নিজস্ব প্রতিবেদক | বুধবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩ | প্রিন্ট | 621 বার পঠিত
অনবরত বীমা আইন লঙ্ঘন ও বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) নির্দেশনা অমান্য করে যাচ্ছে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের পরিচালনা পর্ষদ।
পরিচালকদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্তার প্রমাণ মিলছে অনুমোদনহীন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মীর নাজিমউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে। একের পর এক অনিয়ম ও দুর্নীতির খেসারত হিসেবে কোম্পানিসহ নিজেকে গুণতে হয়েছে জরিমানা। তারপরও শুদ্ধাচারে মনোযোগী না হয়ে ধারাবাহিক আইন লঙ্ঘনসহ আইডিআরএ’র নির্দেশনা অমান্য করে বীমা খাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে যাচ্ছে মীর নাজিউদ্দিন। প্রতিষ্ঠানটিতে কর্পোরেট সুশাসন পরিপালনে নেই জবাবদিহিতা। ফলে বীমাগ্রহীতা ও বিনিয়োগকারীরা রয়েছে ঝুঁকির মুখে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ১৬ অক্টোবর ও ৭ নভেম্বর আইডিআরএ’র সার্ভিলেন্স টিমের একটি পরিদর্শক দল সিটি সেন্টারে অবস্থিত ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয় এবং সিটি সেন্টার শাখা পরিদর্শন করেন। পরিদর্শক দল প্রতিষ্ঠানটিতে বীমা আইন ২০১০ এর বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘনের পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের প্রণীত বিভিন্ন সার্কুলার লঙ্ঘন, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মীর নাজিমউদ্দিনের ছেলেকে অধিক বেতনে নিয়োগ, বীমা পলিসির ভুয়া কাগজপত্র তৈরি, উন্নয়ন কর্মকর্তাকে এজেন্ট হিসেবে দেখিয়ে অর্থ লোপাট, অবৈধভাবে বেতন-ভাতা উত্তোলন, পদমর্যাদার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বেতন-ভাতা প্রদান, ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে নগদে লেনদেন ও বীমা দাবি পরিশোধে ইচ্ছাকৃত গাফিলতির প্রমাণ পায়।
পরিদর্শক দলের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইডিআরএ প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মীর নাজিমউদ্দিন আহমেদকে অপসারণসহ ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে ৮ টি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষ ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর কোম্পানির চেয়ারম্যান বরাবর এসব শাস্তির বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়ে চিঠি প্রেরণ করে।
ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান বরাবর আইডিআরএ’র পাঠানো চিঠি প্রযুক্তির অপব্যবহার করে ৭নং শর্ত যেখানে তাকে অপসারণের নির্দেশনা ছিলো তা কৌশলে বাদ দিয়ে পরিচালনা পর্ষদে পেশ করার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বিরুদ্ধে। একই সাথে আইন লঙ্ঘনের দায়ে বীমা আইন ২০১০ এর ১৩০ ধারা অনুযায়ী ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া, বীমা আইন ২০১০ এবং কর্তৃপক্ষের সার্কুলারসমূহ লঙ্ঘন করায় বীমা আইন ২০১০ এর ১৩৪ ধারা অনুযায়ী মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মীর নাজিমউদ্দিন, প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মো. আখতারুজ্জামান, সিটি সেন্টার শাখার অবলিখন কর্মকর্তা মো. সোলায়মান মিয়া এবং ওই শাখার ব্যবস্থাপক মো. নিজাম উদ্দিনকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া চিঠিতে বীমা গ্রাহকদের স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রমের জন্য ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের সিটি সেন্টার শাখার কার্যক্রম বন্ধ করার পাশাপাশি তৎকালীন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদকে অপসারণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ সাপেক্ষে আইডিআরএ’কে অবহিত করার জন্য কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেয়া হয়। একইসাথে ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ তারিখের মধ্যে উল্লেখিত অর্থদন্ডসমূহ পরিশোধের সময়সীমা বেঁধে দেয় কর্তৃপক্ষ। এই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্থদন্ড পরিশোধ না করা হলে প্রতিদিনের জন্য অতিরিক্ত পাঁচ হাজার টাকা হারে জরিমানা প্রদান করতে হবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানকে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়ার পরও তা পালন না করে উল্টো সময়ক্ষেপণের জন্য ২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর অর্থদন্ড কমানো, সিটি সেন্টার শাখা বন্ধের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনাসহ অনুরোধ জানিয়ে তিনি আইডিআরএ পত্র প্রেরণ করেন। কিন্তু আইডিআরএ’র প্রেরিত পত্রের ৭ নং শর্ত যেখানে সিইওকে অপসারণের কথা ছিল, তা ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের পর্ষদ বাস্তবায়ন না করে এখনও কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সর্বশেষ জানা যায়, নানা অয়িমের মধ্যে মীর নাজিমউদ্দিনের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ২০২২ সালের ৩১ আগস্ট। আইন অনুযায়ী নিয়োগ নবায়নের জন্য ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট (১৫ দিন পূর্বে) কর্তৃপক্ষের চেকলিস্ট অনুযায়ী কাগজপত্র পাঠানোর কথা থাকলেও পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানে স্বাক্ষরিত পত্রটি প্রেরণ করেন একই বছরের ২৪ আগস্ট। এক্ষেত্রেও পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে বীমা আইন ২০১০ এর ধারা ৮০, উপধারা ৩ লঙ্ঘনের সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। বীমা আইন ২০১০ এর ধারা-৮০ উপধারা ৩ এ সুস্পষ্টভাবে বলা রয়েছে “বীমাকারী কোন ব্যক্তিকে উহার মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হইবার বা ঐ পদে না থাকিবার ঘটনা অবগত হওয়ার ১৫ (পনের) দিন শেষ হইবার পূর্বে কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অবহিত করিবে”। এদিকে, বীমা কোম্পানি (মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ) প্রবিধানমালা-২০১২ এর ধারা ৪ এর উপধারা ৩ এ বলা হয়েছে “নিয়োগ চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হইবার অন্যূন ১৫ (পনের) দিন পূর্বে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার নিয়োগ নবায়নের জন্য বীমা কোম্পানি কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদনপত্র দাখিল করিবে”। এছাড়া মীর নাজিমউদ্দিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ থাকায় এবং চেকলিষ্ট অনুযায়ী আবেদন না করায় কর্তৃপক্ষ যাচাই বাছাইয়ের জন্য সময় নেন। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদ আইডিআরএ’র নির্দেশনা উপেক্ষা করে ২০২২ সালের ২ নভেম্বর কর্তৃপক্ষের নিকট সফট রিমাইন্ডারে ভুল তথ্য সম্বলিত চিঠি প্রেরণ করে। যেখানে চারটি দৃষ্টিকটু শব্দ ব্যবহার করা হয়। যেমন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে মীর নাজিমউদ্দিনের অনুমোদনের অনুরোধ (বীমা আইনে ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনুমোদনের সুযোগ নেই)। ৩য় নবায়নের স্থলে ৪র্থ বার নবায়নের কথা উল্লেখ করা। সর্বোপরি ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট পাঠানো চিঠির সূত্র ধরে সিইও’র অনুমোদন ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর কার্যকর বলে চিঠিতে উল্লেখ করে বীমা আইন লঙ্ঘনের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়ার ক্ষমতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে যাচ্ছে।
এদিকে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সে পরিচালনা পর্ষদের নানা অনিয়মের বিষয়ে বীমাখাত বিশ্লেষকরা বলেন, বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলার সুযোগ নেই পাশাপাশি হিসেব অনুযায়ী তার এটা তৃতীয় বার নবায়নের কথা হলেও কোম্পানির এই চিঠিতে চতুর্থ বার নবায়ন উল্লেখ করায় পেশাদারিত্বের পরিচয় ফুটে উঠেনি। সর্বোপরি ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট পাঠানো চিঠির সূত্র ধরে সিইও’র অনুমোদন ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর কার্যকর বলে চিঠিতে উল্লেখ করে বীমা আইন লঙ্ঘনের পাশাপাশি আইডিআরএ’র সাংবিধানিক ক্ষমতার সাথে তামাশা করেছেন পর্ষদের চেয়ারম্যান। একটি কোম্পানি এভাবে আইন লঙ্ঘন ও নির্দেশনা অমান্য করে বীমা খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অন্য কোন সুফল হাসিল করতে পারবে না। কর্পোরেট সুশাসন পরিপালন হলে এটা বীমা খাতের জন্য কল্যাণকর। তারা আরো বলেন, অনবরত কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ বীমা আইন ও আইডিআরএ’র নির্দেশনা লঙ্ঘন করে যাচ্ছে সে হিসেবে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলে বীমা আইন ২০১০ এর ধারা ৫০ অনুযায়ী ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যানকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে অপসারণ করার ক্ষমতা রাখে। এছাড়া, বীমাগ্রহীতা ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিবেচনায় ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের ক্রমাগত আইন লঙ্ঘন আমলে নিয়ে বীমা আইনের ৫১ ধারা অনুযায়ী জরুরি বোর্ডসভা ডাকার নির্দেশ দিয়ে আইডিআরএ’র বিবেচনায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তনসহ ৯৫ ধারা অনুযায়ী পর্ষদ ভেঙে প্রশাসক বসানোর এখতিয়ার কর্তৃপক্ষের রয়েছে। বীমা খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর পাশাপাশি কর্পোরেট সুশাসন পরিপালন নিশ্চিতকল্পে আইডিআরএর উচিত এই পথে এগিয়ে যাওয়া- এমনটাই বলছেন খাতবিশ্লেষকরা।
বীমা আইন ও কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা লঙ্ঘনের দায়ে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিবে কিনা এমন প্রশ্ন করা হলে আইডিআরএ’র মুখপাত্র মো. জাহাঙ্গির আলম বলেন, প্রতিষ্ঠানটির সাবেক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মীর নাজিমউদ্দিনকে সিইও পদে অনুমোদন দেয়নি আইডিআরএ। তারপরও তিনি পর্ষদের প্রশ্রয়ে আইডিআরএ’র নির্দেশনা অমান্য করে কাজ করে যাচ্ছেন। পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিবেন কিনা এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বীমাকারী ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বীমাখাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য আইন অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ নিবে।
বীমা আইন ও কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা লঙ্ঘনের বিষয়ে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান সাহিদা আনোয়ারের কাছে তার মতামত জানার জন্যে ফোনে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে তার মুঠোফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোন প্রকার যোগাযোগ করেননি এবং ফোন করা হলে মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন পাওয়া যায়।
Posted ৯:০২ অপরাহ্ণ | বুধবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩
bankbimaarthonity.com | rina sristy