এস জেড ইসলামঃ | বৃহস্পতিবার, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | প্রিন্ট | 891 বার পঠিত
শ্রম আইন ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের আইন লঙ্ঘন করায় প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সতর্কতা ও জরিমানায় কবলে পড়তে হচ্ছে। কিন্তু এসব যেন আমলেই নিচ্ছে না পুঁজিবাজারভুক্ত বীমা প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। বরং আইন ও প্রবিধানকে একের পর এক বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ব্যবসা করার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। এরপরও শাস্তির কবলে না পড়ে পুরস্কৃত হয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সিইও খালেদ মামুন। পূর্বের তুলনায় বেতন-ভাতা লক্ষাধিক টাকা বেড়েছে। অনৈতিক কাজে পরিচালনা পর্ষদের এমন উৎসাহ প্রদান ভাবিয়ে তুলেছে খাত বিশেষজ্ঞদের।
জানা গেছে, রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের সিইও হিসেবে ২০১৪ সাল থেকে আছেন মো: খালেদ মামুন। সিইও হিসেবে অর্ধযুগ পার করে তৃতীয় দফায়ও পেয়েছে আইডিআরএর অনুমোদন। কিন্তু ব্যবসা হাতিয়ে নিতে শ্রম আইন ও বিএসইসির আইনসহ বিবিধ আইন নিয়মিত লঙ্ঘন করছে প্রতিষ্ঠানটি। রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে এমনই অভিযোগ সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীদের। এরপরও সিইও’র বেতন ৯ লাখের পরিবর্তে ১৩ লাখ ১০ হাজার টাকা করতে আইডিআরএর কাছে পরিচালনা পর্ষদের প্রস্তাবে বিস্ময় প্রকাশ করেন তারা। তবে বেতন-ভাতা বৃদ্ধির জন্য পরিচালনা পর্ষদ প্রস্তাব দিলেও আইডিআরএর সভায় ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থার সূত্র।
প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছেন বিনিয়োগকারীরা। তারা জানান, আইন অনুযায়ী করপূর্ব নিট মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল এবং কল্যান তহবিলে প্রদান করতে হয়। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির নিট মুনাফা ৫৮ কোটি ৫৭ লাখ ৪৭ হাজার ২৫৪ টাকার বিপরীতে ২ কোটি ৯২ লাখ ৮৭ হাজার ৩৬২ টাকা এই তহবিলে রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু তা পরিপালন না করে কোম্পানিটি নিজেদের ইচ্ছেমত নামমাত্রে ৬৫ হাজার টাকা তহবিলে প্রদান করে। শ্রম আইন-২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩) এর ২৩৪ ধারা অনুযায়ী, আইনটি প্রকাশ হওয়ার এক মাসের মধ্যে শ্রমিক অংশগ্রহন তহবিল এবং কল্যান তহবিল গঠনের নির্দেশ রয়েছে। অন্যথায় ধারা ২৩৬ অনুযায়ী কোম্পানির প্রত্যেক পরিচালকসহ ব্যবস্থাপক ও ব্যবস্থাপনায় জড়িত কর্মকর্তাকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা এবং লঙ্ঘন অব্যহত থাকলে প্রতিদিনের জন্য আরো পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা দিতে হবে।
এক্ষেত্রে প্রায়শই বীমা কোম্পানির সিইও’রা ‘শ্রম আইনের এই ধারা বীমা কোম্পানির জন্য প্রযোজ্য নয়’ বলে তাদের মতামত জানান। কিন্তু এটি একটি ভ্রান্তিমূলক চিন্তা বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা, শ্রম আইনের ২(৬৫) ধারা অনুযায়ী শ্রমিক হলো- শিক্ষাধীনসহ কোন ব্যক্তি, তাহার চাকুরীর শর্তাবলী প্রকাশ্য বা উহ্য যে ভাবেই থাকুক না কেন, যিনি কোন প্রতিষ্ঠানে বা শিল্পে সরাসরিভাবে বা কোন ঠিকাদার (যে নামেই অভিহিত হউক না কেন) এর মাধ্যমে মজুরী বা অর্থের বিনিময়ে কোন দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরী, ব্যবসা উন্নয়নমূলক অথবা কেরাণীগিরির কাজ করার জন্য নিযুক্ত হন। তবে প্রশাসনিক, তদারকি কর্মকর্তা বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি এর অন্তর্ভূক্ত হবে না।
আবার সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা প্রয়োজন অনুপাতে না রেখে প্রতিষ্ঠানটির বিএসইসির আইন ভঙ্গ করেছে। গত ৩রা জুন ২০১৮ তারিখে বিএসইসি’র প্রজ্ঞাপন(BSEC/CMRRCD/2006-158/207/Admin/80) ) অনুযায়ী ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে এক পঞ্চমাংশ হারে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ প্রতি ৪ জন উদ্যোক্তা বা বিনিয়োগকারী পরিচালকের সাথে ১ জন স্বতন্ত্র পরিচালক থাকতে হবে। যদি উদ্যোক্তা বা বিনিয়োগকারী পরিচালক ৪ জনের কম হয় তবে ভগ্নাংশের জন্য আবার ১ জন স্বতন্ত্র পরিচালক রাখতে হবে। এক্ষেত্রে রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের ১৪ জন উদ্যোক্তা ও শেয়ারহোল্ডার পরিচালকের জন্য কমপক্ষে ৪ জন স্বতন্ত্র পরিচালক রাখার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি মাত্র ২ জন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয়। আইনের এ ব্যত্যয়ে কোম্পানির বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে তা গত ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে কমিশন থেকে আরেকটি প্রজ্ঞাপনের(BSEC/CMRRCD/2009-193/1/Admin/102) ) মাধ্যমে জানা যায়। উল্লিখিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নীতিমালা পরিপালন একটি বাধ্যতামূলক বিষয়। কোন কোম্পানি যদি এটি অস্বীকার করে, পালনে ব্যর্থ হয় বা লঙ্ঘন করে তবে সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ-১৯৬৯ এর আওতায় প্রতিষ্ঠানকে সর্বনিম্ন এক লাখ টাকা এবং লঙ্ঘন অব্যহত থাকলে প্রতিদিনের জন্য ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করা হবে। পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনায় কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে ডি-লিস্টিংসহ লেনদেন স্থগিত করতে পারে।
এ অনিয়মের পরও কিভাবে একজন সিইও শাস্তির মুখোমুখি না হয়ে পুরস্কৃত হন তা নিয়ে প্রশ্ন সচেতন মহলের। বিনিয়োগকারীরা আক্ষেপ করে বলেন, এসব অনিয়মে পরিচালনা পর্ষদের হয়ে ক্রিড়নক ভূমিকায় ছিলেন সিইও খালেদ মামুন। পরিচালনা পর্ষদের স্বার্থ হাসিলে তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন সে অনুযায়ী তার বেতন বেড়েছে। আমরা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্থ হলে কার কি আসে যায়?
এ নিয়ে সিইও খালেদ মামুনের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। শ্রম আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে জানান, ‘কোন বীমা কোম্পানিই এখন পর্যন্ত আইনটি পালন করছে না। তাই আমরাও করছি না। তাছাড়া বিষয়টি অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ) দেখছে। অ্যাসোসিয়েশন থেকে যখন হবে তখন সবাই পালন করবে। আমরাও করবো।’ এদিকে বিএসইসি’র স্বতন্ত্র পরিচালক সংক্রান্ত নির্দেশের বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের প্রাইমারী রেগুলেটরি হলো আইডিআরএ। আইডিআরএর স্বতন্ত্র পরিচালক ২ জন রাখার জন্য বলেছে। আমরা সেটা পরিপালন করছি।’ এরপর এ প্রতিবেদককে পাল্টা প্রশ্ন করেন- এ অনিয়মের বিষয়ে কিভাবে জেনেছে? বিনিয়োগকারীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে- বলা হলে জানান, ‘প্রথম আলো-ডেইলী স্টার আমাদের প্যারেন্ট কোম্পানি। এগুলো ছাড়া অন্যগুলোকে আমরা গোনায় ধরি না। আর ৩ হাজার, ৫ হাজার টাকায় এসব বিনিয়োগকারী কিনতে পাওয়া যায়। এদের কিভাবে ঠান্ডা করতে হয় তা আমার জানা আছে।’
Posted ১১:২৯ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১
bankbimaarthonity.com | rina sristy