এস জেড ইসলাম | বৃহস্পতিবার, ০৮ এপ্রিল ২০২১ | প্রিন্ট | 642 বার পঠিত
দায়িত্বে থাকাকালে করেছেন একের পর এক অনিয়ম। পাত্তাই পেতো না সাধারণ গ্রাহক, এমনকি সাংবাদিকসহ কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদও। ছিলেন কোম্পানির সর্বময় ক্ষমতার অধিকারি। নিজের ক্ষমতা সুসংহত করতে পরিচালনা পর্ষদের মাঝে গ্রুপিং করে বিভাজন সৃষ্টির অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমনকি বীমা আইন ভেঙে পুন:বীমায় অনিয়ম, মানিলন্ডারিং, প্রভাব খাটিয়ে বেতন-ভাতার অতিরিক্ত টাকা আত্মসাৎ এবং কোম্পানির সাড়ে ২১ কোটি টাকা লোকসানও গোপন রেখেছিলেন। কিন্তু বিধিবাম ! অবশেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে করা জনৈক ব্যক্তির অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিষয়গুলো প্রকাশ্যে আসে। যদিও এর আগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু সে সময় কেউই তা আমলে নেয়নি। না কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ, না বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে আসার পর তাদের পক্ষ থেকে আইডিআরএ’কে জানানো হলে পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। ধীরে ধীরে অনিয়মের বিষয়গুলো বেরিয়ে আসে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুসন্ধানে। দেশের সাধারণ বীমা প্রতিষ্ঠান প্রাইম ইন্স্যুরেন্সে এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন এর সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদী খানম।
জানা যায়, প্রাইম ইন্স্যুরেন্সে মানিলন্ডারিং ও বিদেশে অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ করেন এক বিনিয়োগকারী। পাশাপাশি অসৎ উদ্দেশ্যে কোম্পানির অর্থ ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসেবে পাঠিয়েছেন কর্মকর্তা সৈয়দ মনিরুল হক, এমন অভিযোগ করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) গোচরে আনে। খোদ আরেকটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে এমন অভিযোগ পেয়ে নড়েচড়ে বসে আইডিআরএ। অনুসন্ধানে নামে সার্ভিল্যান্স টিম। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর গত ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নিকট তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে বীমা আইন লঙ্ঘন করে বিদেশে পুন:বীমা করা, মুদ্রাপাচার, সিইও কর্তৃক বেতন-ভাতার অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ এবং কোম্পানির সাড়ে একুশ কোটি টাকা লোকসান গোপনের বিষয়ে তদন্ত দল প্রমান পেয়েছে, এমনটা উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি বীমা আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শও দেয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে গতবছরের ২২ অক্টোবর আইডিআরএ’র কার্যালয়ে একটি শুনানীর আয়োজন করা হয়।
শুনানীতে পুন:বীমার অনিয়মে জড়িত থাকা, বেতন-ভাতার অতিরিক্ত সাড়ে ১১ লাখ টাকা গ্রহণ ও কোম্পানির লোকসানসহ সার্বিক অনিয়মে জড়িত থাকায় মোহাম্মদী খানমকে ব্যক্তিগতভাবে পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানা করে আইডিআরএ।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ জরিমানার প্রেক্ষিতে নিজেকে নির্দোষ দাবী করে রিভিউ আবেদন করে চিঠি পাঠান তিনি। কিন্তু চিঠিতে অনিয়মের বিষয়ে যে যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে তা ধোপে টেকেনি। পুন:বীমার অনিয়ম নিয়ে মোহাম্মদী খানম দাবী করেনÑ ‘কোম্পানির পুন:বীমা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত (তৎকালীন) সুজিত কুমার ভৌমিক এ সম্পর্কিত নিয়ম-কানুন পরিপালন করেন এবং তিনি ও তার ডিপার্টমেন্ট এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অনুমোদনের প্রয়োজন নেই।’ অথচ আইডিআরএ’র কাছে রিভিউ আবেদনে সুজিত কুমার জানানÑ ‘পুন:বীমার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে তৎকালীন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার সরাসরি নির্দেশেই পালন করা হয়েছে। তাদের কোন নির্বাহী ক্ষমতা ছিল না এবং তারা অধিনস্ত কর্মকর্তা। শুধু চাকরি রক্ষা করতে তারা মোহাম্মদী খানমের নির্দেশ বাধ্য হয়ে প্রতিপালন করেছেন।’ তাছাড়া একজন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা তার কোম্পানির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অবগত থাকবেন না, এমনটা মনে করেন না বীমা সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে মানিলন্ডারিং বা মুদ্রাপাচার বিষয়ে মোহাম্মদী খানম দাবী করেন ‘তিনি সিইও হওয়ার অনেক আগে থেকেই ডিএমডি সৈয়দ মনিরুল হকের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে টাকা পাঠাতো কোম্পানি। পরে সে টাকা উত্তোলন করে ব্যবসা উন্নয়নে কাজে লাগানো হতো। কিন্তু তিনি সিইও হওয়ার পর এ বিষয়ে জানতে পেরে ওই অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেন।’ কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, মোহাম্মদী খানম ২০১১ সালের ১০ মার্চ প্রাইম ইন্স্যুরেন্সে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০১২ সালের ১৭ জুন সৈয়দ মনিরুল হকের নামে গুলশানের ডাচ বাংলা ব্যাংক শাখায় ওই হিসাব খোলা হয়। কোম্পানির দ্বিতীয় নির্বাহী ব্যক্তি হিসেবে এটা তার অগোচরে ছিল না। এমনকি ২০১৪ সালের ১০ মার্চ তিনি কোম্পানির সিইও হওয়ার দেড় বছর পরও উক্ত ব্যাংক হিসাবে টাকা পাঠানো অব্যহত ছিল। এ দায় তিনি এড়াতে পারেন না বলেই মনে করেন বীমা সচেতন মহল। অন্যদিকে কোম্পানির সাড়ে ২১ কোটি টাকার ক্ষতি গোপনের বিষয়টি সরাসরি অস্বীকার করেন সাবেক এ মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা। এক্ষেত্রে স্বচ্ছতার প্রমান হিসেবে বিভিন্ন পুরস্কারপ্রাপ্তির বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি।
তবে বেতন-ভাতার অতিরিক্ত সাড়ে ১১ লাখ টাকা উত্তোলনের বিষয়ে জানানÑ ‘তার নিয়োগপত্রের শর্তানুযায়ী এটা মূলত ২০১৯ সালের ফার্নিচার ও লিভ ফেয়ার ভাতা। কিন্তু চুক্তির মেয়াদ শেষের আগেই চাকরি থেকে অব্যহতি নেয়ায় প্রাইম ইন্স্যুরেন্স কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলে চাকরির সময়কালের আনুপাতিক হারে সে টাকা প্রদান করতে পারেন।’ এ বিষয়ে আইডিআরএ’র শুনানীতে প্রাইম ইন্স্যুরেন্স ও মোহাম্মদী খানমের পারস্পরিক সমঝোতায় সমাধানের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু পারস্পরিক সমঝোতায় বিষয়টির নিষ্পত্তি না হওয়ায় দীর্ঘদিন যাবত প্রাইম ইন্স্যুরেন্স থেকে অব্যহতিপত্র দেয়া হয়নি সাবেক সিইও মোহাম্মদী খানমকে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ থেকে ছাড়পত্র প্রদান করতে প্রাইম ইন্স্যুরেন্সকে চাপ প্রয়োগ করায় গত ২০ আগস্ট, ২০২০ তারিখে তাকে তদন্ত সাপেক্ষে দায়-দেনা পরিশোধের শর্তে ছাড়পত্র দিতে বাধ্য হয় প্রতিষ্ঠানটি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা শুধু মোহাম্মদী খানমের ছাড়পত্র আদায়েই পদক্ষেপ নেয়নি বরং তার ব্যক্তিগত জরিমানাও কমিয়েছে বহুলাংশে। অথচ কোম্পানির দুই অধস্তন কর্মকর্তার ধার্যকৃত জরিমানার অর্থ কমায়নি একটুকুও। ফলে মোহাম্মদী খানমকে নিয়ে আইডিআরএ’র এমন অতি উৎসাহী পদক্ষেপে বীমা সংশ্লিষ্টদের মাঝে নানা গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়েছে।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ তারিখে পাঁচ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে এক লাখ ধার্য করা জরিমানা ব্যাংক এশিয়ার পে-অর্ডারের মাধ্যমে আইডিআরএ’কে প্রদান করেছেন মোহাম্মদী খানম। ফলে এ জরিমানা প্রদান করায় অনিয়মের সাথে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন। বীমা সংশ্লিষ্টজন ও বিনিয়োগকারীদের ধারণা জরিমানার পাশাপাশি বীমা খাতের তার চাকরির সুযোগও কেড়ে নেয়া উচিত নিয়ন্ত্রক সংস্থার। যেন পরবর্তীতে আর কোন কোম্পানি এমন অনিয়ম সংঘটিত না হয় এবং ক্ষতির মুখে না পড়ে গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ। ইতোমধ্যে বীমা পাড়ায় গুঞ্জন শুরু হয়েছে, সম্প্রতি প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের অনুমোদন পাওয়া একটি বীমা কোম্পানিতে সিইও হতে যাচ্ছেন দুর্নীতিবাজ সাবেক এ সিইও। ফলে বিনিয়োগকারীদের ধারণাÑ ওই প্রতিষ্ঠানেও এমনই ঘটনা ঘটাবেন মোহাম্মদী খানম। তবে প্রকৃতপক্ষেই তাকে সিইও হিসেবে নিয়োগ দিবে কিনা প্রতিষ্ঠানটি তা জানার জন্য পাঠকদের অপেক্ষা করতে হবে আরো কিছুটা সময়।
Posted ১১:৫৬ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৮ এপ্রিল ২০২১
bankbimaarthonity.com | rina sristy