বিশেষ প্রতিবেদক | বৃহস্পতিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২২ | প্রিন্ট | 226 বার পঠিত
আলোচিত হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রবাসী ৭ পরিচালককে গ্রেফতার কাণ্ড এবং তাদের কারামুক্তির পর এখন কী ঘটছে সেখানে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে কৌতুহলী কোম্পানিটির বিপুল সংখ্যক গ্রাহকসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই। এই ৭ ব্রিটিশ বাংলাদেশিকে গ্রেফতারের নেপথ্যে আসলে কারা ছিল? কারা কলকাঠি নেড়েছিল? কোম্পানির বর্তমান এই নাজুক পরিস্থিতিতে গ্রাহকের কোটি কোটি টাকার আমানতের দায়িত্ব এখন কারা কাধে তুলে নিবেন? সেই প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে হোমল্যান্ড লাইফের বিপুল সংখ্যক গ্রাহকের মনে? কোম্পানিটির বর্তমান অচলাবস্থা নিয়ে চিন্তিত খোদ বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। তবে এই দুশ্চিতার মধ্যেও কিছুটা হলেও আশার আলো নিয়ে এসেছেন প্রবাসী ৭ পরিচালক। কারামুক্তির পরপরই (২ অক্টোবর) রোববার হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয়ে আসেন প্রবাসী পরিচালকরা। প্রধান কার্যালয়ে তারা কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করে মিটিং করেন। তবে পরিচালকরা আসার আগেই অফিস ত্যাগ করেন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুলহাস । প্রবাসী সাত পরিচালক ছাড়াও আরেক পরিচালক মোহাম্মদ শামীম আহমদ মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন।
মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডল, কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ আলী মিয়াসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এ সময় অফিসে ছিলেন। মিটিংয়ের বিরতিতে কোম্পানির পরিচালক মোঃ আবদুর রবের কাছে সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতির পক্ষ থেকে জানতে চাইলে এ বিষয়ে সোমবার বিস্তারিত জানানোর কথা বলেন তিনি। একই কথা জানান আরেক পরিচালক মোহাম্মদ শামীম আহমদ। কোনো বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডল।
এরপর সোমবার সকাল থেকে আবারও মিটিংয়ে বসেন প্রবাসী ৭ পরিচালক। তবে ওই মিটিংয়ে শুরু থেকেই উপস্থিত ছিলেন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুলহাস, পরিচালক হোসনে আরা নাজ, পরিচালক মোহাম্মদ শামীম আহমদ। একপর্যায়ে মিটিংয়ে উপস্থিত হন স্বতন্ত্র পরিচালক শওকতুর রহমান ও ইশতিয়াক হোসেন চৌধুরী। কয়েক ঘণ্টা মিটিং চলার একপর্যায়ে চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুলহাস, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডল, কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ আলী মিয়া অফিস ত্যাগ করেন। পরে একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, পরিচালনা পর্ষদের ওই মিটিংয়ে কোম্পানির পরিচালক ব্রিটিশ বাংলাদেশি মোঃ আব্দুর রাজ্জাককে নতুন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ব্রিটিশ বাংলাদেশি মোঃ জামাল মিয়াকে নতুন পরিচালনা পর্ষদের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে প্রস্তাব করে পর্ষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। একইসঙ্গে কক্সবাজারে কোম্পানির উন্নয়ন সংগঠকদের নিয়ে অনুষ্ঠিতব্য বার্ষিক সম্মেলন স্থগিতের ঘোষণা দিতে কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন।
তবে মঙ্গলবার চেয়ারম্যানের আসনে দেখা যায় মোহাম্মদ জুলহাসকে। একই সময়ে ৮ সেপ্টেম্বর বার্ষিক সম্মেলন আয়োজনের সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে বলে ঘোষণা দিতে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন জুলহাস। বার্ষিক এই সম্মেলনে কোম্পানিটির অন্তত ৮শ’ কর্মকর্তা অংশ নেয়ার কথা রয়েছে। কক্সবাজারের এই সম্মেলনে কোটি টাকারও বেশি ব্যয় হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।এখন প্রশ্ন উঠেছে, কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ গঠন নিয়ে যখন তোলপাড় চলছে, ঠিক সেই মুহূর্তে ব্যয়বহুল এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে কী উদ্দেশ্য হাসিল করতে চান মোহাম্মদ জুলহাস?
কয়েকটি বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, হোমল্যান্ড লাইফের পরিচালনা পর্ষদ গঠন নিয়ে ব্রিটিশ বাংলাদেশি পরিচালক ও মোহাম্মদ জুলহাসের সিন্ডিকেটে থাকা পরিচালকদের দুটি পক্ষই এখন মুখোমুখি অবস্থানে। কোম্পানিতে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে পাল্টাপাল্টি পর্ষদ গঠন করে ক্ষমতাসীন বিভিন্ন মহলের আনুকূল্য পেতে এখন জোর তদবিরে উভয় পক্ষ।
মোহাম্মদ জুলহাসের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট কোম্পানিতে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান পদসহ নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর আনুকূল্য পেতে ইতিমধ্যে চেষ্টা তদবির শুরু করেছে। যাতে সহযোগিতা করছেন হোমল্যান্ড লাইফের বহুল বিতর্কিত বিদায়ী মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুল ইসলাম তালুকদার।
এদিকে ব্রিটিশ বাংলাদেশি পরিচালকদের পক্ষও বলছেন, তাদের সাথে প্রশাসন রয়েছে।
তারা ইতিমধ্যে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে রেজুলেশন আইডিআরএ’র কাছে জমা দিয়েছেন।
মোহাম্মদ জুলহাসের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেটও তাদের গঠিত নতুন পরিচালনা পর্ষদের রেজুলেশন আইডিআরএ জমা দিয়েছেন।
তবে এমন পরিস্থিতিতে বীমা খাতের সর্বোচ্চ অভিভাবক সংস্থা আইডিআরএ আসলে কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালনা পর্ষদ নিয়ে এমন টালমাটাল পরিস্থিতিতে নিজেদের আমানত নিয়ে শঙ্কা আর অনিশ্চয়তায় কোম্পানিটির বিপুলসংখ্যক গ্রাহক। এমন পরিস্থিতিতে গ্রাহকের কোটি কোটি টাকার আমানতের দায়িত্ব এখন কারা কাধে তুলে নিবেন সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে।
এসব আমানতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারের দায়িত্বশীল মহলের হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে উঠেছে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
এর আগে গত ২১ সেপ্টেম্বর কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা চলাকালে গ্রাহকদের দায়ের করা মামলায় হোমল্যান্ড লাইফের ৭ ব্রিটিশ বাংলাদেশি পরিচালককে গ্রেফতার করে মতিঝিল থানা পুলিশ। পরে তারা জামিনে বেরিয়ে আসেন। প্রবাসী এই পরিচালকরা হলেন ভাইস চেয়ারম্যান মোঃ জামাল মিয়া, পরিচালক আবদুর রব, পরিচালক মোঃ কামাল মিয়া, পরিচালক মোঃ আবদুর রাজ্জাক, পরিচালক মোঃ আবদুল আহাদ, পরিচালক মোঃ জামাল উদ্দিন এবং পরিচালক মোঃ আবদুল হাই।
সূত্র জানায়, ৭ পরিচালককে গ্রেফতারের দিন কোম্পানির নতুন পর্ষদ গঠনের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। পরিচালকদের গ্রেফতারের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে একাধিক পরিচালক থানার উদ্দেশ্যে অফিস ত্যাগ করেন এবং মিটিং মুলতবি করা হয়। পরের দিন ২২ সেপ্টেম্বরও ওই পরিচালকরা অনুপস্থিত ছিলেন। তা সত্ত্বেও মোহাম্মদ জুলহাসকে চেয়ারম্যান করে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠনের রেজুলেশন করা হয়। ওই রেজুলেশন আইডিআরএ পাঠিয়ে দেয়া হয় বলে ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতিকে টেলিফোনে জানান মোহাম্মদ জুলহাস। তবে ৭ পরিচালককে জেলে রেখে এবং আরো কয়েকজনকে বাইরে রেখে, পরিচালকদের কোরাম অপূর্ণ রেখে কীভাবে নতুন পর্ষদ গঠন করা হলো ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতির এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি মোহাম্মদ জুলহাস।
এমনকি কোম্পানির চেয়ারম্যান বা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে গ্রাহকদের মামলায় কোন যুক্তিতে প্রবাসী ৭ পরিচালক আসামি হলেন বা কেন গ্রেফতার হলেন সেই প্রশ্নেও যথাযথ কোনো উত্তর দেননি জুলহাস।
জানা যায়, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন চেয়ারম্যান ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। তারাই সবকিছু দেখভাল করেন। গত ২১শে সেপ্টেম্বর কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় অংশ নিতে ব্রিটেন থেকে দেশে আসেন সাত প্রবাসী পরিচালক। অংশ নেন কোম্পানির এজিএমে। সেখান থেকেই আচমকা তাদের গ্রেফতার করে মতিঝিল থানা পুলিশ। এরপর আদালতের মাধ্যমে পাঠানো হয় কারাগারে। একসঙ্গে প্রবাসী এই ৭ উদ্যোক্তাকে গ্রেফতারে তোলপাড় চলছে দেশে-বিদেশে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রবাসীরাও। সরকার যেখানে প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে আসছে সেখানে এই বিনিয়োগকারীদের এভাবে গ্রেফতার কী বার্তা দিচ্ছে সেই প্রশ্ন অনেকের। ঘটনাটি স্রেফ মামলা এবং গ্রেফতার হিসেবে দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কোম্পানির লেনদেনের বিষয়ে কেউ মামলা করলে চেয়ারম্যান এবং সিইও’র বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার কথা। তা না করে প্রবাসে থাকেন এমন ৭ উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আর তার পরোয়ানাও হয়েছে। এসব বিষয়ে উদ্যোক্তাদের কোনো তথ্যই দেয়া হয়নি কোম্পানির পক্ষ থেকে। এছাড়া কোম্পানির আরও কয়েকজন পরিচালক থাকলেও তাদের মামলায় আসামি করা হয়নি। সূত্র জানিয়েছে, কোম্পানির একটি বড় অংশের শেয়ার প্রবাসী উদ্যোক্তাদের হাতে। তাদের সরিয়ে দেয়ার জন্যই এই মামলার কৌশল নেয়া হয়েছে। যদিও আসামি পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শফিকুজ্জামান বাচ্চু সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এই মামলার কোনো ভিত্তি নেই। প্রবাসী উদ্যোক্তাদের এভাবে গ্রেফতারও ঠিক হয়নি। কারণ মামলা হলে বর্তমান চেয়ারম্যান এবং এমডি’র বিরুদ্ধে হওয়ার কথা। বিষয়টি আদালতকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, এই মামলা টিকবে না। এটি খারিজ হয়ে যাবে। সিনিয়র এই আইনজীবী মনে করেন এই মামলার পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। দ ৭ প্রবাসীকে গ্রেফতারের পর থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে ব্রিটেনে বসবাসরত প্রবাসীদের মধ্যে। তারা বলছেন, এভাবে প্রবাসী উদ্যোক্তাদের ডেকে নিয়ে দেশে গ্রেফতার করা কী বার্তা দিচ্ছে?যেখানে সরকার বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছে সেখানে এই ঘটনা প্রবাসীদের জন্য নতুন এক বার্তা। অভিযোগ আছে, কোম্পানির নানা অনিয়ম, মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও গ্রাহকের টাকা পরিশোধ না করাসহ আরও বেশকিছু ইস্যুতে এই পরিচালকরা প্রবাসে থেকেও সোচ্চার ছিলেন। কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় নানা অনিয়ম ছিল। অন্যদিকে শীর্ষ পদস্থরা কোম্পানিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। প্রবাসী পরিচালক হওয়াতে তাদের না জানিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে অনিয়ম করে যাচ্ছিলেন শীর্ষ কর্মকর্তারা। এসব বিষয়ে ওই পরিচালকরা প্রতিবাদ করতেন।
বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী ৭ প্রবাসী ব্যবসায়ীকে গ্রেফতারের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে
বিসিএ (বাংলাদেশ ক্যাটারার্স অ্যাসোসিয়েশন) এবং ইউকেবিসিসিআই (ইউকে বাংলাদেশ ক্যাটালিস্ট অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি)। লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে উভয় সংগঠনের নেতৃবৃন্দ প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে যে সকল হয়রানি হন ও হচ্ছেন, তা সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশ সরকারকে অবহিত করে হয়রানি বন্ধের জোর দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে ব্রিটিশ বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের শীর্ষস্থানীয় এই দুই সংগঠনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি দাবি জানানো হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, রহস্যজনক এই গ্রেফতারের সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে, প্রবাসী ব্যবসায়ী যারা বাংলাদেশে ইনভেস্টমেন্ট করাকে প্রমোট করেন, তাদের নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে, অযথা মামলা ও হয়রানি করা থেকে বিরত থাকতে হবে, এবং বাংলাদেশে আলাদাভাবে প্রবাসীদের মামলাগুলো ত্বরিত বিচারের জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করতে হবে।
Posted ১:৩৮ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২২
bankbimaarthonity.com | rina sristy