শুক্রবার ২৯ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

মঞ্জুর-আদিবার কারসাজি; অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়া ডেল্টা লাইফ

প্রশাসকের সফলতা নিয়েও সন্দিহান গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীরা

এস জেড ইসলাম   |   বৃহস্পতিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১   |   প্রিন্ট   |   334 বার পঠিত

প্রশাসকের সফলতা নিয়েও সন্দিহান গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীরা

বাংলায় একটি প্রবাদ রয়েছে ‘সারা গায়ে ঘা ঔষধ লাগাবো কোথায়?’ ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ক্ষেত্রে একই অবস্থা তৈরী হয়েছে। অন্য কোম্পানির মতো সুনির্দিষ্ট একটি, দুটি নয় বরং অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ করেছেন প্রতিষ্ঠান গ্রাহক-বিনিয়োগকারী এবং সাবেক চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা। এমনকি ব্যবসায়িক চুক্তিতে আবদ্ধ ভিন্ন প্রতিষ্ঠানও আইডিআরএর কাছে তাদের অভিযোগ দিয়েছে। আবার বানিজ্যমন্ত্রীর কাছেও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দিয়েছেন অনেকে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে এমন শত অভিযোগের ভিত্তিতে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলে আইডিআরএর কাছে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে পারেনি কোম্পানির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদ। ফলে অনন্যোপায় হয়ে আইডিআরএ যখন প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে সে মুহুর্তে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অবৈধ ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ তোলা হয় কোম্পানির পক্ষে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। বিদায় নিতে হয়েছে সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান পরিচালক মঞ্জুরুর রহমান এবং তার মেয়ে ও কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আদিবা রহমানকে। কিন্তু এতেই কি মুক্তি মিলবে? মঞ্জুর-আদিবার দুর্নীতির দায়ে গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্থ হবে না তো? এটিই এখন বীমা খাতের গ্রাহক-বিনিয়োগকারীসহ বিশ্লেষক ও সচেতন মহলের প্রশ্ন। একই সাথে প্রশাসক দায়িত্ব নিলেও সাবেক পর্ষদের অপকর্মের দায় কতটা পুষিয়ে দিতে পারবেন এ নিয়েও তাদের মাঝে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ: প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ৩৫ কোটি ১৭ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ তুলেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ বিষয়ে ১১ ফেব্রুয়ারি ভ্যাট আইনে মামলা করে এনবিআরের ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর।

কোম্পানির ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আর্থিক প্রতিবেদন তদন্ত করে ভ্যাট ফাঁকির প্রমান পায় ভ্যাট গোয়েন্দার সহকারী পরিচালক সায়মা পারভীনের নেতৃত্বে একটি দল। এ সময় দলিলাদি দাখিলের জন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে তলব করা হয়। প্রতিষ্ঠানের দাখিল করা তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি স্বাস্থ্য বীমার ওপর ৪০ লাখ ৫৫ হাজার ৭৩ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করেছে। কিন্তু প্রদানযোগ্য ভ্যাটের পরিমাণ ছিল ১০ কোটি ২১ লাখ ৩৭ হাজার ৪১১ টাকা। এক্ষেত্রে প্রকৃত বিক্রয় তথ্য গোপন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। সেই হিসাবে অপরিশোধিত ভ্যাট বাবদ ৯ কোটি ৮০ লাখ ৮২ হাজার ৩৩৯ টাকার ফাঁকি উদঘাটন করা হয়েছে। এই ফাঁকির ওপর ভ্যাট আইন অনুসারে মাসভিত্তিক ২ শতাংশ হারে ১১ কোটি ৩০ লাখ ৪০ হাজার ৭৭৮ টাকা সুদ হিসাবে প্রযোজ্য হবে।

প্রতিষ্ঠানটির মোট অপরিশোধিত ভ্যাটের পরিমাণ ১৬ কোটি ২৪ লাখ ২৭ হাজার ৯০৫ টাকা। এর সঙ্গে ১৮ কোটি ৯২ লাখ ৬২ হাজার ৮২৮ টাকা সুদ বাবদ মোট ফাঁকির পরিমাণ ৩৫ কোটি ১৬ লাখ ৯০ হাজার ৭৩৩ টাকা।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ওই সময়ে সিএ ফার্মের রিপোর্ট মোতাবেক উৎসে ভ্যাট ৬ কোটি ৩৪ লাখ ৭ হাজার ৮০৩ টাকা পরিশোধ করেছে কোম্পানি। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির প্রদেয় ভ্যাটের পরিমাণ ছিল ১১ কোটি ৩ লাখ ১৩ হাজার ২৪৯ টাকা। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির অপরিশোধিত ভ্যাট বাবদ ৪ কোটি ৬৯ লাখ ৫ হাজার ৪৪৬ টাকার ফাঁকি উৎঘাটিত হয়েছে।

উৎসে কর্তনের ওপর প্রযোজ্য এই ফাঁকি দেওয়া ভ্যাটের ওপর ভ্যাট আইন অনুসারে মাসভিত্তিক ২ শতাংশ হারে ৫ কোটি ৫৭ লাখ ৭৫ হাজার ১৬৯ টাকা সুদ আদায়যোগ্য হবে। অন্যদিকে তদন্ত মেয়াদে প্রতিষ্ঠানটি স্থান ও স্থাপনার ভাড়ার বিপরীতে ১ কোটি ৪৬ লাখ ১৪ হাজার ৯৮০ টাকা পরিশোধ করেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির প্রদেয় ভ্যাটের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ২০ লাখ ৫৫ হাজার ১০১ টাকা। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির অপরিশোধিত ভ্যাট বাবদ ১ কোটি ৭ লাখ ৪০ হাজার ১২০ টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়েছে। এই ফাঁকির ওপরও ভ্যাট আইন অনুসারে মাসভিত্তিক ২ শতাংশ হারে ২ কোটি ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৮৮১ টাকা সুদ প্রযোজ্য হবে।

অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটির মোট অপরিশোধিত ভ্যাটের পরিমাণ ১৬ কোটি ২৪ লাখ ২৭ হাজার ৯০৫ টাকা। এর সঙ্গে ১৮ কোটি ৯২ লাখ ৬২ হাজার ৮২৮ টাকা সুদ বাবদ মোট ফাঁকির পরিমাণ ৩৫ কোটি ১৬ লাখ ৯০ হাজার ৭৩৩ টাকা।

তদন্তে আরও দেখা যায় যে প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট ফাঁকির উদ্দেশ্যে নানা ধরনের জালিয়াতি ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে, যা ভ্যাট আইন অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এ বিষয়ে ডেল্টা লাইফের প্রশাসক ও আইডিআরএর সাবেক সদস্য সুলতান উল আবেদিন মোল্লা বলেন, যতদূর জেনেছি এটা ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের তথ্যাদি থেকে বেরিয়েছে। এখনও নাকি রাজস্ব বোর্ডের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এক্ষেত্রে অনিয়মের দায় কার উপর বর্তাবে এমন প্রশ্নে বলেন, প্রাথমিকভাবে সব দায়দায়িত্ব কোম্পানির উপরই বর্তাবে। আরো পরে হয়তো যারা সে সময় দায়িত্বে ছিল তাদের উপর পড়বে এর দায়।

এদিকে ভ্যাট ফাঁকি বিষয়ে ডেল্টা লাইফের সাবেক সিইও আদিবা রহমানের সাথে কথা বলতে ফোন করা হয়। তিনি রিসিভ না করায় ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়। পরে ফিরতি বার্তায় তিনি কোম্পানির সিএফও মিল্টন ব্যাপারীর নাম্বার দিয়ে তার সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।

পরে সিএফও মিল্টন ব্যপারীকে ফোন করা হলে তিনি ব্যস্ততার কথা বলে কিছুক্ষণ পরে ফোন দেবেন বলে জানান। কিন্তু প্রায় এক ঘন্টা পেরিয়ে যাবার পরও ফোন না করলে সিইও আদিবা রহমানের সাথে ফের যোগাযোগ করেন এ প্রতিবেদক। এর কিছুক্ষণ পর সিএফও নিজেই এ প্রতিবেদককে ফোন করেন।

ভ্যাট গোয়েন্দার করা মামলার বিষয়ে সিএফও জানান, সরকারের নির্ধারিত পন্থায় আমরা সব সময় ভ্যাট দিয়ে এসেছি। হয়তো তারা এমন কিছু ভ্যাটের আওতায় এনেছে যার ভ্যাট হয় না। সেগুলো কি জানতে চাইলে বলেন, হয়তো ব্যবসা আনতে গিয়ে চা-নাস্তার খরচ, ঝাঁড়ুদারের বিল বা অফিস স্টেশনারী এগুলো হতে পারে। কিন্তু স্বাস্থ্য বীমায় ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে মামলা হয়েছে জানালে বলেন, আমরা এ বিষয়ে এখনো কোন কাগজপত্র পাইনি। আমরা বিভিন্ন পত্রিকার মাধ্যমে মামলার বিষয়ে জেনেছি। ভ্যাট অফিসে যোগাযোগ করলে তারা বলেন তারা আমাদের একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। কিন্তু সেটা আমরা এখনো পাইনি। পেলে হয়তো বলতে পারবো তারা কিসের ভিত্তিতে আমাদের ভ্যাট ফাঁকির মামলা করেছে। তখন আমরা হিসেব করে দেখতে পারবো আসলে এমনটা হয়েছে কিনা?

এদিকে ডেল্টা লাইফের অনিয়ম নিয়ে কথা হয় বর্তমান প্রশাসক সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লার সাথে। তিনি জানান, প্রশাসক হিসেবে আসার পর গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে কাজ করা হবে। আশা করছি তারা উপকৃত হবেন। আর ভ্যাটের যে বিষয়টি রয়েছে সেক্ষেত্রে আমাদের আইনজীবিরা যেভাবে পরামর্শ দিবেন সে অনুযায়ী কাজ করা হবে।

আর্থিক প্রতিবেদনে অসঙ্গতির বিষয়ে বলেন, প্রতিবেদনে যে অসঙ্গতি ছিলো সেগুলো আবার পুন:নীরিক্ষা করা হচ্ছে। আর একই পরিবারের হাতে ২২ শতাংশ শেয়ার ধারণের যে বিষয়টি রয়েছে এটা দেখবে আইডিআরএ এবং এসইসি। তবে আমরা আমাদের প্রতিবেদনে বিষয়টি উল্লেখ করবো।

এদিকে ভবন ক্রয়ের ক্ষেত্রে আবেদ হোল্ডিংসের দাবীকৃত পাওনার বিষয়ে বলেন, এটা আমি পরীক্ষা করে দেখবো। তাদের দাবীর পরিমান ঠিক আছে, নাকি কম বেশি আছে দেখা হবে। আমাকে কোম্পানির স্বার্থও দেখতে হবে। পাশাপাশি পাওনাদারের পাওনা আইনগতভাবে দিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবো। আমি আইনী পরামর্শ অনুযায়ী বিষয়গুলো দেখভাল করবো।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১১:১৯ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০৩১  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।