বিশেষ প্রতিবেদন | বুধবার, ০১ নভেম্বর ২০২৩ | প্রিন্ট | 130 বার পঠিত
বীমা খাতের প্রথম প্রজন্মের প্রতিষ্ঠান রূপালী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। নানা অনিয়ম ও ক্রমাগত ব্যবসায়িক নিম্নগতিতে পিছিয়ে পড়ছে প্রতিষ্ঠানটি। দীর্ঘ ২৩ বছর মুখ্য নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করেন পি.কে. রায়। তার নেতৃত্বে থাকাকালীন প্রতিষ্ঠানটির ভিত মজবুত হওয়ার পরিবর্তে দুর্বল কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয়। বীমা আইন, শ্রম আইন, ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট, লিস্টিং রেগুলেশন ও করপোরেট গর্ভন্যান্স কোড লঙ্ঘনে সিদ্ধহস্ত পি.কে. রায় আজও রূপালী ইন্স্যুরেন্সে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত রূপালী ইন্স্যুরেন্স দীর্ঘ ৩৫ বছর বীমা খাতে ব্যবসা করলেও গ্র্যাচুইটি দিচ্ছে না কর্মীদের, পাশাপাশি প্রভিডেন্ট ফান্ড নিয়ে করেছে অনিয়ম। সরকারের নির্দেশিত শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল (ডব্লিউপিপিএফ) পরিপালন না করে দিচ্ছেন ভুল ব্যাখ্যা। ক্রমাগত ব্যবসায়িক নিম্নগতিতে প্রতিষ্ঠানটির শাখা ও কর্মী সংখ্যা কমছে ধারাবাহিকভাবে। এতোসব অনিয়ম করেও নিজের অবস্থান সমুন্নত রেখে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োজিত থেকে রূপালী ইন্স্যুরেন্সকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিচ্ছেন বলে মত দিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২২ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৮ সাল থেকে সর্বশেষ ২০২২ সাল পর্যন্ত গ্রোস প্রিমিয়াম আয় ছিল ধারাবাহিকভাবে নিম্নমুখী। প্রতিষ্ঠানটির ২০১৮ সালে গ্রোস প্রিমিয়াম আয় ছিল যেখানে প্রায় ৮৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা, সেখানে ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৫৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকায়। এছাড়া ২০১৮ সালে শাখার সংখ্যা ছিল ৪৪টি, সেখানে ২০২২ এসে শাখার সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৩টি। কর্মিসংখ্যা কমেছেও বিপুল হারে। ২০১৮ সালে কর্মী ছিল ৫৪২ জন, সেখানে ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৩৯৭ জনে। ক্রমাগত ব্যবসায়িক নিম্নমুখী প্রবণতা ঠেকাতে পারেনি তৎকালীন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পি.কে. রায় এফসিএ।
খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, যে কোনো প্রতিষ্ঠানের করপোরেট সুশাসনের অভাব পরিলক্ষিত হলে স্বাভাবিকভাবেই গ্রাহক মুখ ফিরিয়ে নেন। গ্রাহক কমে গেলে যে কোনো প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতি ঝিমিয়ে পড়াই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে রূপালী ইন্স্যুরেন্স তার ব্যতিক্রম নয়। তারা বলেন, ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন অ্যাক্ট, ১৯৭৩ সংশোধন করে ১৯৯০ সালের ২১ এপ্রিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক আদেশে সরকারি খাতের ব্যবসার (পিএসবি) মোট মুনাফার ৫০ শতাংশ প্রতি বছর সমহারে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে বেসরকারি বীমা কোম্পানিগুলোকে ৩২ বছর ধরে ব্যবসায়িক অংশিদারিত্ব দিয়ে আসছে। এরই মধ্যে পাঁচবার আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েও সরকার পিছিয়ে অদৃশ্য কারণে। তারা আরো বলেন, সরকার বীমা ব্যবসার প্রসার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বেসরকারি বীমা কোম্পানিগুলোকে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য এই সুবিধা দিয়ে আসছে, সেখানে রূপালী ইন্স্যুরেন্স ধারাবাহিকভাবে শাখা অফিস বন্ধ ও কর্মী ছাঁটাই অব্যাহত রেখে সরকারি পরিকল্পনার পরিপন্থী কাজ করেছেন এবং অনৈতিকভাবে এই সুবিধা গ্রহণ অব্যাহত রেখেছেন। দেশের স্বার্থে ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছর শাখা অফিস বন্ধ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি সরকারি পরিকল্পনায় অসহযোগিতার জন্য রূপালী ইন্স্যুরেন্সের এই সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া উচিত বলে অনেকেই মত প্রদান করেন। তবেই বীমা খাতে স্বচ্ছতা ফিরে আসবে, পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির ভিত মজবুত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
এদিকে, রূপালী ইন্স্যুরেন্স দীর্ঘ ৩৫ বছর পার করে ৩৬ বছরে পা দিলেও কর্মীদের জন্য এখনো গ্র্যাচুইটি ফান্ড প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, যা কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২২-এর ৯৯ পৃষ্ঠায় অ্যাম্পøয়িজ বেনিফিটস নোট: ১-এর জে (৩) উল্লেখ রয়েছে। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটির বহিঃনিরীক্ষক অ্যাম্পেসিস অব ম্যাটারে উল্লেখ করেন, প্রতিষ্ঠানটির গ্র্যাচুইটি নেই। কিন্তু বিদায়ী কর্মীদের গ্র্যাচুইটির নাম দিয়ে টাকা দেওয়া হয়, যা বীমা আইন লঙ্ঘন করে রেভিনিউ অ্যাকাউন্টে চার্জ করা হয়।
এ বিষয়ে খাতসশ্লিষ্টরা বলেন, রূপালী ইন্স্যুরেন্সের মতো পুরোনো কোম্পানি গ্র্যাচুইটি না দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড (আইএএস-১৯) পরিপন্থী কাজ করেছেন, পাশাপাশি শ্রম আইন ২০০৬-এর ধারা ২ এর উপধারা-১০ এর লঙ্ঘন করেছেন। পি.কে. রায়ের মতো একজন এফসিএ ডিগ্রিধারী লোক দীর্ঘদিন অনৈতিকভাবে এই কাজগুলো করেছেন, যা সত্যিই দৃষ্টিকটু। এছাড়া বিদায়ী কর্মীদের গ্র্যাচুইটি রেভিনিউ অ্যাকাউন্টে চার্জ করে বীমা আইন লঙ্ঘন করে চলেছেন।
এছাড়া, রূপালী ইন্স্যুরেন্স দীর্ঘদিনের কোম্পানি হওয়া সত্ত্বেও প্রভিডেন্ট ফান্ড গঠনে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করেনি, যা বহিঃনিরীক্ষকের অ্যাম্পেসিস অব ম্যাটারে উল্লেখ রয়েছে। ইনকাম ট্যাক্স কর্তৃপক্ষের শর্ত মোতাবেক কর্মীদের নিজের টাকা ও কোম্পানির প্রদেয় টাকার জন্য আলাদা দুটি ফান্ড গঠন করার শর্ত এবং বছর শেষে অডিট করে নিরীক্ষা প্রতিবেদন ইনকাম ট্যাক্স কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করার নিয়ম থাকলেও রূপালী ইন্স্যুরেন্স তা পরিপালন করেনি, বিধায় প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২১ ও ২০২২ সালে অ্যাম্পেসিস অব ম্যাটারে বহিঃনিরীক্ষক বিষয়টির ব্যাপারে জোর আপত্তি জানিয়েছেন। ২০২১ সালে বহিঃনিরীক্ষকের প্রভিডেন্ট ফান্ড সংক্রান্ত অনিয়মের ব্যাপারে জোর আপত্তি জানালেও ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পি.কে. রায় তা সংশোধন না করে আইন পরিপালনে অবজ্ঞা প্রদর্শন অব্যাহত রাখেন।
সাবেক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পি.কে. রায়ের নেতৃত্বে শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল (ডব্লিউপিপিএফ) গঠন না করে ধারাবাহিকভাবে শ্রম আইন লঙ্ঘন করেছে রূপালী ইন্স্যুরেন্স। শ্রম আইন-২০০৬ পাস হওয়ার পর থেকে কোম্পানির কর্মচারীদের বঞ্চিত করেছে তাদের প্রাপ্য ন্যায্য আর্থিক সুবিধা থেকে। এ নিয়ে কোম্পানির অনেক কর্মচারীই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২২-এর পৃষ্ঠা ৯৯ অ্যাম্পøয়িজ বেনিফিটস নোট: ১-এর জে(৪) ডব্লিউপিপিএফ পরিপালন সংক্রান্ত শ্রম আইন, ২০১৩ (সংশোধিত) ধারা-২৩৩ (এ টু জি) উল্লেখ করেছেন তা অসত্য ও বিভ্রান্তিকর। শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল (ডব্লিউপিপিএফ) গঠন তো করেইনি, উল্টো রূপালী ইন্স্যুরেন্সের জন্য এই তহবিল গঠন প্রযোজ্য নয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে বীমা খাতে বিশৃঙ্খলা তৈরির বীজ বপন করেছে পি.কে. রায়, এফসিএ। অথচ শ্রম আইনের ধারা-২৩২-এ এই আইন পরিপালনের সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, যাতে দেখা যায়, ‘শ্রম আইন-ধারা-২৩২। উপধারা-(১) এই অধ্যায় নিম্নোল্লিখিত যে কোনো একটি শর্ত পূরণ করে এমন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হইবে, যথা- (ক) কোনো হিসাব বৎসরের শেষ দিনে উহার পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ অন্যূন এক কোটি টাকা; ও (খ) কোন হিসাব বৎসরের শেষ দিনে উহার স্থায়ী সম্পদের মূল্য অন্যূন দুই কোটি টাকা।’ এছাড়া শ্রম আইনের ২(৪১) (গ) ধারা অনুযায়ী বীমা কোম্পানি শ্রম আইনের অন্তর্ভুক্ত। আবার ২০১৩ সালে শ্রম আইনের যে সংশোধনী হয়েছে, সেখানে উপধারা- ৬১(থ)-তে বীমা কোম্পানিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আইনটি প্রণয়নের এক মাসের মধ্যে পরিপালনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও বিগত বছরগুলোতে তা করতে পারেনি পি. কে. রায়ের নেতৃত্বে পরিচালিত রূপালী ইন্স্যুরন্স কোম্পানি। শ্রম আইন পরিপালন না করায় আন্তর্জাতিক হিসাব মান (আইএএস-১৯) লঙ্ঘন হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি) থেকে বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র কাছে চিঠি পাঠানো হলেও তা আমলে নেয়নি পি.কে. রায়। বরং কোম্পানিকে কন্টিনজেন্ট লায়াবিলিটির মুখে ঠেলে দিয়েছেন তিনি। শ্রম আইন পরিপালনের ব্যাপারে আইনটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে শ্রম আইনের ২৩৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোম্পানির প্রত্যেক পরিচালক, উহার ব্যবস্থাপক বা ব্যবস্থাপনার কাজের সঙ্গে জড়িত যে কেউ অথবা ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান বা সদস্য, ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে অনধিক এক লাখ টাকা এবং ব্যর্থতার প্রথম তারিখের পর হইতে প্রতিদিনের জন্য ৫ হাজার টাকা জরিমানা আরোপ করে ৩০ দিনের মধ্যে জরিমানা পরিশোধের জন্য সরকার নির্দেশ প্রদান করতে পারে। পুনরায় কোনোরূপ আইনের বিধান অথবা সরকারের আদেশ পালনে ব্যর্থ হলে তাহার বিরুদ্ধে দ্বিগুণ জরিমানা আরোপিত হবে।’ সে হিসেবে ফান্ড ও ট্রাস্টি বোর্ড গঠন না করায় ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৭ বছরে প্রথমে এক লাখ জরিমানাসহ ও প্রতিদিনের জন্য ৫ হাজার টাকা হিসেবে এ পর্যন্ত কোম্পানির প্রায় ২ কোটি টাকা জরিমানা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ।
এদিকে প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিক ব্যবসায়িক নিম্নমুখিতা, গ্র্যাচুইটি ফান্ড গঠন না করা, প্রভিডেন্ট ফান্ড গঠনে ইনকামটেক্স অথরিটির নির্দেশনা পরিপালন না করা, ডব্লিউপিপিএফ নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদনে বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা প্রদান ও সরকারি ব্যবসার সুবিধা নিয়েও কর্মসংস্থান না বাড়িয়ে, বরং ক্রমাগত কমানোর কারণ জানতে চেয়ে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান উপদেষ্টা পি.কে. রায়ের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এসব অনিয়ম বীমা খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। আমি এর ব্যাতিক্রম নই। রূপালী ইন্স্যুরেন্স থেকেও বেশি অনিয়মে জড়িত রয়েছে অনেক কোম্পানি। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে এসব অনিয়ম সম্পর্কে অবগত রয়েছে। আমি এখন মুখ্য নির্বাহীর দায়িত্বে নেই। আপনি একজন সাবেক সিইও, এফসিএ ও এফসিএস প্রফেশনাল ডিগ্রিধারী, পেশাদারিত্বের জায়গায় থেকে আইন পরিপালন না করার দায় এড়াতে পারেন কিনা এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বর্তমান মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।
Posted ১:৩৭ অপরাহ্ণ | বুধবার, ০১ নভেম্বর ২০২৩
bankbimaarthonity.com | rina sristy