শনিবার ৪ মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২১ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সজীব গ্রুপের কারখানায় আগুন:রিমান্ডে তাকাফুল ইন্স্যুরেন্সের সাবেক চেয়ারম্যান হাসেম

সম্পদের বীমা থাকলেও ছিল না শ্রমিকদের জীবনের বীমা

  |   মঙ্গলবার, ১৩ জুলাই ২০২১   |   প্রিন্ট   |   222 বার পঠিত

সম্পদের বীমা থাকলেও ছিল না শ্রমিকদের জীবনের বীমা

সম্প্রতি ভয়াবহ অগ্নি-দুর্ঘটনা ঘটে সজীব গ্রুপের নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ কারখানায়। দীর্ঘ ৩০ ঘণ্টার অব্যাহত চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বাহিনী। কিন্তু এরই মাঝে ধিকি ধিকি আগুনে পুড়ে ভষ্ম হয় ৫১টি তাজা প্রাণ। বাতাসে লাশের পোড়া গন্ধ আর নিহতের স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে নারায়ণগঞ্জের আকাশ। এ ঘটনায় গ্রেফতার হয়ে ইতোমধ্যে রিমান্ডে গিয়েছেন সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বীমা কোম্পানি তাকাফুল ইন্স্যুরেন্সের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল হাসেম ও তার চার ছেলে হাসীব বিন হাসেম, তারেক ইব্রাহীম, তাওসীব ইব্রাহীম ও তানজীম ইব্রাহীম।

এ ছাড়া গ্রুপটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাহান শাহ আজাদ, উপ-মহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদ ও প্রকৌশলী মো. আলাউদ্দিনকেও গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে চেয়ারম্যান আবুল হাসেম বীমা কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান হলেও বীমার আওতায় ছিল না শ্রমিকদের জীবন। শুধু ভবন ও গুদামের বীমা করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন নিজের সম্পদের। উপেক্ষিত ছিল শ্রমিকদের জীবন। এমনটাই জানা গেছে সর্বশেষ তথ্যে।

জানা যায়, সজীব গ্রুপের ১১টি প্রতিষ্ঠানে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ দিয়েছে পুঁজিবাজারের ৭ ব্যাংক ও এক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯৯৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে আগুনে ভষ্মীভূত হাসেম ফুডস। রূপগঞ্জের কারখানায় উৎপাদন হতো ‘সেজান জুস’। যেখানে আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়েছে অর্ধশতাধিক মানুষ। নিহত এসব শ্রমিকের জীবনের বীমা না থাকলেও সম্পদ রক্ষায় ৩০৩ কোটি টাকা বীমা করা ছিল দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স এবং কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সে। এর মধ্যে দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্সে ৫৫ শতাংশ এবং ৪৫ শতাংশ ছিল কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সে। এ ছাড়া মালামাল গুদামের জন্য ছিল আলাদা বীমা। রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্সের কাছে করা এই গুদামের বীমার পরিমাণ ছিল ১০০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে। নিয়মিত পরিশোধও করা হতো সেসব বীমার প্রিমিয়াম। এমনটাই জানিয়েছে দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের সিইও (ভারপ্রাপ্ত) আবুল কাসেম।

এদিকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিকদের জন্য কোনো প্রফিডেন্ট ফান্ড ও গ্রাচুইটি ছিল না। একদিকে ছিল না জীবনের বীমা, অন্যদিকে ছিল না শ্রমিক কল্যাণে গঠিত বিভিন্ন তহবিল। ফলে নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। সংসারপ্রধান ব্যক্তির এমন মৃত্যুতে যেন জীবিত থেকেও মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছে তাদের পরিবারগুলো।

জানা গেছে, আগুনে পুড়ে যাওয়া হাসেম ফুডস লিমিটেডে ঋণ দিয়েছে পুঁজিবাজারের মার্কেন্টাইল ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসি ফাইন্যান্স। এ ছাড়া গ্রুপটির অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঋণ আছে প্রাইম ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংকের সঙ্গে পূবালী ব্যাংক ও ব্যাংক এশিয়া।

সজীব গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সজীব করপোরেশনের নামে ঋণ আছে ৩৬০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় রাজধানীর ফার্মগেট। আর হাসেম রাইস মিলস লিমিটেডের নামে ব্যাংকঋণ আছে ৩৩৮ কোটি টাকা। চাল উৎপাদনের এ মিলের অবস্থান রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায়। সজীব গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে হাসেম ফ্লাওয়ার মিলস লিমিটেডের নামে ২০১ কোটি, সজীব লজিস্টিকস লিমিটেডের নামে ৩৮ কোটি, সজীব হোমস লিমিটেডের নামে ২৯ কোটি, হাসেম অ্যাগ্রো প্রসেসিং লিমিটেডের নামে ২০ কোটি, হাসেম অটো-রাইস মিলের নামে ৮ কোটি, স্যাভি ফুডস লিমিটেডের নামে ৩ কোটি ও মারস ইন্টারন্যাশনালের নামে ২১ লাখ টাকার ব্যাংকঋণ রয়েছে।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে আগুনে পুড়ে ভষ্মীভূত হাসেম ফুডস লিমিটেডের পাশে গ্রুপটির বেশ কয়েকটি ভবন রয়েছে। বহুতল এসব ভবনে সজীব গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য উৎপাদন হয়। এর মধ্যে হাসেম ফ্লাওয়ার মিলসের অবস্থানও একই এলাকায়। সজীব গ্রুপের আটা, ময়দাসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্য ও ফ্রুটস ড্রিংকস উৎপাদিত হয় ভবনগুলোতে। এর মধ্যে একটি ভবন ভষ্মীভূত হওয়ায় গ্রুপটির অন্য ভবনগুলোতেও শ্রমিকরা কাজ বন্ধ রেখেছেন।

এ রকম একটি বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে সজীব গ্রুপকে ঋণ দেয়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীদের কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। উদ্বেগে রয়েছেন গ্রুপটিকে ঋণ দেয়ার সঙ্গে যুক্ত ব্যাংক কর্মকর্তারাও। ‘ব্র্যান্ড ইমেজ’ থাকায় গ্রুপটিকে দেয়া ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানতও নেই ব্যাংকগুলোর হাতে।

এ প্রসঙ্গে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, উদ্যোক্তা হিসেবে আবুল হাসেম এতোদিন সফলই ছিলেন। সজীব গ্রুপের প্রতিটি পণ্যের বাজার চাহিদাও ভালো ছিল। কিন্তু একটি দুর্ঘটনা পুরো শিল্প গ্রুপটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। একজন ভালো উদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাও যদি ভঙ্গুর হয়, সেটি দুর্ভাগ্যের।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এখন পর্যন্ত গণমাধ্যমে কারখানাটির যে ভয়াবহ চিত্র দেখেছি, তা মেনে নেয়া যায় না। একটি শিল্পকারখানা নির্মাণ-অনুমোদন থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপে সরকারি বিভিন্ন দফতরের অনুমোদন লাগে। লাইসেন্স নবায়নের সময়ও কারখানা পরিদর্শনের বিষয়টি অত্যাবশ্যকীয়। এতো কিছুর পরও হাসেম ফুডসের যে পরিস্থিতি দেখছি, সেটি মেনে নেয়া যায় না। দেশের অন্যসব শিল্প-কারখানার পরিস্থিতিও ভিন্ন বলে মনে হয় না।

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, চেয়ারম্যানসহ ৮ জন গ্রেফতার হওয়ার পর শিল্প গ্রুপটি পরিচালনা করার মতো কেউ নেই। কারখানার ভবনসহ অন্যসব যন্ত্রপাতি হয়তো বীমার আওতায় আছে। কিন্তু প্রাণহানিসহ যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়ে গেল, সেটির ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না। এখন গ্রুপটি যদি দক্ষ হাতে পরিচালনা না হয়, তাহলে সব ক্ষতির প্রভাব এসে ব্যাংকের ওপর পড়বে।
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, উদ্যোক্তা হিসেবে সফল একজন ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে এতোটা পিছিয়ে থাকাটি আশ্চর্যের। সজীব গ্রুপের খাদ্যপণ্যগুলো বাজারে বেশ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু গণমাধ্যমে যে ভয়ঙ্কর চিত্র দেখলাম, তাতে গ্রুপটির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে। সজীব গ্রুপের ভাগ্যের সঙ্গে অনেক ব্যাংকের ভালো-মন্দও যুক্ত হয়ে গেছে। উদ্যোক্তাদের কারখানার পরিবেশ ও শ্রমিক নিরাপত্তার বিষয়টি সবার আগে দেখতে হবে।

উদ্যোক্তা হিসেবে সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল হাসেমের হাতেখড়ি মূলত পৈতৃক সূত্রে। লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ বাজারে ‘আজিজ বিড়ি’ দিয়ে শুরু হয় তার পিতা ইব্রাহিম মিয়ার ব্যবসা। এরপর পাট, বস্ত্র, সুতা, অ্যালুমিনিয়ামসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন ইব্রাহিম মিয়া।

ব্যাংক-বীমাসহ আর্থিক খাতেও বিনিয়োগ ছিল তার। পিতার হাত ধরেই নব্বইয়ের দশকে ব্যবসায় হাতেখড়ি হয় আবুল হাসেমের। রাজনীতিতে সক্রিয় না হলেও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-৩ (সদর) আসন থেকে নির্বাচন করে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন।

 

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১১:৫২ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১৩ জুলাই ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

(1623 বার পঠিত)
বিজ্ঞাপন
(1537 বার পঠিত)
বিজ্ঞাপন
(1217 বার পঠিত)
বিজ্ঞাপন
(1030 বার পঠিত)

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।