মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১০ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভুয়া অ্যাকাউন্টে এসবিসির ৫ কোটি টাকা উত্তোলন

ন্যাপলো চাকমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার সুযোগ নেন কাশেম

আবুল কাশেম কবিরাজ   |   মঙ্গলবার, ০৪ জানুয়ারি ২০২২   |   প্রিন্ট   |   281 বার পঠিত

ন্যাপলো চাকমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার সুযোগ নেন কাশেম

জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্টে টানা ১০ বছর ধরে সাধারণ বীমা করপোরেশনের (এসবিসি) প্রিমিয়ামের ২৬ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এসবিসির নিউমার্কেট শাখার সাবেক ম্যানেজার মো. আবুল কাশেমের নেতৃত্বে একটি চক্রের ২৬ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য চলছে নানা তৎপরতা।

ওই ঘটনায় দুদকের চার্জশিটভুক্ত ৩৫ আসামির মধ্যে একমাত্র মো. আবুল কাশেম বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। চার্জশিটভুক্ত আসামি এসবিসির আরেক শাখা ম্যানেজার জহিরুল ইসলাম এখনো স্বপদে বহাল রয়েছেন। তাকে রক্ষার জন্য এসবিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নানা তদবিরে ব্যস্ত রয়েছেন।

ওই মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিলের পর বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) ৭ বৈজ্ঞিানিক কর্মকর্তা হাইকোর্ট থেকে জামিনে রয়েছেন। এছাড়া এসবিসির শাখা ম্যানেজার জহিরুল ইসলামসহ অপর ২৭ আসামি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। এদিকে আরো অভিযোগ রয়েছে, এসবিসির ইতিহাসে ভুয়া অ্যাকাউন্টে প্রিমিয়ামের মোটা অংকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগেও আমিনবাজার শাখা আরেক ম্যানেজার ‘ন্যাপলো চাকমা’র বিরুদ্ধে ৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের দ্রুত হস্তক্ষেপের ফলে ওই ৫ কোটি আত্মসাতের চূড়ান্ত মুহূর্তে টাকাগুলো উদ্ধার করা হয়েছিল।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রায় ১৫ বছর আগে ঢাকার আমিনবাজারে এসবিসির শাখার তৎকালীন ম্যানেজার ‘ন্যাপলো চাকমা’র বিরুদ্ধে ভুয়া অ্যাকাউন্টে বিটিসিএলের বীমার প্রিমিয়ামের প্রায় ৫ কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। ওই সময় সোনালী ব্যাংক আমিনবাজার শাখায় এসবিসির নামে একটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলেন শাখা ম্যানেজার ‘ন্যাপলো চাকমা’। ওই অ্যাকাউন্টে বিটিসিএলের বীমার প্রিমিয়ামের ৫ কোটি টাকার পে-আর্ডার জমা করেন তিনি। অথচ প্রিমিয়ামের ওই ৫ কোটি টাকা রাজধানীর সোনালী ব্যাংক মালিবাগ শাখায় জমা হবার কথা ছিল। কিন্তু সোনালী ব্যাংক আমিনবাজার শাখায় জমা করা হয়। সোনালী ব্যাংক আমিনবাজার শাখার ম্যানেজার এক চিঠির মাধ্যমে এসবিসির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ৫ কোটি টাকা জমা হবার বিষয়ে অবহিত করেছিলেন। তখন এসবিসি থেকে সোনালী ব্যাংকের আমিনবাজার শাখাকে জবাবে বলেন, ওই অ্যাকাউন্টটি এসবিসির অনুমোদিত নয়।

এদিকে এসবিসির তৎকালীন শাখা ম্যানেজার ‘ন্যাপলো চাকমা’ গোপনে ৫ কোটি উত্তোলনকালে ধরা পড়েন। সোনালী ব্যাংক আমিনবাজার শাখা ম্যানেজার তাকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন। আরো অভিযোগ রয়েছে, সোনালী ব্যাংক থেকে আটকের এসবিসি কর্তৃপক্ষের রহস্যজনক নীরবতা এবং বিভাগীয় পদক্ষেপ না নেয়ায় সহজেই পারপেয়ে যান অভিযুক্ত ‘ন্যাপলো চাকমা’। তিনদিন পুলিশ হেফাজতে থাকার পর তিনি সহজেই মুক্তি পান। শুধু তাই নয়, ‘ন্যাপলো চাকমাকে’ স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে যাবতীয় পাওনা নিয়ে অবসরে যাবার বিষয়েও সহযোগিতার নজির স্থাপন করেছেন এসবিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সূত্র মতে, ‘ন্যাপলো চাকমার’ বিরুদ্ধে এসবিসি থেকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করায়, ২০১০ সাল থেকে টানা ১০ বছর ধরে এসবিসির নিউমার্কেট শাখার ম্যানেজার আবুল কাশেম ফ্রি স্টাইলে রাজধানীর ইমামগঞ্জে এক্সিম ব্যাংক শাখায় ভুয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ২৬ কোটি টাকা আত্মসাতের সুযোগ পেয়েছেন। অভিযুক্ত আবুল কাশেম ও আরেক শাখা ম্যানেজার জহিরুল ইসলামকে পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে এসবিসির সহযোগিতা পাচ্ছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এক পর্যায়ে এ দুই আসামিসহ ৩৫ জনই নানা ফাঁকফোকরে পার পেয়ে যাচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে এসবিসিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেই।

এদিকে এসবিসির ডিজিএম মো. জাকির হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন, প্রায় ১৫ বছর আগে সোনালী ব্যাংকের আমিন বাজার শাখা থেকে এসবিসির নামে করা একটি অ্যাকাউন্টে ৫ কোটি টাকা জমা করার বিষয়ে এসবিসির উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়ে এক চিঠি পাঠিয়ে ছিলেন। সোনালী ব্যাংকের ওই চিঠির পর এসবিসির টনক নড়ে ছিল। কারণ সোনালী ব্যাংক আমিন বাজার শাখায় এসবিসির নামে কোনো অ্যাকাউন্ট খোলেননি কর্তৃপক্ষ। ওই ভুয়া অ্যাকাউন্টের মালিক ছিলেন এসবিসির আমিনবাজার শাখার ম্যানেজার ‘ন্যাপলো চাকমা’। পরে এসবিসি থেকে ব্যাংকের ওই শাখায় দ্রুত যোগাযোগ করে লেনদেন স্থগিত রাখেন।

তিনি আরো বলেন, প্রতারক ‘ন্যাপলো চাকমা’ গোপনে ৫ কোটি টাকা উত্তোলনকালে ধরা পড়েন। সেনালী ব্যাংক ম্যানেজার তাকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন। কিন্তু আটকের তিনদিন পর ‘ন্যাপলো চাকমা’ মুক্তি পান। এরপরে এসবিসির প্রধান কার্যালয়ে আবেদন করে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে চলে যান ‘ন্যাপলো চাকমা’। একইসঙ্গে তার চাকরিজীবনের ২৫ বছরের মাথায় স্বেচ্ছায় অবসর যাবারকালে প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধা পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে এসবিসির পক্ষ থেকে কোন ধরনের আইনি ব্যবস্থা পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি। পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে এরপর এসবিসিও এ প্রতারককে ছেড়ে দিয়েছেন। এছাড়া ‘ন্যাপলো চাকমা’ নিজেই চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন।

তিনি বলেন, যদি ‘ন্যাপলো চাকমা’র বিরুদ্ধে ৫ কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টার ঘটনায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে দ্বিতীয় ঘটনাটি ২৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা আত্মসাতের সাহস পেতেন না এসবিসির নিউমার্কের্ট শাখার ম্যানেজার আবুল কাশেম। আর এসবিসির ফার্মগেট শাখার সাবেক ম্যানেজার জহিরুল ইসলাম অভিযুক্ত আবুল কাশেমর পূর্ব পরিচিত। যারফলে তার সহযোগিতায় প্রিমিয়ামের কয়েকটি বিল ওই শাখায় এন্ট্রি করিয়েছেন। তবে জহিরুল ইসলাম ভালো মানুষ।

এদিকে এসবিসির এজিএম মো. নাসির উদ্দিন দীপ এ প্রতিবেদককে বলেন, ’ন্যাপলো চাকমা’ ওই ঘটনাটি প্রায় ১৫ বছর আগের। তিনি বলেন, ভুয়া অ্যাকাউন্টে এসবিসির ২৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় সাবেক শাখা ম্যানেজার আবুল কাশেমের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছে। তার সম্পদ জব্দ করার জন্য আদালতে এসবিসির পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য নথিপত্র দুদকের কাছে পাঠানো হয়েছে। দুদক মামলা দায়ের করেছে এবং আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে বলে শুনেছেন। এ বিষয়টি এখন বিচারাধীন। যারফলে বেশি কিছু বলা ঠিক হবে না।

সূত্র মতে, ২০১০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর পর্যন্ত এক্সিম ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখার একটি ভুয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এসবিসির প্রিমিয়ামের ২৬ কোটি ১৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন এসবিসির নিউমার্কেট শাখা-৯ এর একজন ম্যানেজার মো. আবুল কাশেম। টানা ১০ বছর ধরে ফ্রি স্টাইলে ক্ষমতার অপব্যবহার, জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যে এসবিসির নামে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রিমিয়ামের ওই অর্থ আত্মসাৎ করেন। কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত আবুল কাশেমকে মাঝে মধ্যে কর্মস্থল পরিবর্তন করেছেন। অবশেষে তাকে এসবিসির প্রধান কার্যালয়ে দিলকুশায় অডিট অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স বিভাগে ম্যানেজারের দায়িত্ব দেন। কিন্তু প্রধান কার্যালয় থেকে এসবিসির শাখ-৯ নিউমার্কেটে বদলি হয়ে যাবার জন্য বারবার তদবির এবং আবেদন জানাতে থাকন। তখনও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি।

১৯৯৯ সালে একজন জুনিয়র অফিসার হিসেবে এসবিসিতে চাকরি যোগদান করেন এ আবুল কাশেম। তিনি দ্রুত পদোন্নতির পাশাপাশি এসবিসির ৩, ৪ এবং ৯ নম্বর শাখায় (নিউমার্কেট) ম্যানেজারের দায়িত্ব পেয়ে যান। এরপর এসবিসির প্রধান কার্যালয়ে দিলকুশায় অডিট অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স বিভাগে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন।

২০২০ সালের অক্টোবরের অভিযোগের সততা যাচাই করার জন্য এসবিসির পক্ষ থেকে ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার খসরু দস্তগীর আলমকে আহ্বায়ক এবং ম্যানেজার মিনিময় চাকমা, সহকারী ম্যানেজার মো. নাজিম উদ্দিন ও সহকারী ম্যানেজার মো. ইব্রাহিমের সমন্বয়ে চার সদস্যের একটি বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়ে। এ কমিটি ২০২০ সালে ১২ অক্টোবর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে তিন সদস্যের একটি তদন্ত বোর্ড গঠন করা হয় এবং অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট আবুল কাশেমকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

দুদকের সহকারী পরিচালক সিরাজুল হক বাদী হয়ে ২০২০ সালে ৯ নভেম্বর এসবিসির নিউমার্কেট শাখা-৯ এর সাবেক ম্যানেজার মো. আবুল কাশেমের বিরুদ্ধে ফৌজদারি দন্ডবিধি ৪০৯/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ৫(২) ও ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২) ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন। গত ২৯ জুলাই প্রধান আসামি আবুল কাশেমকে গ্রেফতার করে দুদক। দুদক তদন্ত করে এসবিসির সাবেক আবুল কাশেম ও তার স্ত্রী নাসরিন আক্তার, এসিবিসির ফার্মগেট শাখার সাবেক ম্যানেজার জহিরুল ইসলামসহ ৩৫ জনের চার্জশিট দাখিল করেছেন। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখার সাবেক ম্যানেজার মুসা আহমেদ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বুয়েট, বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা রয়েছেন।

 

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১:১৮ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৪ জানুয়ারি ২০২২

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।