কামারুন-নাহার-মুকুল : | বৃহস্পতিবার, ২০ আগস্ট ২০২০ | প্রিন্ট | 809 বার পঠিত
জীবন বীমাকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করে শ্রম, নিষ্ঠা ও সুদূরপ্রসারি দৃষ্টিশক্তি দ্বারা এই শিল্পের বিকাশে যারা বিশেষ অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম মুস্তাফিজুর রহমান খান। এই ক্ষণজন্মা পুরুষ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ১৯১০ সালের ১০ জুন ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জে অভিজাত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার ছিল ধর্মপ্রাণ। এজন্য তার শিক্ষার সূচনা মক্তবে। তিনি সুবেদার ইসলাম খানের একাদশ অধস্তন পুরুষ এবং মতিউর রহমান খান ও সালেকুন্নেসার দ্বিতীয় পুত্র। বাবা পেশায় ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর। তিনি ছিলেন তৎকালীন একজন কবি ও সাহিত্যিক। তার সাহিত্যকর্ম ছিল সমাজচেতনার নির্দেশক। এ পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে আসীন ছিলেন। তারা সরকারি চাকুরে হয়েও কোনোদিন ব্রিটিশ বা পাকিস্তান সরকারের পদলেহী ছিলেন না- এটাই ছিল তাদের বৈশিষ্ট্য।
মুস্তাফিজুর রহমান খান মাত্র ১৯ বছর বয়সে ১৯২৯ সালে একটি ইংলিশ স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় মেধাতালিকায় অষ্টম স্থান পেয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। শিক্ষার গতি সহজ পথেই চলার কথা ছিল; কিন্তু তা তার জীবনে হয়নি। তার শিক্ষাজীবনের অগ্রগতি আকস্মিকভাবে ব্যাহত হয়। অনেকের মতো তিনিও ঝাঁপিয়ে পড়েন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে। পুলিশের নজরে পড়েন, যা পুলিশি নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয়। পেশাগতভাবে তিনি রাজনীতিবিদ না হলেও তার কাজকর্মে রাজনৈতিক সচেতনতার প্রতিফলন ঘটেছে।
১৯৩০ সালে চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন দলে মাস্টারদা সূর্যসেনের সাথেও একযোগে কাজ করেছেন। শিক্ষাজীবনে ব্যাঘাত ঘটায় পরিবারের সাথে মনোমালিন্যের জেরস্বরূপ কিশোর মুস্তাফিজুর রহমান নিজের ভাগ্য গড়ার অন্বেষণে মায়ের আঁচল এবং পিতার সংশ্রব ত্যাগ করে কলকাতায় পাড়ি জমান। জীবনের প্রারম্ভে সে যুগে সাংবাদিকতার মতো অনিশ্চিত পেশাকে জীবিকা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। কলকাতার বিভিন্ন সংবাদপত্রে তিনি সাংবাদিকতা করেন। এ সময়েই পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, ফিরোজ গান্ধী ও মওলানা আবু কালাম আজাদের মতো বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিদের সাহচার্য লাভ করতে সক্ষম হন। তাছাড়া লখনৌতে বিখ্যাত কবি, বিশিষ্ট আইনবিদ এবং আধ্যাত্মিক সঙ্গীতজ্ঞ অতুলপ্রসাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব লাভ করেন। এসব ব্যক্তির সাহচার্য পেয়ে তিনি হয়ে ওঠেন দেশপ্রেমিক ও নিষ্ঠাবান একজন প্রকৃত বাঙালি।
ত্রিশ দশকের মাঝামাঝি ব্রিটিশ যুগে ১৯৩২ সালে বোম্বে নগরীতে মুসলমানদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম ভারতীয় বীমা কোম্পানি ‘ইস্টার্ন ফেডারেল ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড’। এর দু’বছর পর ১৯৩৪ সালে মুস্তাফিজুর রহমান খান নর্থ ব্রিটিশ মার্কেন্টাইল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে যোগদান করেন। এটিই তার প্রথম চাকরি এবং বীমা জগতে প্রবেশ। এ পৃথিবী ছিল তখন তার কাছে সম্পূর্ণ অজানা। এখানে যোগদানের আড়ালে তার মানবিক মূল্যবোধ কাজ করেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল সদস্যের মৃত্যুতে সমস্ত পরিবারের ওপর কীভাবে দুর্যোগ টেনে আনে তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। এক বছর পর ইস্টার্ন ফেডারেল ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডে ১৯৩৫ সালে সাধারণ বীমা কর্মকর্তা হিসেবে তিনি যোগদান করেন। এ প্রতিষ্ঠানের জনক ছিলেন আবদুর রহমান সিদ্দিকী। তিনি এই কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং মুসলিম লীগ নেতা ছিলেন। তারই হাত ধরে মুস্তাফিজুর রহমান খান এ কোম্পানিতে আসেন। ১৯৪৭-এ পূর্ব ভারত তথা, বিশ্ব বীমাজগতে ইস্টার্ন ফেডারেল ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স (ইএফইউ) কোম্পানিই ছিল প্রথম ও একমাত্র মুসলমান মালিকানাধীন বীমাপ্রতিষ্ঠান। এ কোম্পানির রেজিস্টার অফিস ছিল চট্টগ্রামে এবং প্রধান কার্যালয় কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে। পরবর্তীতে ১৯৩৫ সালে লাহোরে প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম মালিকানাধীন বীমা কোম্পানি হিসেবে মুসলিম ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি।
১৯৩৭ সালে মুস্তাফিজুর রহমান খান সালেহা খানমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর তিনি তীব্রভাবে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। শুরু হয় জীবন সংগ্রামের কঠোর পরীক্ষা। সংসার চালানোর স্বার্থে দিনে চাকরির সাথে রাতে নাইট কলেজে আই.কম ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। সংসারের সচ্ছলতার জন্য দুয়েকটা টিউশনিও করতেন। এতো বোঝা মাথায় নিয়েও তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আই.কম পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। চরম প্রতিক‚লতা অতিক্রম করে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৩ সালে বি.কম পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে সম্মানজনক স্থান অধিকার করে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এ সময় তিনি ৩ সন্তানের জনক। তার স্ত্রী ঘরের বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে রাখতেন এবং খাবার দিতেন জানালা দিয়ে। যাতে সন্তানরা পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে। তার এ সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে তার সঙ্কল্পের দৃঢ়তা। তার অসাধারণ মেধা তাকে নতুন নতুন ক্ষেত্রে নিয়ে গেছে।
সেদিনের অত্যন্ত চেতনাশীল সমাজ সচেতন বীমাবিদ মুস্তাফিজুর রহমান খানের জীবনের ভিত গড়ে ওঠে অসাম্প্রদায়িক জীবনমনস্ক আদর্শের সমীকরণে। তিনি দেখেছেন ১৯৪০ সালে উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাব, ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৬ সালে বাংলাজুড়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের স্কেচে আঁকা মন্বন্তরে অনশনক্লিষ্ট বাস্তব মানুষের মৃত্যুর নীরব স্থিরচিত্রও; যা তার মনে রেখাপাত করেছে।
ইস্টার্ন ফেডারেল ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কর্মরত থাকাকালীন ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়। দেশভাগের সাথে সাথে ইস্টার্ন ফেডারেলের রেজিস্টার্ড অফিস কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হয়। ওই বছর ১৪ আগস্টের পর সর্বপ্রথম মুস্তাফিজুর রহমান খান ইস্টার্ন ফেডারেলের চট্টগ্রাম অফিসে কোম্পানির সাধারণ ও জীবন বিভাগের ইনচার্জ হিসেবে বদলি হয়ে আসেন সপরিবারে। ১৯৫০ সালে ইস্টার্ন ফেডারেলের ঢাকা অফিসে সাধারণ ও জীবন বীমার প্রধান হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে বদলি হয়ে আসেন। ১৯৫২ সালে সফল বীমাবিদ খোদা বক্্স ইস্টার্ন ফেডারেলের পূর্ব-পাকিস্তানের অঞ্চলপ্রধান হিসেবে কলকাতা থেকে ঢাকা অফিসে যোগ দেন এবং মুস্তাফিজুর রহমান খান পূর্ব-পাকিস্তানের সাধারণ বীমা বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত থাকেন।
পরবর্তীতে ১৯৫২ সালে পাকিস্তান ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন (পিআইসি) প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৫৯ সালে মুস্তাফিজুর রহমান খানকে কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে ঢাকা-চট্টগ্রামে একই কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। সর্বশেষ এ প্রতিষ্ঠানে জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মুস্তাফিজুর রহমান খানের সক্রিয় সহযোগিতায় দেশে ১০টি বীমা কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬১ সালে বীমা ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সরকার ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন সৃষ্টি করে এবং তার চাকরি প্রাইভেট কোম্পানি থেকে তুলে এনে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে এই করপোরেশনের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬২ সালের দিকে এই প্রতিষ্ঠানের পূর্ব পাকিস্তান আঞ্চলিক অফিসে চিফ অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। বীমা কোম্পানির চাকরির সুবাদে মুস্তাফিজুর রহমান খানসহ তার সমসাময়িক অনেকেই পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িকপুষ্ট পরিমণ্ডলে মানবিক চৈতন্যে ন্যায়ের দ্বার উন্মুক্ত করে সত্যাশ্যয়ী বীমা কর্মকর্তা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ শেষে লাইফ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন অব ইন্ডিয়ার (এলআইসি) অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৬৫-উত্তর সময়ে তিনি যুগপৎ এলআইসি ও পিআইসির যুগ্ম দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৬৬-৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে যখন রাজনৈতিক উত্তাপ বেড়ে চলে, তখনই বীমাব্যক্তিত্ব মুস্তাফিজুর রহমান খানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে এক অবীমা ব্যক্তিকে পিআইসির পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক প্রধান করে নিয়োগ দেয়া হলে স্পষ্টভাষী মুস্তাফিজুর রহমান খান মৌন প্রতিবাদের আভাস দিয়ে লাইফ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন অব ইন্ডিয়ার (এলআইসি) কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন।
১৯৬৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাঙালি উদ্যোক্তাদের দ্বারা গঠিত ‘ইস্ট পাকিস্তান কো-অপারেটিভ ইন্স্যুরেন্স সোসাইটি’র প্রধান নির্বাহী হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালে রাজনৈতিক পরিবর্তনের মতো পূর্ববাংলার বীমাজগতেও কিছু কিছু পরিবর্তন সূচিত হয়। ইস্ট পাকিস্তান কো-অপারেটিভ ইন্স্যুরেন্সের ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদে মুস্তাফিজুর রহমান খান নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি এ কোম্পানিতে কাস্টোডিয়ান ও কার্যপ্রধান পদেই বহাল ছিলেন। নবগঠিত অন্যতম ‘কর্ণফুলী সাধারণ বীমা করপোরেশনে তিনি রাষ্ট্রপতির ৯৫নং আদেশ বলে চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৩ সালের দিকে বয়সের কারণে তাকে অবসর দান করা হয়। শূন্য থেকে যে নিজেকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন, পায়ে হেঁটে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বীমা পলিসি বিক্রি করেছেন, যুগ যুগ ধরে মানুষকে সঞ্চয়ের মাধ্যমে নিরাপত্তার কথা বলেছেন, যার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল বীমা নিয়ে, তাকে এভাবে চলে যেতে হলো! বীমার বিপণন ও প্রশাসন উভয় ক্ষেত্রে তার দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। পাকিস্তানজুড়ে ছিল তার দক্ষতার স্বীকৃতি। বীমার প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল তার পদচারণা। ছিলেন জনপ্রিয়, সকলের কাছে সম্মানিত এবং পরামর্শক। বীমা জগতে বহু বছরের অভিজ্ঞতার সম্বল নিয়ে সাধারণ বীমা বিশেষজ্ঞ যে মর্যাদা পেয়েছিলেন, পরবর্তীতে দু’একজন তৈরি হয়েছে কিনা-সন্দেহ রয়েছে।
১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত কোনো সংস্থার সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত না থাকলেও তিনি ব্যাংক, বীমা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিরোধের একক আরবিট্রেটর হিসেবে কাজ করেন। দায়িত্ব পালন করেছেন কর্ণফুলী বীমা করপোরেশনের চেয়ারম্যান হিসেবেও। প্রথম প্রজন্মের বীমাবিদ আজিজুস সামাদের ডাকে ১৯৮৫ সালে দীর্ঘ ১২ বছর পর তিনি আবার পদার্পণ করেন বীমা জগতে। ১৯৪৭ সালে চট্টগ্রামে বীমা ব্যবসার প্রথম ডালি সাজিয়েছিলেন যে মানুষটি, সেই মুস্তাফিজুর রহমান খান জীবন সায়াহ্নে অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন উদ্যোগে হাল ধরলেন সাধারণ বীমার প্রথম মালিকানার বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির (বিজিআইসি) সিনিয়র চিফ অ্যাডভাইজর হিসেবে। কোম্পানির প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিদিন তিনি কর্মীদের সাথে নিয়ে ক্লাসের মতো করে বসে হাতেকলমে তাদেরকে কাজ শেখাতেন। তিনি দীর্ঘ ১২ বছর কাটান এ প্রতিষ্ঠানে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বীমাশিল্পে সর্বোচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ৬০ বছরের বেশি সময় এ পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন। এক সময় ইন্স্যুরেন্সের আইকন খোদা বক্সের আহ্বানে সাড়া দেন এবং এ অঞ্চলের লোকদের মাঝে বীমার বিস্তার ঘটাতে যৌথ উদ্যোগ নেন। তিনি ছিলেন বীমা জগতের কিংবদন্তি পুরুষ। তারই প্রচেষ্টায় তৎকালীন পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে বীমা একটি মর্যাদার পেশা ও শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। তার এ অবদান অনবদ্য। বীমাশিল্পের উন্নয়নে, বীমার আদর্শকে মানুষের কল্যাণে প্রতিষ্ঠা করতে তিনি তার জীবনের দীর্ঘসময় ব্যয় করে গেছেন। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, উপমহাদেশের বীমা জগতের এক দিকপাল ছিলেন তিনি। সে সময়ে এ অঞ্চলের মানুষ, বিশেষ করে মুসলিম সমাজে বীমার প্রতি ছিল প্রবল অনীহা। তাই তাকে স্রোতের বিপরীতেই কাজ করতে হয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান বাংলাদেশে বীমা পেশার দক্ষ সংগঠক এবং উদ্ভাবনাময় পরিকল্পনাকারী হিসেবে তিনি ছিলেন প্রতিম পুরুষ এবং অনুসরণযোগ্য পথিকৃৎ। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চাকরির সুবাদে তাকে বাংলার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় কর্মরত থাকতে হয়েছে। তাই তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল উদার, প্রগতিশীল এবং সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। তার চরিত্রের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য নীতিপরায়ণতা। নীতির প্রশ্নে সবসময় অটল থাকতেন। কার্যোপলক্ষে তিনি তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রায় সব জায়গাতেই ভ্রমণ করেন।
প্রকৃতপক্ষে তার বাবার উৎসাহেই তার বীমা পেশায় আসা। বীমা নিয়ে কর্মজীবন গড়ে উঠেছিল। বীমাকে পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সফল অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেছেন। এই কর্মময় জীবন তার শিক্ষানুরাগকে একটুও হ্রাস করতে পারেনি। তিনি ছিলেন একজন বীমাকার। কিন্তু বীমা পেশার বাইরেও বিভিন্ন শিক্ষা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে তার বিশেষ অবদান রয়েছে। শিক্ষা বিস্তারে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের মতোই মানসিকতা ছিল তার। নারীশিক্ষা বিস্তারে তিনি আজীবন ব্রতী ছিলেন। নারী স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন সর্বতোভাবে। মেয়েদের আধুনিক শিক্ষার সাথে ধর্মের কোনো বিরোধ তিনি কখনো অনুভব করেননি। বহু স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠায় তিনি সক্রিয় ছিলেন। সত্যিকার অর্থে তিনি ছিলেন এক অনন্য শিক্ষানুরাগী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ছিলেন আজীবন সম্পৃক্ত। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জননী হিসেবে দেখতেন। তিনি দীর্ঘকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের মাস্টার্স স্তরে বীমা বিষয়ে খণ্ডকালীন অধ্যাপক ও পরীক্ষক ছিলেন। দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্ট সদস্য ও সিনেট সদস্য হিসেবে তার মেধা-মনন দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন। তার শিক্ষানুরাগের বড় পরিচায়ক তিনি ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বাবার নামে মতিউর রহমান খান ট্রাস্ট ফান্ড এবং মায়ের নামে ‘সালেকুন্নেসা গোল্ড মেডেল’ প্রবর্তন করেছেন। শিক্ষা-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে তিনি যেমন আদর্শবাদী, অঙ্গীকার দীপ্ত এবং নিবেদিত প্রাণ ছিলেন, ঠিক তেমনি পেশাগত ক্ষেত্রসহ সংসার জীবনেও ছিলেন অসাধারণ কৃতী ও অত্যন্ত সফল ব্যক্তিত্ব। দায়িত্ববান ও মনুষ্যত্বের বিভায় উদ্ভাসিত এক অনন্য পরিবারের নির্মাণশিল্পীও। তিনি কেবল বীমা জগতেই প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন না, পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনেও সফল পরামর্শদাতা ছিলেন।
ইন্স্যুরেন্সে ৬০ বছর অবদান রাখার জন্য তাকে ইন্স্যুরেন্স একাডেমি কর্তৃক ২৮ মার্চ, ১৯৯৫ সালে সম্মাননা প্রদান করা হয়। কর্মেই ছিল তার আনন্দ, প্রচারে নয়।
পারিবারিক ও সংসার জীবনে তার ও তার স্ত্রীর সাফল্য অনন্যতায় ভাস্কর। এমন আদর্শবাদী সংস্কৃতিমনা ও ইতিহাস সচেতন আলোকিত পরিবার এ দেশে কমই মেলে। দীর্ঘ একান্ন বছর দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৮৭ সালের এপ্রিলে তার স্ত্রী-বিয়োগ ঘটে। তুচ্ছ জীবনধারণের গøানি কখনো এ মহৎ পুরুষকে স্পর্শ করতে পারেনি। সন্তান আর পরিবারের মধ্যে তার জীবন সীমাবদ্ধ ছিল না। অধ্যয়নের প্রতি তার গভীর আগ্রহ ছিল। বই কেনা আর পড়া ছিল তার হবি। বই ছিল তার অমূল্য সম্পদ। তিনি বলতেন, বইপড়ার অভ্যাস থাকলে সে কখনো নিঃসঙ্গ হয় না। বই দিয়ে তিনি গড়ে তোলেন এক পারিবারিক গ্রন্থাগার।
শিশুকাল থেকেই তার চরিত্রে কিছু স্বতন্ত্র ব্যতিক্রমধর্মী গুণাবলির সমাবেশ পরিলক্ষিত হয়। পিতার বদলিযোগ্য চাকরির সুবাদে বাল্যকাল ও কৈশোরে তিনি বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে বসবাস করেন। এ কারণে নানা স্থানে এবং বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে তার পরিচয় ঘটে। সেসব জায়গার লোকজনের সাথে মেলামেশাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্নতা, বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ এবং উপলব্ধি করার সুযোগ পান তিনি। তিনি গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন বলেই পরবর্তী সময়ে অন্যের কল্যাণে কাজে লাগান। ব্যঙ্গাত্মক রচনায় পারদর্শী ছিলেন তার পিতা, তিনি ছিলেন ব্যঙ্গ নিপুণ বক্তা। এ গুণটি তিনি পিতার কাছ থেকে রপ্ত করেছিলেন। তার অনুকরণে তাৎক্ষণিকভাবে চমৎকার ব্যঙ্গ-বিদ্রæপের ব্যবহার করে সরস, তির্যক ও হৃদয়স্পর্শী ভাষণ দিতে পারতেন। আসর জমিয়ে রাখতে পারতেন। তিনি সুন্দর অভিনয় ও আবৃত্তি করতে পারতেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রেডিমেড অভিধান। তার চরিত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল দিক ছিল আর্থিক সততা, যা কিংবদন্তির মতো। সন্তানদের জন্য তার নির্দেশনা ছিল- ‘ঘাম ও রক্তের বিনিময়ে সৎ উপার্জন করো এবং তা তিনভাগ করে একভাগ দিয়ে সৎ জীবনযাপন করবে, দুর্দিনের জন্য একভাগ সঞ্চয় করবে এবং আরেক ভাগ গরিব আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশীর সাহায্যের জন্য ব্যয় করবে।’ তার স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ ও প্রবল। টেলিফোন নম্বর কখনো লিখে রাখেননি। ২০০-২৫০ নম্বর মনে রাখতে পারতেন। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হওয়া কিংবা কানে কম শোনায় তার কোনো সমস্যা হতো না। তিনি নিরোগ মানুষ ছিলেন। তার মধ্যে আন্তরিকতা, বিশ্বাসের দৃঢ়তা ও গভীর মর্যাদাবোধ পরিলক্ষিত হতো। তিনি কখনো কোদালকে কোদাল, চোরকে চোর আর মুনাফিককে মুনাফিক বলতে কসুর করতেন না। কপটতা, মিথ্যা সৌজন্যের মুখোশ পরে সত্যকে আড়াল করা, সম্ভাব্য তিক্ততা সৃষ্টির আশঙ্কায় প্রয়োজনীয় রূঢ় সত্য উচ্চারণে বিরত থাকা ছিল তার চরিত্রবিরোধী। দুটি কারণে তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের প্রতি। একটি বাংলাপ্রীতি ও অন্যটি দুঃখী মানুষের প্রতি সহানুভূতি। ১৯৭৪ সালের ১৪ মে খোদা বক্সের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তার ধানমণ্ডির বাসায় বাংলাদেশের বীমা জগতের অনেকের মধ্যে তিনিও উপস্থিত হন। কেউ কেউ বিলাপ শুরু করেন। স্পষ্টভাষী মুস্তাফিজুর রহমান খান অত্যন্ত রূঢ়ভাবেই তাদেরকে বলেন, ভণ্ডামি বন্ধ করো। তোমরাই তো এর মৃত্যুর জন্য দায়ী। তিনি ছিলেন সারাজীবন আত্মপ্রচারবিমুখ ও নিভৃতচারী অসাধারণ এক কর্মীব্যক্তি। কঠিন-কোমলে গড়া ছিল তার হৃদয়।
অন্তকরণ ছিল শিশুর মতো। অসত্যের কাছে মাথা নোয়ানো তার স্বভাববিরুদ্ধ ছিল। সভা-সমিতিতে উচ্চকণ্ঠে বক্তৃতা দিতে তাকে কখনো দেখা যায়নি।
এশিয়াটিক সোসাইটির তিনি ছিলেন আজীবন সদস্য। বিভিন্ন সময়ে এর কার্যকরী পরিষদে কাউন্সিলর হিসেবে কাজ করেছেন এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৬ সালে এশিয়াটিক সোসাইটিতে তিনি তার স্ত্রীর নামে ‘সালেহা খানম ট্রাস্ট ফান্ড’ প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা একাডেমিরও তিনি ছিলেন আজীবন সদস্য। সেবামূলক প্রতিষ্ঠান রেডক্রস সোসাইটির আজীবন ও সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ-খরা-বন্যা-জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি বিপর্যয়ে তিনি মানবতার ডাকে ছিলেন সক্রিয়। ১৯৭০ সালে চট্টগ্রামের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর তিনি দীর্ঘ ৩ মাস কোস্টাল এরিয়াতে আর্তমানবতার কাজ করেছেন।
১৯৫২ সাল থেকে তিনি স্বামীবাগে নিজস্ব বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। তৎকালীন সময়ে এ বাড়িটি ছিল দল, নানা মত ও পথের, নানা বয়সের কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের মিলনস্থল। এ বাড়িটির ছায়াঘেরা উঠানে পদধূলি দিয়েছেন উপমহাদেশের স্মরণীয় বাঙালি ব্যক্তিত্ব, বহু ভাষাবিদ ও দার্শনিক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কংগ্রেস নেতা খগেন মিত্র ও আবদুল জব্বার খদ্দর, রাজনীতিবিদ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কমরেড মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া (ইত্তেফাক), জহুর হোসেন চৌধুরী (সংবাদ), আবদুস সামাদ (অবজারভার), সাংবাদিক গাফফার চৌধুরী, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, ড. নীলিমা ইব্রাহীম, প্রফেসর আখতার ইমাম, আবদুল মতিন চৌধুরী (সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) কবি গোলাম মোস্তফা, কবি জসীমউদদীন, কবি আহসান হাবিবসহ তৎকালীন শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠতো তার বাড়িটি। সকলে মিসেস খানের ঊষ্ণ আতিথ্যে সমৃদ্ধ হতেন।
মুস্তাফিজুর রহমান খান কোনো সক্রিয় এবং দলীয় রাজনীতিতে ছিলেন না। কিন্তু রাজনৈতিক সচেতনতা এবং এক প্রগাঢ় রাজনৈতিক বিশ্বাস ছিল তার। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পরম হিতৈষী। বয়সের ব্যবধান সত্তে¡ও দু’জন হয়ে ওঠেন একান্ত ঘনিষ্ঠ। এক সময়ে বঙ্গবন্ধু ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। এখানে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঊর্ধ্বতন। তবে সে ব্যবধান দু’জনকে দূরে রাখতে পারেনি। দেশ এবং দেশের মানুষকে ভালোবেসে দু’জনই একাত্ম হয়ে ওঠেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধুর সাথে তার ঘনিষ্ঠতা আরো বেড়ে যায়। প্রায়ই অফিসে গোপন বৈঠক বসতো, বঙ্গবন্ধু তার মতামতকে সশ্রদ্ধ মূল্য দিতেন। তবে তিনি থাকতেন অত্যন্ত সংযত। শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর জীবন সম্পর্কেও তিনি বাস্তব পদক্ষেপ নিতে প্রেরণা ও উৎসাহ জুগিয়েছেন। তার প্রেরণাতেই ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুর। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বোঝাতেন, তুমি যখন-তখন জেলে যাও। তোমার স্ত্রী-পুত্র, পরিবার পথে বসে যায়। যেভাবেই হোক সরকার থেকে দেয়া এই জমির ওপর একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই করো। এ বাড়ি তৈরির ঋণের ব্যবস্থাও তিনি করে দিয়েছিলেন। অতি গোপনে প্রতি মাসে একটা মাসোহারার মতো বঙ্গবন্ধুর বেতনরূপে বেগম মুজিবের হাতে তুলে দিতেন। তিনি ছিলেন চিরদিন আত্মকেন্দ্রিক ও প্রচারবিমুখ- এ সংবাদ খুব কম ব্যক্তিই জানেন। ছেলেমেয়েরাও জানবে এই লেখা পড়ে। ১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে মুস্তাফিজুর রহমান খানের অবসর সময়।
বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে গিয়ে প্রায়শ তার চোখের কোণ ভিজে উঠতো। তিনি ছিলেন পুরোপুরি আওয়ামী লীগার তথা, বাঙালি জাতীয়তা জাগরণের পক্ষের মানুষ। তবুও তিনি আওয়ামী লীগের ভুলভ্রান্তির চুলচেরা সমালোচনা করতে দ্বিধা করতেন না। স্বভাবসিদ্ধ হাস্যরস মিশিয়ে তির্যকভাবে সময় সময় বলতেন, ‘আএমলীগ’ এ সময় বঙ্গবন্ধুর কাছে দেশের মানুষের ছিল হাজারো আকাক্সক্ষা। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে না নেয়ায় মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে নেতা হিসেবে অযোগ্য বোঝাতে গিয়ে ‘কায়েদে আজম’-এর পরিবর্তে ‘কদু আজম’ নামকরণ করেন তিনি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১-এ ২৪ বছর সময়ের স্রোতে সকলের মতো তিনিও এক স্বাধীন সূর্য ওঠা রৌদ্রজ্জ্বল দিন দেখেন। প্রথম সকালে সেদিন তিনি নিজের হাতে পায়েস রেঁধে ছিলেন।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি এই ব্যতিক্রমধর্মী প্রগতিশীল মন ও মুক্তচিন্তাধারার মানুষটি ১৯৯৬ সালের ৭ জানুয়ারি সকাল ৯টায় ৮৬ বছর বয়সে তার স্বামীবাগের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেন। বিপতœীক খান রেখে গেছেন ৪ পুত্র ও ৩ কন্যা। তাদেরকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। এক বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান হলো। কারো কাছে ঋণী হয়ে নয়, অনেককে ঋণী করে চলে গেলেন। তবে সব চলে যাওয়াই চলে যাওয়া নয়। সব মৃত্যুই মৃত্যু নয়, তার মৃত্যু একটি কালের মূল্যবোধের অবসান, একটি সম্পূর্ণ মানুষের তিরোধান। তিনি অসাধারণ ছিলেন না, ছিলেন না অনন্য সাধারণও। ছিলেন তিনি এক সম্পূর্ণ মানুষ। মৃত্যুকালে অতি সামান্য সঞ্চয় ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চার মহৎ উদ্দেশ্যে দান করে গেছেন। তার পরিণত বয়সে মৃত্যু হলেও এ মৃত্যুতে পরিবার ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তিনি এমন এক ব্যক্তি ছিলেন, যিনি বীমাজগতে বহু বছরের অভিজ্ঞতার সম্বল নিয়ে সাধারণ বীমা বিশেষজ্ঞের যে মর্যাদায় উন্নীত হয়েছিলেন, তার ধারে-কাছেও পৌঁছাবার মতো ব্যক্তিত্ব তার জীবন ও জীবন পরবর্তীকালে দু’একজন তৈরি হয়েছেন কিনা সন্দেহ রয়েছে।
বাংলার মাটিতে আরেকজন মুস্তাফিজুর রহমান খানের আবির্ভাব আবার হবে কিনা জানি না।
তথ্য সূত্র : মুস্তাফিজুর রহমান খান স্মারকগ্রন্থ থেকে সংগৃহীত
Posted ৪:৩৮ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২০ আগস্ট ২০২০
bankbimaarthonity.com | Sajeed