বিশেষ প্রতিবেদক | রবিবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩ | প্রিন্ট | 442 বার পঠিত
শ্রম আইন লঙ্ঘন করে ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের কর্মীদের। প্রতিষ্ঠানটিতে পরিচালক নিয়োগ এবং মূলধন ও শেয়ারধারণ সম্পর্কিত বীমা আইন, বিনিয়োগ সংক্রান্ত সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন, স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ সংক্রান্ত কর্পোরেট গর্ভন্যান্স কোড লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটিতে শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল (ডব্লিউপিপিএফ), শ্রমিক কল্যাণ তহবিল ও শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলে মুনাফার টাকা জমা পড়েনি বছরের পর বছর। কিন্তু শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে মুনাফার ৫ শতাংশ বছর শেষ হওয়ার ৯ মাসের মধ্যেই শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল, কল্যাণ তহবিল এবং শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অথচ নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্স ধারাবাহিকভাবে মুনাফা করলেও বিআইএ প্রেরিত একটি চিঠির অজুহাতে ২০২১ সাল থেকে ডব্লিউপিপিএফ, শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠন, বিতরণ ও শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলে অর্থ জমা দেয়ার বৈধতাও অস্বীকার করছে।
নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২২ এর ৮৯ ও ৯০ পৃষ্ঠায় নোট ৩.১৭ (এমপ্লয়মেন্ট বেনিফিটস্(আইএএস-১৯), শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল, শ্রমিক কল্যাণ তহবিল ও শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল গঠনের কথা স্বীকার করা হয়। নোটে আরও উল্লেখ করা হয়, বিআইএ’র পক্ষ থেকে গত ২ জুন ২০২১ শেখ কবির হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠি ন.- ৫৩.০৩.০০০০.০৭৫.২২.২৯.২০২১.৩০ বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র মাধ্যমে ডব্লিউপিপিএফ, শ্রমিক কল্যাণ তহবিল ও শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল হতে অব্যাহতি চেয়ে অর্থমন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। অথচ অর্থমন্ত্রণালয় আবেদন মঞ্জুর না করলেও শুধু আবেদনপত্র গ্রহণের অজুহাতে আইন পরিপালনের প্রয়োজনীয়তাই চেপে যাচ্ছে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্স ।
এদিকে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) চিঠির উদ্ধৃতি দিয়ে বীমা খাতে ডব্লিউপিপিএফ পালন না করা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ড. মোল্লা জালাল উদ্দিনের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, জাতীয় সংসদে পাশকৃত আইন পরিপালন না করে বিআইএ’র চিঠির দোহাই দেয়া আইনসঙ্গত নয়। তিনি বলেন, বিআইএ’ প্রেরিত চিঠিকে জাতীয় সংসদে পাশকৃত আইনের চেয়ে বড় করে দেখার উপায় নেই। যদি তা করা হয় তা হবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। শ্রমিকদের কল্যাণে এই তহবিল গঠন ও পরিপালন বাধ্যতামূলক। অর্থনৈতিকভাবে শ্রমিকরা উপকৃত হলে জাতীয় অর্থনীতিও এগিয়ে যাবে। এছাড়া, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ডব্লিউপিপিএফ পরিপালনে জোর তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে। তাই বীমা খাত এই আইন থেকে অব্যাহতি না পাওয়া পর্যন্ত তা পরিপালনের জন্য তিনি সকলকে আহ্বান জানান। তিনি আরো জানান, ২০২২ সালের ১৮০০ প্রতিষ্ঠানকে এই আইন পরিপালনের জন্য চিঠি ইস্যু করা হয়। এছাড়া আইন বাস্তবায়নে কল-কারখানা পরির্দশন অধিদপ্তরকে আরো কঠোর হওয়ার জন্য তিনি অনুরোধ করবেন বলে জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (২০১৩ সালে সংশোধিত) এর ১৫ অধ্যায়ের ২৩৪ ধারা অনুযায়ী, কোম্পানিগুলিকে অবশ্যই অংশগ্রহণ তহবিল, কল্যাণ তহবিল ও শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। শ্রম আইনের ২৩২(১) (ক) ও (খ) ধারা অনুযায়ী হিসাব বছরের শেষ দিনে পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ অন্যূন এক কোটি টাকা কিংবা স্থায়ী সম্পদের মূল্য অন্যূন দুই কোটি টাকা হলে কোম্পানি নিট মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে প্রদান করবে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিলে, ১০ শতাংশ কল্যাণ তহবিল এবং অবশিষ্ট ১০ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলে যাবে। এছাড়া, শ্রম আইনের ২(৪১)(গ) ধারা অনুযায়ী বীমা কোম্পানি শ্রম আইনের অন্তর্ভুক্ত। আবার ২০১৩ সালে শ্রম আইনের যে সংশোধনী হয়েছে সেখানে ধারা ২(৬১)(থ)-তে বীমা কোম্পানিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা আগে ছিল না। এছাড়া, ধারা-২৩৬ এ আইন পরিপালন না করা হলে তার শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এতে দেখা যায়- “কোম্পানির প্রত্যেক পরিচালক, উহার ব্যবস্থাপক বা ব্যবস্থাপনার কাজের সাথে জড়িত যে কেউ অথবা ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান বা সদস্য ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে অনধিক ১ লাখ টাকা এবং ব্যর্থতার প্রথম তারিখের পর থেকে প্রতিদিনের জন্য ৫ হাজার টাকা জরিমানা আরোপ করে ৩০ দিনের মধ্যে জরিমানা পরিশোধের জন্য সরকার নির্দেশ প্রদান করতে পারে। পুনরায় কোনোরূপ আইনের বিধান অথবা সরকারের আদেশ পালনে ব্যর্থ হলে তাহার বিরুদ্ধে দ্বিগুণ জরিমানা আরোপিত হবে।” এছাড়া, ধারা ২৩৬ উপধারা (৩) এ বলা হয়েছে, ’’ধারা ২৩৪ অধীন প্রদেয় কোন অর্থ অপরিশোধিত থাকলে এবং এই ধারার অধীন আরোপিত জরিমানা, সংশ্লিষ্ট আদেশে উল্লিখিত তারিখের মধ্যে পরিশোধ করা না হলে উক্ত অপরিশোধিত অর্থ ও জরিমানা সরকারি দাবি হিসেবে গণ্য হবে এবং এটা পাবলিক ডিমান্ডস রিকভারি অ্যাক্ট, ১৯১৩ (অ্যাক্ট নং. ৯ এর ১৯১৩) এর বিধান অনুযায়ী আদায়যোগ্য হবে।”
এদিকে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের শ্রম আইন পরিপালনে অনিহার বিষয়ে খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, আইন যেহেতু রয়েছে সেটা অবশ্যই পরিপালন করতেই হবে। আইন লঙ্ঘন করে কেউ রক্ষা পায়নি, ভবিষ্যতেও পাবে না, সেটা নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্স হোক বা অন্য কোনো কোম্পানি। শ্রম আইন প্রণয়নের এক মাসের মধ্যে আইন পরিপালনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছরেও তা করতে পারেনি নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরন্স কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন যাবৎ ডব্লিউপিপিএফ পরিপালন না করে হঠাৎ করে ২০২১ সাল থেকে বিআইএ’র চিঠি কথা বলে আইন লঙ্ঘনের পক্ষে যুক্তি দেখাচ্ছে। তারা আরো বলেন, জাতীয় সংসদে পাশকৃত আইন থেকে বিআইএ’র চিঠি বড় নয়। যেহেতু শ্রম মন্ত্রণালয় বীমা কোম্পানিগুলোকে এই ধারা থেকে অব্যাহতি দেয়নি, সেক্ষেত্রে এই আইন পরিপালন না করা আইনসঙ্গত নয়। এই আইন পরিপালন না করে রাষ্ট্রের আইনকে চ্যালেঞ্জ ছোড়ার দুঃসাহস দেখানো সমীচীন নয়।
তারা আরো বলেন, বিভিন্ন সময়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো শ্রম আইন পরিপালন না করার বিষয় জানিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) চিঠি দেয় শ্রম ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। বিএসইসি ঐ চিঠির প্রেক্ষিতে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দিলেও টনক নড়েনি অনেক কোম্পানির। এছাড়া, শ্রমিক অংশ গ্রহণ তহবিলের অর্থ জমা না দেওয়ায় নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ফেইম্স অ্যান্ড আর তাদের অ্যামফেসিস অব ম্যাটারে এ বিষয়ে আপত্তি তুলেছেন। তাদের এই আপত্তিতে কোম্পানি সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতেও ব্যর্থ হয়েছ মর্মে উল্লেখ রয়েছে।
শ্রম আইনের ২৩৬ ধারা সম্পর্কে আইনজ্ঞরা বলেন, নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সে ফান্ড ও ট্রাস্টি বোর্ড গঠন না করায় কন্টিনজেন্ট লায়াবিলিটি হিসেবে ২০২২ সাল পর্যন্ত মোট ১৬ বছরে ১৮ জন পরিচালককে (স্বতন্ত্র পরিচালকসহ) এককালীন ১৮ লাখ টাকা ও প্রতিদিনের জন্য ৫ হাজার টাকা হিসেবে এ পর্যন্ত কোম্পানির জরিমানার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর আগে ২০২০ ও ২০২১ সালেও এমনটি ঘটেছে বলে প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়।
এদিকে শ্রম আইন লঙ্ঘন করায় উক্ত আইন অনুসারে প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক জরিমানার কবলে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিনিয়োগকারীরা। এতে তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার পাশাপাশি কোম্পানি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ারও আশংকা করছেন। তারা বলেন, কর্মীদের সন্তুষ্টি একটি প্রতিষ্ঠানের উন্নতি নির্ভর করে। কর্মীদের ঠকিয়ে কোন প্রতিষ্ঠান টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারে না। তাই আইন মেনে চলা ও কর্পোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠাই উত্তম পন্থা। তারা বার্ষিক প্রতিবেদনের বিষয় উল্লেখ করে বলেন, প্রতিষ্ঠানটিতে কোম্পানি সচিব, প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা, স্বতন্ত্র পরিচালক ও অভ্যান্তরীণ নিরীক্ষক রয়েছে। তারা কোনভাবে ডব্লিউপিপিএফ পরিপালনে পরিচালনা পর্ষদকে এর বাধ্যবাদকতা ও গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছে না। যার ফলে বছরের পর বছর প্রতিষ্ঠানটিতে ডব্লিউপিপিএফ পরিপালনের কোন বালাই নেই।
শ্রম আইন পরিপালনে অনিহার বিষয় জানতে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ও কোম্পানি সচিব এর ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে কোম্পানি সচিবকে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
Posted ৮:৫৯ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩
bankbimaarthonity.com | rina sristy