নিজস্ব প্রতিবেদক | রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | প্রিন্ট | 95 বার পঠিত
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেনের বেআইনি পদক্ষেপের কারণে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন ধরে মুনাফার একটি অংশ শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে জমা দেওয়া থেকে বিরত রয়েছে: যা শ্রম আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
দেশের শ্রম আইন অনুযায়ী, মুনাফার ৫ শতাংশ বছর শেষ হওয়ার ৯ মাসের মধ্যেই অংশগ্রহণ তহবিল, কল্যাণ তহবিল এবং বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
কিন্তু ২০২৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব বরাবর একটি চিঠি দিয়ে বাৎসরিক লভ্যাংশের ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে জমা দেওয়া থেকে বীমা কোম্পানিসমূহকে অব্যাহতি দেওয়ার অনুরোধ জানান। এ ধরনের চিঠি দিয়ে তিনি শুধু দেশের প্রচলিত আইনের বিপক্ষে অবস্থান নেননি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত করেছেন। সংসদে পাস হওয়া আইনকে অবজ্ঞা বা লঙ্ঘন করার অধিকার কারো নেই: আর কেউ তা করলে সেটা অপরাধ হিসেবেই গণ্য হবে বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা। শেখ কবির বীমা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে এমন বেআইনি পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত হয়েছেন বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা।
উল্লেখ্য, এর আগেও ২০২০ সালের ১৯ মার্চ একই ধরনের অনুরোধ জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে চিঠি দিয়েছিলেন শেখ কবির হোসেন। এরপর ২০২১ সালের ২ জুন বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে জমা দেওয়া থেকে বীমা কোম্পানিগুলোকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে চিঠি দিয়েছিলেন।
কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কারও অনুরোধই বিবেচনায় নেয়নি এবং এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়াও জানায়নি।
এদিকে, ২০২১-২২ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষার পর কোম্পানির শ্রম আইন লঙ্ঘনের বিষয়টি তুলে ধরে নিষ্পত্তি করার পরামর্শও দিয়েছে নিরীক্ষকরা।
বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন বলছে, আইন লঙ্ঘন করলেও জনবল সংকটে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। ফলে শ্রমিকের কল্যাণের জন্য ফান্ডের কার্যকারিতা ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
শ্রম আইনে বলা হয়েছে, ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড এবং শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড ট্রাস্টির মাধ্যমে আলাদা ব্যাংক হিসাবে ব্যবস্থাপনা হবে। আর শ্রমিকদের কল্যাণে গঠিত বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন ফান্ড সংগ্রহ করে ক্ষতিগ্রস্ত, আহত, কিংবা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত শ্রমিকদের প্রদান করবে।
তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানির শ্রম আইন পরিপালন না করার বিষয়টি জানিয়ে ২০২২ সালে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) চিঠি দেয় শ্রম ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠির প্রেক্ষিতে, ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড ও শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠনের তথ্য চেয়ে একই বছরের এপ্রিলে তালিকাভুক্ত সব কোম্পানিকে আলাদা চিঠি পাঠিয়েছিল বিএসইসি।
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ২৩৪ ধারা অনুযায়ী, কোম্পানিগুলোকে অবশ্যই এ দুটি তহবিল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আইন অনুযায়ী, হিসাব বছরের শেষ দিনে পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ অন্যূন্য এক কোটি টাকা কিংবা স্থায়ী সম্পদের মূল্য অন্যূন দুই কোটি টাকা হলে কোম্পানি নিট মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিকের কল্যাণ তহবিলে প্রদান করবে। জমাকৃত তহবিলের মধ্যে ৮০ শতাংশ অংশগ্রহণ তহবিলে, ১০ শতাংশ কল্যাণ তহবিল এবং অবশিষ্ট ১০ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলে যাবে।
নিয়ম অনুযায়ি ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড এবং শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড ট্রাস্টির মাধ্যমে আলাদা ব্যাংক হিসাবে ব্যবস্থাপনা হবে। আর শ্রমিকদের কল্যাণে গঠিত বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন ফান্ড সংগ্রহ করে ক্ষতিগ্রস্ত, আহত, কিংবা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত শ্রমিকদের প্রদান করবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে লেখা চিঠিতে শেখ কবির হোসেন বলেন বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) ধারা ২৩৪ এর উপধারা ১ অনুযায়ী প্রত্যেক কোম্পানিকে একটি শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল ও একটি শ্রমিক কল্যান তহবিল স্থাপন করার কথা বলা হয়েছে। আইনে প্রত্যেক বছর শেষ হওয়ার অন্যূন নয় মাসের মধ্যে পূর্ববর্তী বছরের নিট মুনাফার ৫ শতাংশ (পাঁচ শতাংশ) অর্থ ৮০:১০:১০ অনুপাতে যথাক্রমে অংশগ্রহণ তহবিল, কল্যাণ তহবিল এবং বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন ২০০৬ এর ধারা-১৪ এর অধীনে স্থাপিত শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলে প্রদান করার কথা বলা হয়েছে।
এ প্রেক্ষিতে মহাপরিচালক, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন দি ইনস্টিটিউট অব চার্টাড অ্যাকাউন্টসের প্রেসিডেন্টকে একটি পত্র প্রেরণ করে। উক্ত পত্রে কোন কোম্পানি/প্রতিষ্ঠান অডিট করার সময় তাদের তালিকাভুক্ত অডিট ফার্ম নিট মুনাফার ৫ শতাংশ অর্থ বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে জামার বিষয়টি নিরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসেন। অডিট ফার্মগুলো উল্লিখিত পত্রের নির্দেশনা অনুসরণ করে বীমা কোম্পানিগুলোতে অডিট কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং বীমা কোম্পানিগুলোকে প্রতিপালনের জন্য নির্দেশনা প্রদান করে আসছেন।
এ প্রেক্ষাপটে অডিট কোম্পানিগুলো বিভিন্ন বেসরকারি বীমা কোম্পানির হিসাব নিরীক্ষণের সময় কোম্পানির বিগত বছরের নিট মুনাফার ৫ শতাংশ অর্থ বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে জমার বিষয়টির উপর আপত্তি প্রদান করছে যা কোম্পানির জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর। বেসরকারি বীমা কোম্পানিগুলো অডিট কার্যক্রম সমাধানে নানাবিধ আপত্তির সম্মুখীন হচ্ছে। সরকারি ২টি বীমা কর্পোরেশনে যতদূর জানা যায় এ ধরনের কোন সমস্যা নেই। একই ধরণের সমস্যা ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে রয়েছে কিন্তু এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) ০৯/০৩/২০১৬ তারিখে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ২৮/১১/২০১৬ তারিখে মাননীয় অর্থমন্ত্রী মহোদয় বরাবর পত্র প্রেরণ করে। ২৮/১১/২০১৬ তারিখের পরের প্রেক্ষিতে আপনার মন্ত্রণালয় একমত পোষণ করে বাংলাদেশ শ্রম আইনের ধারা-২৩৪ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োগ না করার নিমিত্ত শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে ১৪/০২/২০১৭ তারিখে পত্র প্রেরণ করেন (কপি সংযোজিত)। উক্ত পত্রের প্রেক্ষিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অডিটের বিষয়ে কোন সমস্যা হচ্ছে না বলে জানা যায়।
এমতাবস্থায়, শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ২৩৪ এবং এ সম্পর্কিত অন্যান্য ধারাসমূহ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ন্যায় বীমা কোম্পানির ক্ষেত্রেও যেন প্রয়োগ না করা হয় বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তিনি চিঠিতে অনুরোধ করেন।
শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ শরিফুর রহমান ভুঁইয়া বলেন, শ্রমিক কল্যাল ফান্ডে লাভের একটি অংশ জমা দিতে হবে এমন আইন সংসদে পাস করা হয়েছে। এখানে যখন কোন আইন পাস হয় তখন বিভিন্ন সেক্টরে পরামর্শ নেয়া হয়। তখন ইন্স্যুরেন্স মালিকেরা কোন কথা বলেনি। এখন তারা আইন ভঙ্গ করছে। তাদের এ আইন ভঙ্গ করার কোন অধিকার নেই।
ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মালিকেরা যে কাজ করতে যাচ্ছে এর একটি আন্তর্জাতিক প্রভাব রয়েছে। আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো এ বিষয়টিকে ভালভাবে গ্রহণ করবে না বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, কোম্পানির মুনাফায় কর্মচারীদের অন্তর্ভূক্তির ফলে একদিকে যেমন শ্রমিকদের প্রতি কোম্পানি দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয়, তেমনি প্রতিষ্ঠানের প্রতিও তাদের দায়িত্ব¡বোধ বৃদ্ধি পায়। আইন অনুসারে উক্ত তহবিলগুলোতে কোম্পানির বার্ষিক নিট মুনাফার পাঁচ শতাংশ প্রদানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিষ্ঠার এক দশক পরও কোম্পানিগুলোকে আইন মানতে বাধ্য করতে না পারায় আইডিআরএ’র সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ড. মোল্লা জালাল উদ্দিন বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী ফাউন্ডেশনে টাকা জমা দিতে কোম্পানিগুলোকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। তবে চিঠির প্রেক্ষিতে কেউ কেউ টাকা দিচ্ছে আবার অনেকে কর্ণপাত করছে না।
তিনি বলেন, ফাউন্ডেশনের জনবল কম হওয়ায় কোনো কোম্পানি ফান্ডে টাকা জমা না দিলেও ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। শ্রম আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। কারণ তারা নিয়মিত বিভিন্ন বিষয়ে কোম্পানি পরিদর্শন করে, শ্রমিক কল্যাণের টাকা জমা না দিলে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সাল থেকে মাত্র তিনশ কোম্পানি এ ফাউন্ডেশনে টাকা জমা দিয়েছে। এই ফান্ডে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০০ কোটি টাকা জমা হয়েছে। নিবন্ধিত কোম্পানির বড় অংশই টাকা জমা না দেওয়ায় প্রতি মাসেই কোম্পানিগুলোকে চিঠি দিচ্ছে ফাউন্ডেশন।
Posted ৮:৫৭ অপরাহ্ণ | রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
bankbimaarthonity.com | rina sristy