নিজস্ব প্রতিবেদক | সোমবার, ১১ এপ্রিল ২০২২ | প্রিন্ট | 412 বার পঠিত
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বীমাখাতের প্রতিষ্ঠান ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রথম প্রজন্মের এই বীমা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বীমা আইন লঙ্ঘন করে এক্সিকিউটিভ ভাইস-চেয়ারম্যান নিয়োগসহ নানা চাঞ্চল্যকর অভিযোগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি করপোরেট গভর্ন্যান্স কোড (সিজিসি) সম্পর্কিত বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) আইন এবং ব্যবস্থাপনা ব্যয় সম্পর্কিত আইডিআরএ’র নির্দেশনা অমান্য করে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকির পাশাপাশি বীমা গ্রাহকদের অনিশ্চিত ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। এছাড়া পরিচালকদের পর্যাপ্ত শেয়ারধারণ না করা এবং একই পরিবার থেকে দুইয়ের অধিক পরিচালক মনোনীত করে বারবার বীমা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বীমা আইনের তোয়াক্কা না করে ‘ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে’ এক্সিকিউটিভ ভাইস-চেয়ারম্যান পদে গোলাম রহমান নামে একজনকে নিয়োগ দিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উক্ত কোম্পানির চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে। এছাড়া এই দুই রহমান মিলে সংঘবদ্ধভাবে নানা অনিয়ম করে যাচ্ছে দিন পর দিন। বীমা আইনে এক্সিকিউটিভ ভাইস-চেয়ারম্যান নামে কোনো পদের উল্লেখ নেই। কোম্পানির চেয়ারম্যান নিজ কার্যসিদ্ধির স্বার্থে মনগড়া পদ সৃষ্টি করে গোলাম রহমানকে নিয়োগ দিয়ে নিয়মিত বেতন, ইনেসেনটিভ বোনাস, গাড়ির সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদনের কোথাও গোলাম রহমান নামক ব্যক্তির উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। অথচ প্রতিষ্ঠানের এক্সিকিউটিভ ভাইস-চেয়ারম্যান গোলাম রহমান একচ্ছত্র ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজের আধিপত্য বিস্তাররের মাধ্যমে কোম্পানির বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের প্রচণ্ড চাপে রেখে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন নানা কৌশলে।
কে এই এক্সিকিউটিভ ভাইস-চেয়ারম্যান গোলাম রহমান
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গোলাম রহমান ‘ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে’ ১৯৯৪ সালে ১ ডিসেম্বর ডিরেক্টর প্ল্যানিং পদে একজন চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতিতে তিনি বীমা আইন লঙ্ঘন করে ধারাবাহিকভাবে কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক (ইডি), প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এবং পরিচালক পরিকল্পনা হিসেবে কাজ করেছেন। তৎকালীন সময়ে তিনি বীমা আইন লঙ্ঘন করে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদ ধারণ করে ছিলেন। দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে প্রতি ২ থেকে ৩ বছর পর পর চুক্তি নবায়নও করেছেন। ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন বছরের জন্য পরিচালনা পর্ষদের ১৩৬তম পর্ষদ সভায় তার সর্বশেষ নিয়োগ চুক্তি নবায়ন করা হয়। এরপর হঠাৎ বীমা আইন লঙ্ঘন করে ২০১৩ সাল ১ সেপ্টেম্বর থেকে গোলাম রহমানকে এক্সিকিউটিভ ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ বিষয়ে কোনো প্রকার চুক্তি নবায়নের প্রয়োজনও হয়নি। পরবর্তীতে পরিচালনা পর্ষদের ১৫০তম বোর্ডসভায় কোনো প্রকার এজেন্ডা ছাড়াই তাকে নির্বাহী পরিচালক থেকে নির্বাহী ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
বীমা আইন ২০১০-এর ধারা ৭৯ অনুসারে, ‘বীমাকারীর সংঘবিধিতে যা কিছুই থাকুক না কেন, বীমাকারীর পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও সহ-সভাপতি পরিচালকদের মধ্যে হতে নির্বাচিত হবেন। শর্ত থাকে পরিচালনা পর্ষদে একজনের অর্ধিক সহ-সভাপতি থাকবে না। বীমা আইন ২০১০-এর ধারা ৮১-অনুসারে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে ২ জন উপদেষ্টা নিয়োগ দিতে পারবেন। তবে উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্ধারিত দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকবে, যা তাকে প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে।’ বীমা আইনে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা সত্ত্বেও গোলাম রহমানকে নিয়োগের ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করে এক্সিকিউটিভ ভাইস-চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে খাত-সংশ্লিষ্টদের হতবাক করেছেন কোম্পানির চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান।
আরো অভিযোগ রয়েছে, এক্সিকিউটিভ ভাইস-চেয়ারম্যান গোলাম রহমান কোম্পানিতে যোগদানের পর থেকে কোম্পানির কোনো নথিতে স্বাক্ষর করেন না। তার মৌখিক নির্দেশই কোম্পানি যাবতীয় কার্যক্রম চলছে। তিনি পে-রোল চ্যানেল ছাড়াই তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা মাসিক বেতন নিচ্ছেন এবং একজন পরিচালকের মতো বোর্ড এবং কমিটির মিটিং ফিও নিচ্ছেন। তিনি দুটি গাড়ি সুবিধা এবং অন্যান্য ভাতা ভোগ করেন। প্রতিষ্ঠানটিতে ভাইস-চেয়ারম্যানের পদ না থাকলেও এক্সিকিউটিভ ভাইস-চেয়ারম্যান নব্বই-ঊর্ধ্ব বয়সের এক ব্যক্তিকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বীমাখাত-সংশ্লিষ্ট কোনো আইনেই এক্সিকিউটিভ ভাইস-চেয়ারম্যান নামে কোনো পদ নেই। এই পদ সৃষ্টি করে তার বিপরীতে বেতন-ভাতা প্রদান বাবদ প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা সরিয়ে বছরের পর বছর মানিলন্ডারিং করছে।
এছাড়া কোম্পানির চেয়ারম্যান নিজেও কোম্পানি আইন লঙ্ঘন করে চেয়ারম্যান পদ ধারণ করে রয়েছেন। তিনি একই সাথে দুটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। যা কোম্পানি আইনের ১০৮(১) (জ) ধারা অনুযায়ী এবং ২০১৮ সালের করপোরেট গভর্ন্যান্স কোড অনুযায়ী একটি কোম্পানির চেয়ারম্যান পদে থেকে কোনো ব্যক্তি অন্য একটি কোম্পানির পরিচালক বা চেয়ারম্যান হতে পারেন না। তা সত্ত্বেও আইন লঙ্ঘন করে তিনি ‘ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স ও ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের’ চেয়ারম্যানের পদ ধারণ করে আছেন। পাশাপাশি তিনি ‘ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সে’ গোলাম রহমানকে গত নয় বছর ধরে নিয়োগবিহীন ভাইস-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টদের মতে, অভিযোগগুলোর সঠিক তদন্ত হলে, গোলাম রহমানের বিরুদ্ধে কোম্পানির কি পরিমাণ অর্থ মানিলন্ডারিং করা হয়েছে তা বেরিয়ে আসবে। তার বিরুদ্ধে আরো নানা অনিয়ম এবং দুর্নীতির চিত্র ফুটে উঠবে। গোলাম রহমানের অপকর্ম প্রতিষ্ঠানের ক্যামেলকো কর্তৃক সাসপেকটেড ট্রান্সজেকশন রিপোর্ট (এসটিআর) ও বিএফআইইউয়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর।
গোলাম রহমান নিজের সুবিধা-বলয়ে কিছু শাখা ব্যবস্থাপক হাতে নিয়ে আর্থিক সুবিধা হাসিলের ঘটনা ঘটাচ্ছে। কোম্পানিতে নিজের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়োগ-বাণিজ্যও করে যাচ্ছে। আর এ নিয়োগের মাধ্যমে তিনি তার গ্রামের অনেক অযোগ্যলোককে বিভিন্ন পদে পদায়ন করেছেন। নিজের দল ভারী করেছেন এবং তাদের থেকে নিয়োগের মাধ্যমে নানা আর্থিক সুবিধাও গ্রহণ করেছেন। গোলাম রহমানের ভাতিজি কোম্পানিতে একটি শাখায় নিয়োগ পেলেও তিনি ওই শাখায় যান না। অথচ বেতন-ভাতাদি ঠিকই গ্রহণ করছেন। এছাড়া তার ভাতিজা ইন্টারনাল অডিট অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিলেও তিনি কোনোদিন অডিট করার জন্য যাননি।
এক গোলাম রহমানই কোম্পানিতে একের পর এক দুর্নীতি করে কোম্পানিকে দেউলিয়ার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। নিয়োগবিহীন এই ব্যক্তির বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ। কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের ঘাটতিসহ নানা অনিয়মের মহড়া প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে। আরো জানা যায়, গোলাম রহমান বিভিন্ন কোম্পানির কোটি কোটি টাকা দাবি পরিশোধের নামে পকেটস্থ করেছেন। তিনি কোম্পানির বিভিন্ন শাখা ব্যবস্থাপকদের দিয়ে ক্লেইম করিয়ে সেই টাকা নিজে আত্মসাতের পাশাপাশি কোম্পানির চেয়ারম্যানকেও কোটি কোটি টাকার সুবিধা দিয়েছেন এমন অভিযোগও রয়েছে। কোম্পানি দীর্ঘ ৩৪ বছর বয়সে ২৬ বছরে মাত্র ৬৪ কোটি টাকার দাবি পরিশোধ করেছেন। অথচ এ গোলাম রহমান এক্সিকিউটিভ ভাইস-চেয়ারম্যান পদ ধারণের পর থেকে ১০ বছরে ২৭০ কোটি টাকার দাবি পরিশোধের তথ্য পাওয়া গেছে। যার অধিকাংশ গোপন আঁতাতের মাধ্যমে গোলাম রহমান সিন্ডিকেট ও কোম্পানির চেয়ারম্যান সুবিধা হাসিল করে চলেছে।
সূত্র মতে, কোম্পানি যে প্রিমিয়াম আয় তার অধিকাংশ রি-ইন্স্যুরেন্স করতে হয়। গোলাম রহমানের এ চক্রের কারণে এখন রি-ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো তাদের সাথে লেনদেন করতে অপারগতা প্রকাশ করছে বলেও অভিযোগ উঠছে। কারণ অনেক ভুয়া দাবি পেশ করে রি-ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে দাবি পরিশোধ করে নিজেরা সে টাকা আত্মসাৎ করে। প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়ে গোলাম রহমানের নামে আলাদা দফতর দেয়া হয়েছে। তার নাম ও পদবি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। পদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাকে এক্সিকিউটিভ ভাইস-চেয়ারম্যান দেয়া হয়েছে।
এছাড়া অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের নামেও কোম্পানি থেকে হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। আইডিআরএর সার্কুলার অনুসারে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের যে নির্দেশনা রয়েছে, তা লঙ্ঘন করে ২০২০ সালে ৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ও ২০১৯ সালে প্রায় ৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা অতিরিক্ত খরচ করেছে। এই অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের ফলে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে বলে খাত-বিশ্লেষকরা অভিমত ব্যক্ত করেন।
অনিয়ম, দুর্নীতির বিষয়ে কোম্পানির বর্তমান মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল হক এফসিএ’র কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমাদের রেগুলেটরি অর্থরিটি বোর্ড আছে তারা তা দেখবে। গোলাম রহমানের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি তার সম্পর্কে মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
Posted ১২:১৮ অপরাহ্ণ | সোমবার, ১১ এপ্রিল ২০২২
bankbimaarthonity.com | rina sristy