ব্যবস্থায় প্রধানত তিনটি শরীয়াহ পরিপন্থি বিষয় রয়েছে যেমন-অনিশ্চয়তা, জুয়া এবং সুদ। ইসলামি বীমা অনিশ্চয়তা, জুয়া এবং সুদের সাথে সম্পর্কিত নয়। ইসলামি বীমা এই তিন বিষয়কে দূর করার মাধ্যমে বীমার কার্যক্রম শরিয়াহ অনুসারে পরিচালনা করে। প্রচলিত বীমা পলিসিতে অস্বচ্ছতা থাকে, কিন্তু ইসলামি বীমার সর্বত্র স্বচ্ছতা থাকতে হয়। প্রচলিত বীমা ব্যবস্থায় শরীয়াহ পালনের কোন প্রতিশ্রুতি নেই। শরিয়তের আনুশাসনের ভিত্তিতে ইসলামি বীমা পরিচালনা করা হয়। ইসলামি বীমা মুদারাবা নীতিতে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। সদস্যগণ কোম্পানির লাভ লোকসানের অংশীদার হয়। কিন্তু প্রচলিত বীমায় অংশীদারিত্বের কোন সুযোগ নেই। এই ক্ষেত্রে মালিকগণই লাভ ভোগ করে এবং লোকসান গ্রহণ করে।
প্রশ্ন: তাকাফুল বা ইসলামি জীবন বীমার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমাদের বলুন।
ডা. কিশোর বিশ্বাস: ইসলামি জীবন বীমার বৈশিষ্ট্য হলো:
১। ব্যবসায়িক লেনদেন ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক সমবায় নীতিতে পরিচালিত হয়। যেখানে সকল সুযোগ সুবিধা ঠিক রেখে বিপণন, বীমার শর্ত নির্ধারণ, পুনঃবীমাকরণ, তহবিল বিনিয়োগ, মুনাফা বণ্টন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইসলামি শরীয়াহ নীতির পরিপালন করা হয়।
২। ইসলামি বীমায় পলিসি গ্রহণকারীগণ অংশীদারের মর্যাদা পান এবং মুনাফায় অংশ পাওয়ার অধিকার রাখেন।
৩। ইসলামি বীমা-তহবিল বিনিয়োগ করে অর্থনীতির হালাল খাতসমূহে। শরীয়তবিরোধী কোন খাতে ইসলামি বীমা কোম্পানি তার তহবিল বিনিয়োগ করতে পারে না, বরং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ এবং কল্যাণকর খাতে তহবিল বিনিয়োগ করার উদ্যোগ নিয়ে থাকে।
৪। সুদ যেহেতু হারাম বা নিষিদ্ধ সেহেতু ইসলামি বীমা কোন পরিস্থিতিতেই সুদ আয় করার জন্য বিনিয়োগ করতে পারে না।
৫। ইসলামি বীমায় শেয়ারহোল্ডারদের হিসাব এবং পলিসিহোল্ডারদের হিসাব নামক দুইটি পৃথক এবং সুস্পষ্ট হিসাব রক্ষা করতে হয়। এই দুইটি হিসাব নির্ধারিত নীতির ভিত্তিতে নির্ধারিত খাতে সম্পন্ন হয়।
৬। তাবাররু হলো ইসলামি বীমার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ইসলামি বীমা বা তাকাফুলের যৌথ জামানত এবং পারস্পরিক সাহায্য প্রদানের দায়-দায়িত্ব পালনার্থে অংশগ্রহণকারীগণ তাদের তাকাফুল কিস্তির নির্দিষ্ট অংশ তাবাররু হিসাবে দান করার অঙ্গীকার দিয়ে থাকেন। যা মুদারবা পদ্ধতিতে স্বাভাবিক চুক্তির অতিরিক্ত। অত্র চুক্তিতে আংশগ্রহণকারী তাদের সাথী অংশগ্রহণকারীর ক্ষতিপূরণে আন্তরিক সহায়তাদানে তাদের কৃত ওয়াদার যথাযথ বাস্তবায়নে সক্ষম করে তুলে।
৭। ইসলামি বীমা কোম্পানি শরীয়াহ পালন নিশ্চিত করার জন্য শরীয়াহ কাউন্সিল এবং সমাজ কল্যাণ কাজে সহায়তার জন্য যাকাত বা সাদাকাহ তহবিল গঠন করে।
প্রশ্ন : গ্রাহকদের কেন তাকাফুল বা ইসলামী বীমা কোম্পনিতে পলিসি করা উচিত?
ডা. কিশোর বিশ্বাস: ইসলামি জীবন বীমা কোম্পানিতে নিয়মিত সঞ্চয় এবং শরিয়তের আইন ও শর্তাবলির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এমন পদ্ধতিতে মুনাফা অর্জন মানসে বিনিয়োগ করার সুযোগ থাকে। পাশাপাশি বীমা পরিকল্পনার মেয়াদোত্তীর্ণ হবার আগেই কোন অংশগ্রহণকারীর মৃত্যুর কারণে তার উত্তরাধিকার বা উত্তরাধিকারগণের বীমা সুবিধা বা তাকাফুল ফায়দা অর্জন করতে পারে। তাই গ্রাহকদের তাকাফুল বা ইসলামি বীমা কোম্পনিতে পলিসি করা উচিত।
প্রশ্ন: ইসলামি জীবন বীমা কোম্পানি হিসেবে বীমা চুক্তি, তহবিল গঠন, বিনিয়োগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইসলামি শরীয়াহর বিধি-বিধান পরিপূর্ণভাবে প্রতিপালন সম্ভব হচ্ছে কী ?
ডা. কিশোর বিশ্বাস: ইসলামি জীবন বীমা কোম্পানি হিসেবে বীমা চুক্তি, তহবিল গঠন, বিনিয়োগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে শরীয়াহর বিধি-বিধান পরিপূর্ণভাবে প্রতিপালন সম্ভব হচ্ছে। ইসলামি বীমাতে চুক্তিপত্রে অজ্ঞাত এবং অনিশ্চিত বিষয় থাকার সুযোগ নেই। তহবিল গঠন এবং বিনিয়োগ করা হয় ইসলামি শরীয়াহ অনুযায়ী অর্থনীতির হালাল খাতসমূহে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ খাতে এবং কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে বিশেষ প্রকল্পের অধীনে তহবিল বিনিয়োগ করার উদ্যোগ ইসলামি বীমা প্রতিষ্ঠান সমূহকে নিতে হয়।
প্রশ্ন: শরীয়াহ কাউন্সিল সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাই।
ডা. কিশোর বিশ্বাস: প্রতিটি ইসলামি বীমা কোম্পানির জন্য শরীয়াহ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান সম্পন্ন আলেম ও ইসলামি চিন্তাবিদগণের সমন্বয়ে একটি বিশেষায়িত স্বতন্ত্র কাউন্সিল থাকা আবশ্যক। আধুনিককালে ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেনদেনে যত নতুন বিষয়ের উদ্ভব হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত হচ্ছে, সেগুলোর কোনটা শরীয়াহর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ আর কোনটি সঙ্গতিপূর্ণ নয় তা নির্ণয় করার যথাযথ কর্তৃপক্ষ আলেমগণ। তাই ইসলামি জীবন বীমা ব্যবস্থায় শরীয়াহ কাউন্সিলের বিকল্প নেই।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে ইসলামি জীবন বীমা পদ্ধতি বাস্তবায়নে আপনাদের কী ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে ?
ডা. কিশোর বিশ্বাস: বাংলাদেশের ইসলামি জীবন বীমা পদ্ধতি বাস্তবায়নে আমাদের অনেক ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
১। ইসলামি বীমার অনেক নীতি ও পদ্ধতি জাতীয় বীমা আইন ও বিধিমালার সাথে সাংঘর্ষিক। ইসলামি বীমা সফল করতে পৃথক ইসলামি বীমা আইন এবং বিধি প্রবর্তন করা প্রয়োজন।
২। ইসলামি বীমায় যেহেতু সুদকে আয় হিসাবে গ্রহণ করার সুযোগ নেই, বাংলাদেশ ব্যাংকে জামানতকৃত নিরাপত্তা জামানতের উপর কমপক্ষে সুদের সমপরিমাণ হালাল আয়ের ব্যবস্থা করা উচিত।
৩। ইসলামি বীমা ব্যবস্থা চালু করা এবং দক্ষতার সাথে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ জনশক্তির যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
৪। প্রচলিত বেসরকারি বীমা কোম্পানিসমূহ অশুভ প্রতিযোগিতায় ব্যবসা পাওয়ার জন্য প্রিমিয়ামের বিরাট একটি অংশ কমিশনের নামে পলিসি গ্রহণকারীকে ফেরত দেয়। এক্ষেত্রে সাধারণ বীমা গ্রহীতাগণ বছরের শেষে অধিক কমিশনের আশায় ইসলামি বীমা কোম্পানির নিকট থেকে পলিসি গ্রহণ করতে আগ্রহী হবে কি না বলা কঠিন।
৫। ইসলামি বীমা কোম্পানির জন্য ইসলামি ব্যাংকে বিনিয়োগ ছাড়া আর কোন বিকল্প ব্যবস্থা নেই। তাই ইসলামি অর্থ ও পুঁজিবাজারের অভাব আরেকটি বড় সমস্যা।
প্রশ্ন: আপনার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের তাকাফুল বা ইসলামি বীমার সম্ভাবনা কতটা?
ডা. কিশোর বিশ্বাস: মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের দেশের মানুষ ইসলামি শরীয়াহ মোতাবেক পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগে আগ্রহী। তাই ইসলামি বীমার ব্যাপারে জনগণের মধ্যে প্রচুর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। আইনগত এবং পারিপার্শ্বিক বাধাগুলো উত্তরণ করতে পারলে ইসলামি বীমার ব্যবসায়িক সফলতার যথেষ্ঠ সম্ভাবনা আছে এদেশে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ইসলামি জীবন বীমা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত জানতে চাই।
ডা. কিশোর বিশ্বাস: আমাদের মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রে ইসলামি জীবন বীমা চালু হওয়ায় একেকটি পরিবারের সদস্যদের আপদকালীন সঞ্চয় এবং নিরাপত্তার একটি শরীয়াহসম্মত পদ্ধতি অনুসরণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ইসলামি জীবন বীমা গ্রহণ করে সমাজের প্রত্যেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি জীবনকে সহজ, স্বার্থক, সুন্দর ও সফল করার প্রয়াস নিতে পারেন। পাশাপাশি পরিবারের সকলের জীবন সুন্দর ও স্বচ্ছল করার প্রচেষ্টা করতে পারেন। তাই বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ইসলামি জীবন বীমা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে বলে আমি মনে করি।
Posted ১:০৯ অপরাহ্ণ | বুধবার, ০১ জুন ২০২২
bankbimaarthonity.com | rina sristy