নিজস্ব প্রতিবেদক | বৃহস্পতিবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২১ | প্রিন্ট | 1212 বার পঠিত
দেশব্যপী শাখা খুলে চালাচ্ছে কার্যক্রম। এজন্য মাঠপর্যায়ে নিয়োগ দিচ্ছে শত শত কর্মকর্তা ও কর্মী। যাদের পেছনে প্রতি মাসে কোটি টাকার বেশি ব্যয় হচ্ছে শুধু বেতন-ভাতা বাবদ। অথচ মাঠপর্যায়ে কর্মরত এইসব কর্মকর্তা ও কর্মীদের অধিকাংশেরই নেই আইডিআরএ কর্তৃক নিবন্ধন সনদ। আর এসব কারণে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভূয়া নিয়োগ ও বেতন প্রদানের নামে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় মানিলন্ডারিংয়ের আলামতও দেখতে পাচ্ছেন দেশের বীমা বিশেষজ্ঞ মহল। সম্প্রতি নিয়ন্ত্রণ সংস্থার বিশেষ নিরীক্ষায় এসব তথ্য উঠে আসে। তাই কেন আইন লঙ্ঘন করে এমন কর্মকান্ড হলো, তার ব্যাখ্যা চেয়ে শোকজ করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। চতুর্থ প্রজন্মের আলফা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স নিয়ে এমনটাই জানা গেছে আইডিআরএ সূত্রে।
সূত্র জানায়, বীমা আইন ২০১০ এর ২৯ ধারা অনুযায়ী আলফা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের জন্য বিশেষ নিরীক্ষা চালায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এজন্য নিরীক্ষক হিসেবে সাইফুল সামসুল আলম অ্যান্ড কোম্পানিকে নিয়োগ করা হয়। নিরীক্ষাকালে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয়সহ অন্যান্য বিষয়ে অনিয়ম আছে কি না তাও পর্যালোচনার নির্দেশ দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। দীর্ঘদিন যাবত তদন্ত শেষে আইডিআরএ’র কাছে প্রতিবেদন দাখিল করে নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান। যেখানে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ২৭টি অভিযোগ উত্থাপন করে। এর মধ্যে অন্যতম হলো এমন মাঠকর্মী দেখানো যারা আইডিআরএ কর্তৃক অনুমোদনপ্রাপ্ত নয় এবং সেসব মাঠকর্মী ও কর্মকর্তাদের অনুকূলে বেতন-ভাতা ও কমিশন প্রদান।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বীমা আইনের ৫৮(২) ধারা অনুসারে আইডিআরএ’র নিবন্ধন ছাড়া কোন বীমা এজেন্ট ব্যবসার উপর কোন কমিশন পাবেন না। কিন্তু আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে অনিবন্ধিত বীমা এজেন্টদের কমিশন প্রদান করা হয়েছে। ফলে উক্ত ঘটনায় বীমা আইন লঙ্ঘন হয়। আবার নিবন্ধিত এজেন্ট নিয়োগ না করে কার্যক্রম চালানোয় পুনরায় বীমা আইন লঙ্ঘনের দুঃসাহস দেখিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব এজেন্টদের দক্ষতার মূল্যায়ন না থাকায় বীমা বিষয়ে তাদের যথাযথ জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এতে সার্বিকভাবে বীমা খাতের উপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হবে, ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হবে জাতীয় অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত।
এদিকে এজেন্ট নিয়োগ ও কমিশন প্রদানে আইন লঙ্ঘনের পাশাপাশি এজেন্ট নিয়োগকারী এমপ্লয়ার অব এজেন্ট হিসেবে দেখানো ব্যক্তি বা সংস্থাকে আইন ভেঙে কমিশন ও ভাতা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া যাদের এমপ্লয়ার অব এজেন্ট হিসেবে দেখানো হয়েছে তাদের আইডিআরএ থেকে কোন সনদপত্র ইস্যু করা হয়নি, অর্থাৎ অবৈধভাবে এজেন্ট নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করছিলো প্রতিষ্ঠানটি। ফলে এই খাতে কোম্পানি উক্ত বছরগুলোতে যে ব্যয় করেছে তা আইন লঙ্ঘন করে করা হয়েছে।
অবশ্য এ বিষয়ে ব্যর্থতা স্বীকার করে নেয়া হয়েছে কোম্পানির তরফে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বীমা এজেন্টদের পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি। তাই এজেন্টদের লাইসেন্স সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। ফলে অনিবন্ধিত এজেন্টদের তাদের বরাদ্দকৃত কোড অনুসারে তিন বছর যাবত নবায়ন প্রিমিয়ামের উপর কমিশন প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া অনিবন্ধিত এমপ্লয়ার অব এজেন্টদের বিষয়েও একই জবাব দেয়া হয়।
তবে খাত বিশ্লেষকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, ২০১৩-১৪ সালে যে সব কোম্পানিকে বীমা সনদ দেয়া হয় তাদের অধিকাংশ পরিচালকদেরই বীমা সম্পর্কে সঠিক ধারণা ছিলো না। ফলে নিবন্ধন লাভ করেই তারা প্রতিষ্ঠান থেকে মুনাফা নিতে চেয়েছিল। এ সময় পরিচালকদের সন্তুষ্ট রাখতে অনেক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তারা বিভিন্ন উপায়ে ব্যয় দেখিয়ে তা পরিচালকদের প্রদান করতো। এসব কারণে তাদের ব্যয়ের পরিমাণ বাড়তো অস্বাভাবিক হারে। অবশ্য ব্যয় বাড়লেও এর সঠিক কোন ডকুমেন্ট বা কাগজপত্র তারা দেখাতে পারতো না। মূলত এমন কারণ দেখিয়ে বা প্লেসমেন্টের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়া মানিলন্ডারিংয়ের একটি চিহ্ন। তাই মনে করা হচ্ছে এখানে মানি লন্ডারিং হয়েছে, তবে বিস্তারিত বিষয় জানা যাবে তদন্ত চালানো হলে।
এ বিষয়ে কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নূরে আলম সিদ্দিক অভি’র সাথে যোগাযোগ করা হলে বলেন, ‘অডিট প্রতিবেদনের উপর আইডিআরএ আমাদের শোকজ করেছিল এবং আমরা তার জবাবও দিয়েছি। তবে সম্ভবত কয়েকটি বিষয়ে তারা আমাদের জবাবে সন্তুষ্ট না হওয়ায় নতুন করে আবার জবাব দিতে বলেছে। আগামী বছরের ১০ জানুয়ারির মধ্যে এই জবাব দিতে বলা হয়েছে। আমরা সে সময়ের মধ্যে নতুন করে জবাব দিবো।’ মানি লন্ডারিংয়ে কোন ঘটনা ঘটেছে কিনা, এমনটা জানতে চাইলে বলেন- ‘যে সময়গুলোতে এই ঘটনা ঘটেছে তখন আমাদের আর্থিক ফান্ডই বলতে গেলে ছিলো না। তাহলে মানিলন্ডারিং হবে কিভাবে।’ অবশ্য আর্থিক ফান্ড না থাকলেও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের বিষয়ে তেমন কিছু বলতে পারেননি এই কর্মকর্তা।
তবে বিষয়টি নিয়ে আইডিআরএ’র মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক এস এম শাকিল আখতারের কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘ইতোপূর্বে তাদের যে শোকজ করা হয়েছিল তার প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটির জবাব সন্তোষজনক নয়, তবে আগের জবাবে তারা তাদের ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়েছে। তাই আমরা পুনরায় তাদের জবাব দিতে নির্দেশ দিয়েছি। যদি এবারও তাদের সে জবাব উপযুক্ত বলে আইডিআরএ’র কাছে বিবেচিত না হয় তবে আইন অনুযায়ি যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার পথেই আমরা ধাবিত হবো।’
এদিকে এ ঘটনায় মানি লন্ডারিংয়ের সম্পৃক্ততা থাকলে কি ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে, তা জানতে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কর্মকর্তা সৈয়দ কামরুল ইসলামের সাথে। তিনি জানান- ‘যদি কোন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ ধরণের অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে মানি লন্ডারিং আইন অনুসারে আমরা তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।’ এক্ষেত্রে এসটিআর (সন্দেহজনক লেনদেন) বা এসএআর (সন্দেহজনক কার্যক্রম) প্রতিবেদনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে কিনা, এমনটা জানতে চাইলে বলেন- ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন আমরা একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। যদি আর্থিক কোন প্রতিষ্ঠানে মানিলন্ডারিংয়ে ঘটনা ঘটে তবে আমরা এই প্রতিবেদন ছাড়াই সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিকে পদক্ষেপ নিতে পারি। বিভিন্ন সময়ে মিডিয়ার প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতেও আমরা অনুসন্ধান ও ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।’
Posted ১১:৩৮ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২১
bankbimaarthonity.com | rina sristy