| মঙ্গলবার, ২২ জানুয়ারি ২০১৯ | প্রিন্ট | 1442 বার পঠিত
সমস্যা সমাধানে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ সত্ত্বেও পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি বীমা খাতের বিভিন্ন অনিয়ম। গ্রাহক দাবি পরিশোধে বিলম্ব, অযথা হয়রানি, বাকিতে ব্যবসা, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আর্থিক প্রতিবেদন জমা না দেয়া, প্রতিবেদনে কারচুপি করা, আশঙ্কাজনক হারে পলিসি তামাদি হওয়ার প্রবণতা ইত্যাদি নানা কারনে বীমা খাতের উপর আস্থা হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এরপরও বলা যায়, বিগত কয়েক বছরের তুলনায় বর্তমানে বীমা খাত অনেকটাই শৃঙ্খলায় ফিরে এসেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বীমা খাতে অনৈতিক কমিশন নিয়ে উঠেছে জোর গুঞ্জন। বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে ব্যাপক সমালাচনার সৃষ্টি হলেও যথাযথা ব্যবস্থা নিতে এখন পর্যন্ত ব্যর্থ বীমা নিয়ন্ত্রণ সংস্থা আইডিআরএ। অবৈধ কমিশন বন্ধে প্রতিটি কোম্পানির সকল ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া হয়েছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার পক্ষ থেকে। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য পাওয়ার পরও নিয়ন্ত্রণ সংস্থার পক্ষ থেকে কোনো তদন্ত না হওয়ায় বন্ধ হয়নি এ অনিয়ম।
অন্যদিকে কোম্পানিরগুলোর এমন অনিয়মের প্রভাব পড়েছে সার্বিক বীমা খাতে। অবৈধ অতিরিক্ত কমিশন দিতে গিয়ে কোম্পানিগুলোতে চলছে তারল্য সংকট। ফলে লভ্যাংশ প্রদানে ব্যর্থ হওয়াসহ গ্রাহকদের দাবি সঠিক সময়ে পরিশোধ করতে পারছে না কোম্পানিগুলো। এর পাশাপাশি সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের রি-ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম পরিশোধেও ব্যর্থ হচ্ছে। নগদ অর্থ না থাকায় সঠিকভাবে আদায় হচ্ছে না ভ্যাট-ট্যাক্স। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্র্যাচুইটি-প্রভিডেন্ট ফান্ডও থেকে যাচ্ছে শূন্যের কোঠায়।
এ নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা, অবৈধ কমিশন বন্ধে এখনো যথাযথ পন্থায় আগায়নি আইডিআরএ। তাই বন্ধ করা যাচ্ছে না এই অনিয়ম। তাদের মতে, অবৈধ কমিশন বন্ধে প্রথমেই কোম্পানিগুলোর গোপন হিসাব নম্বরগুলো খুঁজে বের করতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজন রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশিষ্ট বীমাবিদ একেএম সরওয়ার্দি চৌধুরী বলেন, যেহেতু বীমা কোম্পানিগুলো তাদের সকল প্রকার ব্যাংক হিসাবের তথ্য আইডিআরএ’র কাছে জমা দিয়েছে, এখন আইডিআরএ’র উচিত তাদের প্রদানকৃত তথ্য বা হিসাবগুলো সত্য কিনা তা যাচাই করা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের সকল ব্যাংকের শাখাগুলোতে তদন্ত চালাতে হবে। প্রদানকৃত ব্যাংক হিসাবের বাইরে কোম্পানির নামে অন্য কোনো হিসাব খোলা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। পাশাপাশি গোপন হিসাবগুলোর ট্রানজেকশনের তথ্যগুলো সংগ্রহ করতে হবে। যদিও এটা দীর্ঘসময়ের ব্যাপার, এরপরও বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে অবৈধ কমিশন বাণিজ্য প্রায় ৫০ শতাংশে নেমে আসবে। কারণ এই গোপন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেই কমিশনের টাকাগুলো প্রদান করা হয়।
এছাড়াও ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর জন্য একটি নির্দিষ্ট ফরম তৈরি করতে পারে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। যেখানে কোম্পানি এবং এর শাখাগুলোর সকল প্রকার ব্যয় উল্লেখ থাকবে। এই ফরমে কোম্পানিগুলোর প্রিমিয়াম আয় সম্পর্কিত তথ্য, ব্যাংকভিত্তিক ডিপোজিটসহ স্টেটমেন্ট, কোম্পানির (শাখা অফিসগুলোর ক্ষেত্রে) প্রধান কার্যালয় থেকে কত টাকা নেয়া হয়েছে এবং তা ব্যয় হয়েছে তার সম্পর্কিত তথ্য থাকবে। এসবের পাশাপাশি কোম্পানিগুলোকে সুপার সুপারভিশনের কাজও করতে হবে আইডিআরএকে বলে মনে করেন বীমা সংশ্লিষ্টরা। শুধু জরিমানা করার মাধ্যমে এই শিল্পের উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই মুহ‚র্তে সবচেয়ে বেশি পরিচর্যা ও সংশোধনের মাধ্যমে সম্ভাবনাময় বীমা খাতকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। সন্তানকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে যেমন তাকে শাসনের পাশাপাশি মমতাও দিতে হয়, তেমনি যখন তখন ছোটখাটো বিষয়ে কোম্পানিগুলোকে জরিমানা না করে সমস্যা চিহ্নিত করে তার সমাধান করা উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে একাধিক কোম্পানির মুখ্য নির্বাহীদের সাথে কথা বললে তারা জানান, এককভাবে কোনো কোম্পানির পক্ষে এই অনিয়ম বন্ধ করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সম্মিলিত ঐক্য ও উদ্যোগ। কিন্তু ইতিপূর্বে এমন উদ্যোগ কেন নেয়া হয়নি এমনটি জানতে চাওয়া হয় বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের (বিআইএফ) সাবেক সেক্রেটারি ফজলুল হক খানের কাছে। তিনি বলেন, অবৈধ কমিশনের বিষয়ে এর আগে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ) এবং বিআইএফের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু আমরাই আমাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছি। মিটিংয়ে সকলে অনৈতিক কমিশন না দেয়ার পক্ষে একমত হলেও বৈঠক শেষে দেখা যায় তিনিই প্রথমে কমিশন দিয়ে একটি ব্যবসা নিয়ে নিচ্ছেন।
তাই অনিয়ম বন্ধে প্রথমে আমাদের সকলকে নৈতিকভাবে পরিচ্ছন্ন হতে হবে। পাশাপাশি আইডিআরএকেও এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
অপরদিকে অতিরিক্ত কমিশনকে ‘কালো টাকা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি (বিজিআইসি) লিমিটেডের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহমেদ সাইফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী মিন্টু। তিনি বলেন, বীমা ব্যবসায় কোন অবস্থায় ১৫ শতাংশের অতিরিক্ত কমিশন দেয়ার সুযোগ মেনে নেয়া যায় না। অতিরিক্ত কমিশন বন্ধে আইন বাস্তবায়ন, পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি-নৈতিকতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। এছাড়া কমিশন বন্ধের প্রক্রিয়া সম্পর্কে নিজের মতামত জানাতে গিয়ে বলেন, সাধারণ বীমায় কোম্পানির রি-ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম বকেয়া রাখার ব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি দ্রæততম সময়ের মধ্যে ক্লেইম পরিশোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে সার্ভে রিপোর্টের পর বড় বীমা এবং ছোট বীমার দাবি পরিশোধের জন্য একটি সময় বেঁধে দিতে হবে। আর তাহলেই অতিরিক্ত কমিশন দেয়ার পথ বন্ধ হবে। এই দুটো বিষয় যদি আইডিআরএ কন্ট্রোল করতে পারে, তাহলে বীমা সেক্টরে বিরাজমান অস্থিরতা দূর হয়ে যাবে। কারণ তখন তারা ক্লেইম দেবে, নাকি কমিশন প্রদান করবে? যখন প্রতিষ্ঠানের ফান্ড শেষ হয়ে যাবে তখন স্বাভাবিকভাবেই অতিরিক্ত কমিশন দিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ থাকবে না।
কীভাবে এই কমিশনটি দেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে বলেন, কমিশনটা মূলত এজেন্ট বা ডেভেলপমেন্ট অফিসারের। কিন্তু বর্তমানে ডেভেলপমেন্ট অফিসার তার ১৫ শতাংশ নিয়ে পার্টিকে দিচ্ছেন, আর নিজে অফিস থেকে আলাদা বেতন পাচ্ছেন। এতে করে ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। যে কারণে চাইলেও অতিরিক্ত ব্যয় বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এই অনিয়ম রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তাছাড়া সন্দেহজনক পলিসিগুলোর ক্ষেত্রে গ্রাহকের নিকট থেকে প্রকৃত ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে তা কোম্পানির দাখিলকৃত তথ্যের সাথে মিলানো। এরকম দু’তিন জনকে ধরলেই কিন্তু কমিশন বন্ধ হয়ে যায়।
কমিশন বন্ধে বিভিন্ন সময়ে নেয়া পদক্ষেপের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কমিশন বন্ধে অনেক মিটিং হয়েছে, বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোকে জানানো হয়েছে। অনেকে শপথ করেছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। এখন এই সংকট দূর করতে হলে রি-ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম ঠিক মতো দিতে হবে। ক্লেইম সেটেল করতে হবে। এই দুটো বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কঠোর পদক্ষেপ নিলে কমিশন সিস্টেম কমে যাবে। এখন রি-ইন্স্যুরেন্সের পেমেন্ট প্রদানে বিলম্ব করা হচ্ছে। এক বছর অথবা দু’বছর পর দেয়া হচ্ছে। এ টাকাই কমিশন হিসেবে খাটানো হচ্ছে। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। সব কিছুকে একটি সুন্দর নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হতে হবে।
অবৈধ কমিশনের পাশাপাশি জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ট্যারিফ এবং নো-ক্লেইম বোনাসও বীমা খাতের সমস্যা তৈরি করছে বলে জানান এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের সিইও সাইদুর রহমান। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, অনেক সময় গ্রাহক অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলোর বিভিন্ন অখ্যাত কোম্পানির ট্যারিফ নিয়ে এসে সে অনুযায়ী ট্যারিফ সুবিধা নিতে চায় আমাদের কাছ থেকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে চলমান ট্যারিফই সকলে মেনে চললে তা সকল পক্ষের জন্যই উপকৃত হবে। আবার নির্ধারিত সময়ের আগেই নো-ক্লেইম বোনাস দেয়ার ক্ষেত্রে হতবাক হয়ে বলেন, বছর শেষ হওয়ার পূর্বেই কোনো কোনো কোম্পানি গ্রাহককে নো-ক্লেইম বোনাস দিয়ে দিচ্ছে। এটা কিভাবে সম্ভব? পলিসি করার পর মাত্র ৫/৬ মাসের মধ্যে কিভাবে এই বোনাস দিতে পারে কোম্পানিগুলো।
আবার এজেন্ট/ডেভেলপমেন্ট অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে কমিশনের পরিবর্তে বেতন ব্যবস্থা চালু করার ওপর জোর দেন রূপালী ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পি. কে রায়। কমিশনভিত্তিক এজেন্ট নিয়োগ দেয়ায় এজেন্ট এবং কোম্পানিগুলো এর অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করছে বলে জানান তিনি। তাই এই পথ রোধ করতে ব্যবসায় উন্নয়ন কর্মীদের বেতনভিত্তিতে নিয়োগের পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা।
Posted ৯:০৪ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২২ জানুয়ারি ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed