বিবিএনিউজ.নেট | বুধবার, ১৯ জুন ২০১৯ | প্রিন্ট | 542 বার পঠিত
বাজেটে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর রিটেইন আর্নিংস ও রিজার্ভের ওপর কর আরোপের প্রস্তাব কার্যকর হলে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো মোট ১১ হাজার কোটি টাকার মতো বাড়তি কর গুণতে হবে। কোনো কোনো কোম্পানিকে পরিশোধ করতে শতাধিক কোটি টাকার কর। কোম্পানিগুলোর উপর তৈরি হবে অস্বাভাবিক চাপ। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে প্রদত্ত বিভিন্ন কোম্পানির তথ্য-পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে এই তথ্য জানা গেছে।
তবে প্রস্তাবটি কীভাবে কার্যকর হবে এর উপর নির্ভর করবে কোম্পানিগুলোকে আদৌ এত টাকা কর দিতে হবে কি-না। অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, ‘কোম্পানির কোনো আয় বছরে রিটেইনড আর্নিংস, রিজার্ভ ইত্যাদির সমষ্টি যদি পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি হয় তাহলে যতটুকু বেশি হবে তার উপর সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে ১৫ শতাংশ কর প্রদানের বিধান প্রস্তাব করছি।’ যদি প্রযোজ্য আয়বছরে কোম্পানির রিটেইনড আর্নিংস ও রিজার্ভের স্থিতিকে বিবেচনায় নেওয়া হয় তাহলে কোম্পানিগুলোকে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা কর দিতে হবে। তবে যদি প্রতি আয়বছরে লভ্যাংশ ঘোষণার পর বাকি যে টাকা রিটেইনড আর্নিংস ও রিজার্ভ হিসাবে রাখা হবে, সেটি বিবেচনায় নিলে করের পরিমাণ হতে পারে বড়জোড় ১০০ কোটি টাকা।
উল্লেখ, গত ১৩ জুন, বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে তালিকাভুক্ত কোম্পানির রিজার্ভ ও রিটেইন আর্নিংস (অবণ্টিত মুনাফা) এর উপর কর বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, একটি আয়কর বছরে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির রিজার্ভ, রিটেইনড আর্নিংস (অবণ্টিত মুনাফা) ইত্যাদির সমষ্টি তার পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি হলে বাড়তি অংশের জন্য ১৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।
পুঁজিবাজারে প্রণোদনার অংশ হিসেবে নগদ লভ্যাংশ প্রদানকে উৎসাহিত করতে রিটেইনড আর্নিস (অবণ্টিত মুনাফা) ও রিজার্ভের উপর কর আরোপের প্রস্তাব করেছেন বলে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় দাবি করেন। তবে সংশ্লিষ্টদের মতে, এই প্রস্তাব প্রণোদনা হিসেবে তো কাজ করবেই না, বরং এটি কার্যকর হলে বাজারে প্রচণ্ড নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
উল্লেখ আলোচিত কর আরোপের প্রস্তাবের যুক্তি হিসেবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, পুঁজিবাজারের অনেক কোম্পানির মধ্যে তাদের মুনাফার অর্থ শেয়ারহোল্ডারদের না দিয়ে রিটেইন আর্নিংস ও রিজার্ভ হিসেবে রেখে দেয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এতে শেয়ারহোল্ডাররা প্রত্যাশিত লভ্যাংশ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পাশাপাশি পুঁজিবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর এ ধরনের প্রবণতা রোধ করতে বাজেটে কোনো কোম্পানির অবণ্টিত মুনাফা ও সঞ্চিতির পরিমাণ যদি এর পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি হয়, তবে সেক্ষেত্রে যতটুকু বেশি হবে, তার ওপর কোম্পানিকে ১৫ শতাংশ কর প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে।
ইরটেইনড আর্নিংস ও রিজার্ভের উপর কর আরোপের প্রস্তাব কার্যকর করতে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এ ১৬(জি) নামে একটি নতুন ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে।
রিজার্ভের ওপর করারোপের এ প্রস্তাবকে বিশ্লেষকরা অন্যায্য ও অযৌক্তিক মনে করছেন। তাদের মতে, এই প্রস্তাব কার্যকর হলে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ভালো কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাতে শুধু কোম্পানিগুলোর স্পন্সররা নয়, এর সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররাও ক্ষতির মুখে পড়বেন। কারণ রিটেইনড আর্নিংস ও রিজার্ভের মালিক তারাও। অন্যদিকে এই বাড়তি করের ভয়ে ভালো কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে আসতে চাইবে না।
তবে রহস্যজনকভাবে দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জ কর আরোপের এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা মনে করছে, এই প্রস্তাব বিনিয়োগকারীদের জন্য কল্যাণকর। তাদের দাবি, এই করের ভয়ে কোম্পানিগুলো রিজার্ভের অর্থ থেকে বেশী করে লভ্যাংশ দিলে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হবে, তাতে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে যে কোম্পানিগুলোর স্ট্রেন্থ কমে যাবে এবং বাজারে ভালো শেয়ারের সঙ্কট তৈরি হবে সে বিষয়টি তারা এড়িয়ে যাচ্ছেন।
অবশ্য তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজ (বিএপিএলসি) রিটেইনড আর্নিস ও রিজার্ভের উপর কর আরোপের প্রস্তাবের প্রতিবাদ জানিয়েছে। রোববার বিএপিএলসির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে ২০৯টি কোম্পানিকে প্রস্তাবিত কর দিতে হবে। কোম্পানিগুলোর রিটেইন আর্নিংস, রিজার্ভ ও পরিশোধিত মূলধনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যা, ৩১৭ তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে ২০৯টির রিটেইনড আর্নিংস ও রিজার্ভের পরিমাণ এর পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি। কোম্পানিগুলোর মোট পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ৫১ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। মোট রিটেইন আর্নিংস ও রিজার্ভের পরিমাণ ৯৭ হাজার ৯০১ কোটি টাকা। মোট পরিশোধিত মূলধনের অর্ধেক বা ৫০ শতাংশ হচ্ছে ২৫ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধনের অতিরিক্ত মোট অর্থের পরিমাণ ৭১ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা। এর ১৫ শতাংশ হারে ২০৯ কোম্পানিকে ১০ হাজার ৭৯২ কোটি টাকার কর দিতে হবে। এর মধ্যে ন্যূনতম ১০০ কোটি থেকে সর্বোচ্চ ৭৬২ কোটি টাকা পর্যন্ত কর দিতে হবে
শীর্ষস্থানীয় ২৯ কোম্পানিকে। এ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে মোট কর আসবে ৭ হাজার ৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
সবচেয়ে বেশি ৭৬২ কোটি টাকার কর দিতে হবে রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডকে। এরপর বেশি কর দিতে হবে বেক্সিমকো লিমিটেডকে ৭২২ কোটি টাকা। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসকে রিজার্ভের ওপর ৬৬৫ কোটি টাকার কর দিতে হবে। এছাড়া ইসলামী ব্যাংককে ৩৯৭ কোটি, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোকে ৩৩৩ কোটি, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) ২৮৭ কোটি, ডাচ্-বাংলা ব্যাংককে ২৭৮ কোটি, যমুনা অয়েলকে ২৭৫ কোটি ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসকে ২৩৫ কোটি টাকা দিতে হবে।
রিজার্ভের ওপর কর বাবদ ইউনিক হোটেলকে দিতে হবে ২৩৩ কোটি, রেনাটাকে ২১৪ কোটি, ব্র্যাক ব্যাংককে ১৯৩ কোটি, পূবালী ব্যাংককে ১৭৬ কোটি ও ইস্টার্ন ব্যাংককে ১৬৭ কোটি টাকা। এর বাইরে এ বাবদ পদ্মা অয়েলকে দিতে হবে ১৬৪ কোটি, মেঘনা পেট্রোলিয়ামকে ১৫৯ কোটি, সামিট পাওয়ারকে ১৫৪ কোটি, সিটি ব্যাংককে ১৫২ কোটি, সাউথইস্ট ব্যাংককে ১৫০ কোটি, ডেসকোকে ১৪৯ কোটি, এসিআই লিমিটেডকে ১৪৬ কোটি, বিএসআরএম লিমিটেডকে ১৪৪ কোটি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংককে (ইউসিবি) ১৪৪ কোটি, একমি ল্যাবরেটরিজকে ১৪০ কোটি, প্রাইম ব্যাংককে ১২১ কোটি, উত্তরা ব্যাংককে ১১৮ কোটি, বিএসআরএম স্টিলকে ১০৭ কোটি, ইউনাইটেড পাওয়ারকে ১০৫ কোটি ও আইডিএলসি ফিন্যান্সকে ১০০ কোটি টাকা। এ শীর্ষ ২৯ কোম্পানির বাইরে বাকি ১৮০টি কোম্পানিকে রিজার্ভের ওপর ৩ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা কর দিতে হবে।
এদিকে রোববার সন্ধ্যায় ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) আয়োজিত এক বাজেট পর্যালোচনা সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া রিজার্ভে কর বসানোর প্রস্তাবটি পুনঃবিবেচনা করে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন।
Posted ১১:৪১ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ১৯ জুন ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed