| মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর ২০২২ | প্রিন্ট | 199 বার পঠিত
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, আমি মনে করি, আর্থিকখাতে ব্যাপক সংস্কার সাধন করা প্রয়োজন। আমরা যদি অর্থনৈতিক উন্নয়নকে আরো গতিশীল ও টেকসই করতে চাই তাহলে সংস্কারের মাধ্যমে এসব খাতকে আধুনিকায়ন এবং যুগোপযোগী করার কোনো বিকল্প নেই। তিনি দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি পত্রিকার প্রতিনিধি এম এ খালেকের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন। ড.এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলামের সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবরণ এখানে উল্লেখ করা হলো।
দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: বিশ্বব্যাংক অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের আর্থিক খাতসহ কয়েকটি খাতের ব্যাপক সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে। তারা বিশেষ করে আর্থিক খাত, রাজস্ব খাত এবং নগরায়ন প্রক্রিয়া সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, যদি এসব খাতে সংস্কার করা না হয় তাহলে আগামী এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে পড়বে। আপনি একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে কিভাবে এই সংস্কার সাধিত হতে পারে বলে মনে করেন?
ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম: বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টর তথা, আর্থিক খাত সংস্কার, রাজস্ব খাত সংস্কার এসব বিষয় বহুল আলোচিত প্রসঙ্গ। অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন মহল থেকে এই সংস্কার কার্যক্রম সাধনের জন্য বলা হচ্ছিল। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, এসব খাতে সংস্কার সাধন করা অনস্বীকার্য। আমরা যদি আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে আরো গতিশীল ও টেকসই করতে চাই তাহলে সংস্কারের মাধ্যমে এসব খাতকে আধুনিকায়ন এবং যুগোপযোগী করার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে আমি আর্থিক খাতের কথা উল্লেখ করতে চাই। আমাদের আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি। দেশের ব্যাংকিং সেক্টর এখন খেলাপি ঋণ সমস্যায় জর্জরিত। কোনোভাবেই এই খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরোতে পারছি না। বিশেষ করে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের প্রচণ্ড দাপটে ব্যাংকিং সেক্টরের অবস্থা এখন বিপর্যস্ত। খেলাপি ঋণের মাত্রা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। কোনোভাবেই তা সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংক যে পরিসংখ্যান দিয়েছে সেখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে দেখায়। কারণ প্রদর্শিত খেলাপি ঋণের সঙ্গে অবলোপনকৃত ঋণ, পুনঃতফসিলিকৃত ঋণ, পুনর্গঠিত ঋণ এবং মামলাধীন প্রকল্পের নিকট পাওনা ঋণের পরিমাণ যোগ করা হলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ আরো অনেক বেশি হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে পদ্ধতিতে খেলাপি ঋণের হিসাব করে তাও আন্তর্জাতিক মানের নয়। একজন ঋণ খেলাপি যিনি অনেকদিন ধরেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেননি তাকে ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের সুযোগ দেয়া হয়। তিনি ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ করলে তাকে আর ঋণ খেলাপি বলা যাবে না। আন্তর্জাতিকভাবে খেলাপি ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের বিধিবদ্ধ নিয়ম আছে। আমাদের দেশেও সেই নিয়ম মেনে চলা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এমন কিছু আইনি সংস্কার করা হয়েছে যাতে ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ পদ্ধতি সহজ হয়েছে। ফলে একজন ঋণখেলাপি খুব সহজেই তার ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের মাধ্যমে ঋণখেলাপির বাইরে চলে যাচ্ছেন। এটা কোনোভাবেই সমর্থন যোগ্য নয়। কারণ তিনি তো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছেন না। তিনি প্রকৃতপক্ষে ঋণখেলাপি থেকে যাচ্ছেন কিন্তু তাকে ঋণ খেলাপি হিসেবে দেখানো হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত. যেসব প্রকল্পের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হচ্ছে সেই মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সেই প্রকল্পের নিকট পাওনা ঋণাঙ্ক খেলাপি হিসেবে প্রদর্শন করা হচ্ছে না। বছর দুই আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল(আইএমএফ) খেলাপি ঋণের একটি হিসাব প্রকাশ করেছিল। তাতে তারা বলেছিল, মামলাধীন প্রকল্পের নিকট পাওনা ঋণ এবং অবলোপনকৃত ঋণ হিসাবের নিকট পাওনাসহ বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। কাজেই নিঃসন্দেহে আর্থিক খাতে সংস্কারের প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে বিদ্যমান খেলাপি ঋণের পরিমাণ কিভাবে কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা যায় সে দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। অন্য খাতের মধ্যে আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কারণ আর্থিক খাতে সুশাসন কোনোভাবেই নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে উদ্যোগের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। যারা বড় বড় ঋণখেলাপি তাদের অধিকাংশেরই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে। অথবা অন্য কোনো ক্ষমতা ব্যবহার করে তারা ব্যাংককে ম্যানেজ করে থাকে। তারা অধিকাংশ সময়ই ধরা ছোয়ার বাইরে থেকে যান। আমি এক ব্যাংকের পরিচালনক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঋণ আর পরিশোধ করছি না। আবার অন্য ব্যাংকের পরিচালক আমার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছে না। এভাবে পরস্পর যোগসাজশের মাধ্যমে একটি মহল ব্যাংক থেকে ঋণ বের করে নিচ্ছে। ব্যাংকিং সেক্টরে সুশাসনের যে অভাব আছে তা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। তবে এই সমস্যা কীভাবে দূর করা যাবে তা আমি নির্দিষ্ট করে বলতে পারবো না। ব্যাংকিং সেক্টরে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা দূর করার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায় করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি।
দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং সেক্টরে ঋণ হিসাব অবলোপন নীতিমালা সহজীকরণ করা হয়েছে। আগে কোনো ঋণ হিসাব অবলোপন করতে হলে ঋণ হিসাবটি মন্দমানে শ্রেণিকৃত হবার পর ৫ বছর অতিক্রান্ত হলে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়ের ও শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করার পর শর্তসাপেক্ষ সেই ঋণ হিসাব অবলোপন করা যেতো। খেলাপি ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের নীতিমালা সহজীকরণ এবং এককালীন ডাউন পেমেন্ট কমানো হয়েছে। এভাবে ঋণখেলাপিদের আরো নানা সুযোগ দেয়া হয়েছে। এতে খেলাপি ঋণ আদায় প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় আপনি কি মনে করেন আগের নিয়মগুলোই হুবহু অনুসরণ করা উচিত?
ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম: আমি মনে করি, ব্যাংকিং সেক্টর আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমেই পরিচালিত হওয়া উচিত। আর ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের প্রতি সবসময়ই কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করা প্রয়োজন। অন্যথায় ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের নিকট ভুল বার্তা যাবে। তারা মনে করবে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দিলেও কোনো অসুবিধা হয় না। আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করা না হলে বাইরের দুনিয়ার বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পর্কে ভুল ধারণার সৃষ্টি হবে। বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক লেনদেনে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
বিশ্বব্যাংক তাদের সংস্কার প্রস্তাবনায় দ্বিতীয় যে খাতটির কথা বলেছে তা হচ্ছে রাজস্ব খাত। বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে নিম্ন পর্যায়ের দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। আর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও’র ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই নিচের দিকে। উদাহরণ হিসেবে নেপালের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। দেশটির মাথাপিছু জাতীয় আয় বাংলাদেশের তুলনায় অনেকটাই কম। কিন্তু ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও’র ক্ষেত্রে তারা আমাদের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। কাজেই আমাদের দেশের রাজস্ব আদায় ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের দেশের মানুষের কর প্রদানের ইচ্ছে এবং সামর্থ্য দু’টোই আছে। কিন্তু নানা কারণে তারা কর দিচ্ছে না। এ জন্য কর আদায় ব্যবস্থা স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক করতে হবে। আর একটি বিষয় দৃষ্টি দিতে হবে তাহলো, করের পরিমাণ না বাড়িয়ে আওতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। সাধারণ করদাতারা যাতে সহজে কোনো ধরনের হয়রানির মুখোমুখি কর পরিশোধ করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। আয়কর দেবার যোগ্যতা রাখেন এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানও কর প্রদান করেন না। এমনকি যাদের ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নাম্বার (টিআইএন) আছে তাদের অর্ধেকও তো আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন না। টিআইএনধারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত তথ্য তো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিকট আছে। কাজেই তাদের ফলোআপ করে সেখান থেকে রাজস্ব আহরণের চেষ্টা করা উচিত। কর প্রদানযোগ্য অনেকেই আয়কর দেন না। দোকানে বিক্রি করলেও রিসিপ্ট দেন না। ফলে প্রাপ্য রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে না। বিদ্যমান এসব সমস্যা সমাধান না করা গেলে রাজস্ব আদায় বাড়বে না। আর রাজস্ব আদায় বাড়ানো ছাড়া উন্নয়ন কার্যক্রমে নিজস্ব সূত্র থেকে অর্থায়ন করা সম্ভব হবে না। বাজেটর ঘাটতির পরিমাণ আমরা জিডিপির ৫ বা সাড়ে ৫ শতাংশ রাখতে চাই। কিন্তু ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বাড়ানো না গেলে এটা সম্ভব হবে না। আমাদের দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া যেভাবে দ্রুততর হচ্ছে তাতে বিভিন্ন খাতে সরকারি ব্যয় বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আর এই ব্যয়ের ক্ষেত্রে অর্থায়নের জন্যই রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে। কাজেই রাজস্ব খাতের সংস্কার করা খুবই প্রয়োজন। আয়কর পদ্ধতি যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। এখন অনেকেই আয় কর দেবার মতো সামর্থ্য রাখেন। এমনকি গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন এমন অনেক ব্যক্তিও আয়কর দেবার মতো সামর্থ্য রাখেন। তাদের কর নেটওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। শহরাঞ্চলের বাইরেও যারা কর প্রদানযোগ্য আছেন তাদেরে কর নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আর যাদের টিআইএন আছে তাদের রিটার্ন দাখিলে বাধ্য করতে হবে। টিআইএন থাকলে তাকে রিটার্ন দাখিল করতে হবে। রিটার্ন দাখিল করলেই বোঝা যাবে তার আয় কি আছে আর ব্যয় কত। রিটার্ন দাখির করলেই মিনিমাম একটা ট্যাক্স দিতে হয়। তাই অনেকেই রিটার্ন দাখিল করতে চান না। এসব স্থানে সংস্কার করা দরকার। বিশ্বব্যাংক নগর সংস্কারের কথাও বলেছে। আমি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে যেটা বুঝি আমাদের দেশের নগরের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে পরিবহন সমস্যা। পরিবহন ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। গৃহায়ন একটি বড় সমস্যা। আমাদের শহরগুলোতে আবাসন সুবিধা পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি। শহরের পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে নানাধরনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়। পরিবহন খাতের সমস্যার কারণে প্রতিদিন আমাদের লাখ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। সড়ক নির্মাণের জন্য প্রাথমিকভাবে যে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় পরবর্তীতে তা তিন-চারগুণ বৃদ্ধি পায়। প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়। প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হলে সাধারণ মানুষ সেই প্রকল্প থেকে উপকার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়।
দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: বর্তমানে যে উন্নয়ন হচ্ছে তাকে কি আপনি টেকসই উন্নয়ন বলবেন?
ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম: বার্তমানে আমরা যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করছি তা কতটা টেকসই তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। উন্নয়নের জন্য সরকারের ব্যয় বাড়নোর প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সেই উন্নয়নের জন্য নিজস্ব সূত্র থেকে অর্থায়ন জোগাড় করতে হবে। রাজস্ব আয় বাড়ানোর মাধ্যমে নিজস্ব সূত্র থেকে উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করা না গেলে উন্নয়নের ধারা বজায় রাখা কঠিন হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে অবস্থা বিরাজ করছে, যার ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যেমন অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রুম-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সাপ্লাই চেইন বিঘ্নিত হওয়া ইত্যাদি কারণে আগামীতে আমাদের উন্নয়ন কার্যক্রম কতটা টেকসই থাকবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক চলতি অর্থবছরের জন্য আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন কমিয়েছে।
দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: দেশের শেয়ার বাজার নিয়ে অনেক কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু শেয়ারবাজারের কোনো উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে এ ব্যাপারে কিছু বলবেন কি?
ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম: বর্তমানে শেয়ার বাজারের যে অবস্থা বিরাজ করছে তাকে খুব একটা খারাপ বলা যাবে না। পুঁজিবাজার খুব একটা অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করছে না। হয়তো একদিন বা দুদিন বাজার কিছুটা পড়ে যাচ্ছে আবার বাজারের উত্থান ঘটছে। কাজেই এই অবস্থাকে খারাপ বলা যাবে না। আমাদের দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা আসতে চান না। ভালো কোম্পানিরগুলোও তাদের কোম্পানির শেয়ার নিয়ে বাজারে আসতে চায় না। অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন, আমাদের দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির খরচ অনেক বেশি। তবে আমি মনে করি না যে অভিযোগটি খুব একটা যৌক্তিক। আমাদের দেশে যারা উদ্যোক্তা তারা কোম্পানির ওপর পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য পুঁজিবাজারে আসতে চান না। একটি কোম্পানি যদি পুঁজিবাজারে আসে, তাহলে সেই কোম্পানির ওপর উদ্যোক্তার পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ কিছুটা হলেও কমে যায়। এছাড়া কোম্পানি পুঁজিবাজারে এলে তাদের বিভিন্নভাবে জবাবদিহির মুখে পড়তে হয়। একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক শেয়ার বাজারে ছাড়তে হবে। প্রতি বছর ডিভিডেন্ড প্রদানের বিষয় আছে। কোনো কোম্পানি ডিভিডেন্ড দিতে না পারলে তার উদ্যোক্তাদের বার্ষিক সাধারণ সভায় শেয়ারহোল্ডারদের প্রশ্নে মুখে পড়তে হবে। কোনো ধরনের অনিয়ম হলে বিএসইসি জবাবদিহি চাইতে পারে। দেশের যে সব ভালো কোম্পানি এখনো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়নি তাদের বাজারে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। এ জন্য কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ভালো কোম্পানিগুলোকে বাজারে নিয়ে আসতে হবে। অনেক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন কোম্পানিগুলো বাজারে নিয়ে আসা হবে। কয়েক বছর আগে ২৬টি রাষ্ট্রমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বাজারে নিয়ে আসার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কোম্পানিগুলো শেয়ার বাজারে আসেনি। রাষ্ট্রমালিকানাধীন কোম্পানিগুলো শেয়ার বাজারে না আসার কারণে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোও শেয়ার বাজারে আসার ক্ষেত্রে আগ্রহী হচ্ছে না। আমি জানিনা কেনো রাষ্ট্রমালিকানাধীন কোম্পানির শেয়ার বাজারে ছাড়া হচ্ছে না।
দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: বেশ কয়েক বছর আগে আপনি বলেছিলেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নেই। কিন্তু একধরনের অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। যে কারণে বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত মাত্রায় হচ্ছে না। সেই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কি এখনো বিদ্যমান আছে?
ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম: রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান অনিশ্চয়তা এখনো বিদ্যমান আছে এবং ক্রমেই তা আরো ঘনীভূত হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের তারিখ যতোই ঘনিয়ে আসছে, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ততোই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এই অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ধীরগতিতে এগোবে বলেই আমার বিশ্বাস।
দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: চলতি মুদ্রানীতিতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। কিন্তু ইতিমধ্যেই গত কযেক মাসে ব্যক্তি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। কিন্তু ইতিমধ্যেই আমদানি বাবদ এলসি খোলার হার কমেছে ৩৩ শতাংশ। আর শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি কমেছে ৫৫ শতাংশ। তার অর্থ হচ্ছে ব্যক্তিখাতে যে ব্যাংক ঋণ দেয়া হচ্ছে তা শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে না। এই ঋণের অর্থ তাহলে কোথায় যাচ্ছে?
ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম: ব্যক্তিখাতে যে ঋণ দেয়া হচ্ছে তা কোথায় যাচ্ছে কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এটা অনুসন্ধান করে দেখার দরকার আছে। এই ঋণের অর্থ কি অন্য কোনো খাতে প্রবাহিত হচ্ছে কিনা তা খুঁজে দেখা দরকার। এখানেই আবারো সুশাসনের প্রশ্নটি আসে। ব্যাংকিং সেক্টরে যদি সুশাসন নিশ্চিত করা যেতো, তাহলে শিল্পের জন্য বরাদ্দকৃত ঋণের অর্থ অন্য কোনো খাতে ব্যবহৃত হবার কথা নয়। এমনও হতে পারে যে, শিল্পের নামে ঋণ বরাদ্দ করিয়ে তা অন্য খাতে ব্যবহার করা হচ্ছে, এমনকি অভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে তা বিদেশে পাচার করা হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক কাস্টমসকে নির্দেশ দিয়ে আমদানি পণ্যের মূল্য যাচাই করার জন্য। আমি যখন তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ছিলাম তখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমদানি পণ্যের মূল্য যাচাইয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: মূল্যস্ফীতি তো এখণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপীই এটি একটি সমস্যা। মূলস্ফীতি নিয়ন্ত্রিত রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। কিন্তু ব্যাংক ঋণের আপার ক্যাপ তুলে দেয়া হয়নি। এই অবস্থায় শুধু নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কি সম্ভব?
ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম: বর্তমানে আমরা বিশ্বব্যাপী যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রত্যক্ষ করছি তা বিশ্বজনিত সমস্যা। এটা কোনো একটি দেশ বা অঞ্চলের সমস্যা নয়। তাই শুধু অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করে কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। আমরা বর্তমানে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রত্যক্ষ করছি, তা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আগত। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি সমস্যা ভুগছে। কোনোভাবেই এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের অর্থনীতিতেও ৯ শতাংশের ওপরে মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে, যা গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ব্রিটেনের অবস্থা আরো খারাপ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূল্যস্ফীতিও প্রায় ডাবল ডিজিটে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংকিং সেক্টরে আমানতের উপর সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদ দেয়া হচ্ছে। আমি মনে করি, এটা কোনোভাবেই ঠিক নয়। কারণ আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতি বর্তমানে ৯ শতাংশের বেশি। এতে যারা ব্যাংকে আমানত রাখবে তাদের লোকসান হবে। নীতি সুদহার বাড়ানো হলেই যে আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতি কমবে তা নয়। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য পণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় ব্যাংকের নীতি সুদ হার বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে না। এছাড়া নীতি সুদহার বাড়ানো হলেও ঋণের ওপর সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ এখনো পরিবর্তন করা হয়নি। আন্তর্জাতিক বাজারের পণ্য মূল্যের ওপর আমাদের কোনো হাত নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে আমাদের বেশি দামে পণ্য আমদানি করতে হবে। এতে স্থানীয় বাজারে সংশ্লিষ্ট পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কাজেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের মতো দেশের জন্য একটি কঠিন সমস্যা। এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে যারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তাদের জন্য ভর্তুকি মূল্যে নিত্য পণ্যের যোগান নিশ্চিত করা। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা এবং বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এখানে সমস্যা হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয় তা ঠিক মতো টার্গেট গ্রুপের নিকট পৌঁছে না। যাদের এই সুবিধা পাবার কথা নয় তারা পাচ্ছে। যাদের পাবার কথা তারা পাচ্ছে না।
দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের হার ছিল জিডিপির ২১ দশমিক ২৪ শতাংশ। এটা তার আগের ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। পরবর্তী বছরগুলোর পরিসংখ্যান পাচ্ছি না। বিনিয়োগের অবস্থা আসলে কেমন?
ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম: ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার খুব একটা বাড়েনি। গত এক দশক ধরে তা জিডিপি’র ২১/২২ শতাংশেই সীমিত রয়েছে।
দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে ক্লাস্টার ঋণ দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে যার সুদের হার ৪ শতাংশ। এই উদ্যোগ এসএমই খাতের বিকাশে কতটা অবদান রাখবে বলে মনে করেন?
ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম: আমি এ ব্যাপারে খুব বেশি আশাবাদ পোষণ করি না। কারণ ৫ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে একই জাতীয় ৫০টি ছোট প্রকল্প বাছাই করা বেশ কঠিন কাজ। দু’একটি স্থানে এমন ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারে কিন্তু সারা দেশে এমন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে বলেই আমার মনে হয়।
Posted ৩:৪৮ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর ২০২২
bankbimaarthonity.com | rina sristy