নিজস্ব প্রতিবেদক | বৃহস্পতিবার, ০৫ জানুয়ারি ২০২৩ | প্রিন্ট | 205 বার পঠিত
বেড়েই চলেছে নন-লাইফ বীমাখাতে অতিরিক্ত কমিশন দেয়ার প্রবণতা। নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানামুখী পদক্ষেপ সত্ত্বেও পুরোপুরি ঠেকানো যায়নি এই সমস্যা। অবৈধ কমিশন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। করোনা-পূর্ববর্তী সময়ে এর লাগাম কিছুটা টেনে ধরলেও আবারো বাড়ছে অতিরিক্ত কমিশনের লেনদেন। ফলে গ্রাহকের দাবি পরিশোধে বিলম্ব, রি-ইন্স্যুরেন্সে সমস্যা, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আর্থিক প্রতিবেদন জমা না দেয়া, প্রতিবেদনে কারচুপি, জিডিপিতে
বীমাখাতের অবদান কমে যাওয়াসহ আস্থা সংকট আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বীমা বিশ্লেষকরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশে নন-লাইফ বীমা কোম্পানির এজেন্টদের জন্য বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) নির্ধারিত ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ হারে কমিশন দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এই কমিশন বীমা কোম্পানির লাইসেন্সধারী এজেন্টদের দেয়ার কথা। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, গ্রাহক সংগ্রহের জন্য কিছু বীমা কোম্পানি আইডিআরএ’র নির্ধারিত কমিশনসহ অতিরিক্ত কমিশন এজেন্টদের না দিয়ে গ্রাহকদের দিয়ে থাকে। কোনো কোম্পানি নির্ধারিত কমিশন অফার করলে অন্য কোম্পানি অতিরিক্ত কমিশন অফার দিয়ে তৈরি করে এই প্রতিযোগিতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা অভিযোগ করে বলেন, বিশেষ করে ব্যাংক রিলেটেড বীমাগুলোতে অতিরিক্ত কমিশন দিতে হয়। অতিরিক্ত কমিশন না দিলে তাদের সাথে বীমা করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কিছু ব্যাংক কর্মকর্তা পলিসির বিপরীতে অতিরিক্ত কমিশন দাবি করেন। এক্ষেত্রে বীমাখাতের ডেভেলপমেন্টে যারা কাজ করেন তাদেরকে প্রভাবিত করে কমিশনের মাত্রা বাড়িয়ে থাকেন। অনেক ব্যাংক কর্মকর্তা সানড্রি অ্যাকাউন্টে রাখার কথা বলেও অতিরিক্ত কমিশন দাবি করেন। আবার মফস্বলের কিছু ব্যাংক ম্যানেজার রয়েছে যারা সি সি লোন এর বিপরীতে যে বীমা করা হয় তা থেকেও অতিমাত্রায় কমিশন দাবি করেন। এছাড়া, কিছু বীমা গ্রাহকও রয়েছে যারা বীমা পলিসির বিপরীতে কি সুবিধা পাবে সেটা না দেখে কত কমিশন তাৎক্ষণিকভাবে পাচ্ছে সেটা বিবেচনায় নিয়ে বীমা করেন।
এদিকে অতিরিক্ত কমিশনের বিষয়ে বীমা বিশেষজ্ঞরা বলেন, নন-লাইফ বীমাখাতে কমিশন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তারা বলেন, বিগত কয়েক বছরের তুলনায় বর্তমানে বীমাখাত শৃঙ্খলায় ফিরলেও অতিরিক্ত কমিশন দেয়ার প্রবণতা এখনো বন্ধ হয়নি। অতিরিক্ত কমিশন দেওয়ায় বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সমালাচনার সৃষ্টি হলেও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারছে না বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তাদের মতে, বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যাংক হিসাব, নগদ লেনদেন, রি-ইন্স্যুরেন্স, ত্রৈমাসিক আর্থিক প্রতিবেদন খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে অবৈধ কমিশন দেয়ার প্রবণতা কমে আসবে। তারা আরো বলেন, অতিরিক্ত কমিশন দেওয়ার ফলে সার্বিক বীমাখাতে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। অতিরিক্ত কমিশন দিতে গিয়ে কোম্পানিগুলো ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা ঠিক রাখতে পারছে না। কোম্পানি লভ্যাংশ প্রদানে ব্যর্থ হয়, গ্রাহকদের দাবি পরিশোধে ব্যর্থ হয়, রি-ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম পরিশোধ করতে পারে না, নগদ অর্থ না থাকায় দিতে পারে না ভ্যাট-ট্যাক্স। আবার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্র্যাচুইটি-প্রভিডেন্ট ফান্ডও থাকছে শূন্য। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আশু ব্যবস্থা না নিলে সংকটে পড়তে পারে পুরো বীমাখাত।
এদিকে অতিরিক্ত কমিশনের বিষয়ে বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিআইসি) মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আহমেদ সাইফুদ্দিন চৌধুরী বলেন, বীমা ব্যবসায় কোন অবস্থায় ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশের বেশি কমিশন দেয়ার সুযোগ নেই। আমাদের কোম্পানি এ ব্যাপারে কঠোর। তবে বাজারে অতিরিক্ত কমিশন দেয়ার প্রবণতা রয়েছে সেইজন্য আমাদের নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অতিরিক্ত কমিশন না দেয়ায় আমাদের ব্যবসায় অনেকটাই কমে গেছে। কমিশন বন্ধের প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, বীমাখাতে কমিশন বন্ধ করতে চাইলে এ মার্কেট নন-ট্যারিফ করা প্রয়োজন। এখন যেখানে ট্যারিফ রেইটের উপর কমিশন দিয়ে ব্যবসা করছে নন-ট্যারিফ হলে তখন সকলেই নিজেই রেইট নির্ধারণ করে ব্যবসা করবে। যে রেইট নির্ধারণ করবে তাতেই রি-ইন্স্যুরেন্স করে ক্লেইম পরিশোধ করতে হবে। তখন কোম্পানির সক্ষমতা যাচাই হবে। যাদের সক্ষমতা বেশি থাকবে তারাই ব্যবসা করে টিকে থাকবে। তখন অতিরিক্ত কমিশন দেয়ার প্রবণতা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। এখন যে ট্যারিফ রেইটে অতিরিক্ত কমিশন দেয়া হয় সেটাকে ‘কালো টাকা’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, এ সমস্যা সমধানকল্পে মার্কেটকে নন-ট্যারিফ করতে হবে, অতিরিক্ত কমিশন বন্ধে আইন বাস্তবায়ন, পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি-নৈতিকতার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা খাজা মানযার নাদিম বলেন, বর্তমানে বীমাখাতে অতিরিক্ত কমিশন একটি মেজর সমস্যা। এ সমস্যার কারণে আমাদের ব্যবসা অনেক কমে গেছে। তবে অতিরিক্ত কমিশন দিয়ে যেন ব্যবসা করা না হয় সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া আছে। অতিরিক্ত কমিশনের বন্ধের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশের ৪৬টি বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা যদি এক প্ল্যাটফর্মে কাজ করেন, তাহলে অতিরিক্ত কমিশন দেয়ার প্রবণতা রোধ করা সম্ভব। আমরা সবাই যদি বলি, কোনোভাবেই অতিরিক্ত কমিশন দিয়ে ব্যবসা করবো না তাহলে কেউ আমাদের থেকে জোর করে কমিশন নিতে পারবে না। এখানে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন, তাহলেই কেবল অতিরিক্ত কমিশন দেয়ার প্রবণতা রোধ করা সম্ভব হবে।
গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, দেশের অধিকাংশ বীমা গ্রাহকই এখনো বীমা সম্পর্কে সচেতন নয়। তাদেরকে বীমা বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার। গ্রাহক যে বীমা করে তা থেকে কি কি সুবিধা পাচ্ছেন সে সম্পর্কে তাদেরকে ওয়াকিবহাল করলে বীমা গ্রাহকগণ তাদের প্রয়োজন অনুসারে ঝুঁকি আবরিত করতে পারবেন। বীমা করার পূর্বে প্রস্তাবপত্রে (চৎড়ঢ়ড়ংধষ ঋড়ৎস) বীমা গ্রাহকের নিকট থেকে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। সঠিক তথ্য না পাওয়া গেলে বীমা পলিসি ভুল হয় ফলে দাবি নিস্পত্তিতে নানা জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। বীমা পলিসি সঠিক তথ্য নিয়ে নিয়ম মোতাবেক করলে যে কোন ধরনের দাবী নিস্পত্তিতে কোন সমস্যর সৃষ্টি হয় না। অতিরিক্ত কমিশন বন্ধের বিষয়ে তিনি বলেন, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সেন্ট্রাল সফটওয়্যারের মাধ্যমে তদারকির ব্যবস্থা আরো জোরদার করা হলে এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এছাড়া, নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষে এখন বীমা বিষয়ে অভিজ্ঞ জনবল রয়েছে যারা বীমাখাতের নানা সমস্যা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আশাকরি শিগগিরই সার্বিক পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি হবে।
অতিরিক্ত কমিশন দেয়ার বিষয়ে আইডিআরএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেন, আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি এর মধ্যে কোম্পানিগুলোকে পরিদর্শন ও অডিটের আওতায় নিয়ে এসেছি। এছাড়া কোনো কোম্পানির বিরুদ্ধে অতিরিক্ত কমিশন দেয়ার অভিযোগ পেলে তদন্ত করছি, তদন্তে প্রমাণ পেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।
Posted ১:১৯ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৫ জানুয়ারি ২০২৩
bankbimaarthonity.com | rina sristy