রবিবার ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মেয়াদান্তে গ্রাহকের বীমা দাবি নিয়ে অনিশ্চয়তা

ব্যাপক অনিয়মে দেউলিয়ার পথে এনআরবি ইসলামিক লাইফ

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   বুধবার, ১৫ মে ২০২৪   |   প্রিন্ট   |   183 বার পঠিত

ব্যাপক অনিয়মে দেউলিয়ার পথে এনআরবি ইসলামিক লাইফ

নানা গোঁজামিল ও অনিয়মে চলছে নতুন প্রজন্মের জীবন বীমা কোম্পানি এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্স। ক্রমাগত অর্থ তছরূপ ও আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের কারণে কোম্পানির আর্থিক অবস্থা নড়বড়ে। মেয়াদান্তে বীমা গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধ করার সক্ষমতা প্রতিষ্ঠানটির নেই বলে মত দিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
২০২১ সালে জীবন বীমা কোম্পানির লাইসেন্স পাওয়ার পর থেকে কোম্পানির গত তিন বছরের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আয়ের চেয়ে দায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ক্রমান্বয়ে। এই দায় সৃষ্টির মূলহোতা হিসেবে কাজ করেছেন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ জামাল হাওলাদার। পাশাপাশি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সঠিক তদারকি ও অবহেলায় প্রতিষ্ঠানটি এই পরিস্থিতিতে পড়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।

তথ্য অনুসন্ধানে দেখা যায়, কোম্পানির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন ২০২১, ২০২২ ও বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) পাঠানো অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন ২০২৩ বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অনুমোদনহীন বীমা পরিকল্প বিক্রিসহ আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, পলিসি তামাদির উচ্চহার, ক্যাশ ইন হ্যান্ডের নামে অর্থ তছরূপ, একক প্রিমিয়ামকে মেয়াদি বীমা দেখিয়ে ব্যাপক তহবিল লোপাট, সম্পদ বিনিয়োগে অনিয়মসহ নানা দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির ১৮ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন থেকে দু’দফায় মোট ৭ কোটি টাকা খরচ করে ফেলা হয়েছে। যা এখন পর্যন্ত পুনর্ভরণ করতে পারেনি কোম্পানির সিইও। ইতিপূর্বে পরিশোধিত মূলধন তছরূপের দায়ে স্বদেশ ইসলামী লাইফের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ায় সর্ব মহলে প্রশংসিত হয়েছে আইডিআরএ। এছাড়া দুর্নীতি ও অর্থ তছরূপের দায়ে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের সাবেক সিইও, পরিচালক ও চেয়ারম্যানকে জেল-হাজতে যেতে হয়েছে।

সিইও’র নিয়মবহির্ভূত কর্মকান্ডের দায়ে এনআরবি ইসলামী লাইফের পরিচালকদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর মতো অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষিত-অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতিবছর যে পরিমাণ প্রিমিয়াম আয় হয়েছে তার অধিকাংশ এসেছে অনুমোদনহীন বীমা পরিকল্প “সুরক্ষিত দ্বিগুন প্রদান এক কিস্তি বীমা” থেকে। যার মেয়াদকাল ৬, ৮, ১০, ১২, ও ১৫ বছর হলেও প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের কাছ থেকে ৬ বছর মেয়াদে একক প্রিমিয়াম গ্রহণ করে চলেছে। কোম্পানি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ২০২১ সালে এই পরিকল্প থেকে একক প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে ৩০ লাখ টাকা। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে ১১ কোটি ১৯ লাখ টাকা। সর্বশেষ ২০২৩ সালে এই পরিকল্প থেকে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করা হয় প্রায় ১১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। গত তিন বছরে এই পরিকল্প থেকে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করা হয় প্রায় ২৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এই বিশাল পরিমাণ প্রিমিয়ামের উপর জীবন বীমা ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণী বিধিমালা-২০২০ অনুযায়ী এক কিস্তি বীমায় ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা ৫ শতাংশ হারে ব্যয় করার কথা ছিলো ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা। কিন্তু আইডিআরএ’র নির্দেশনা অমান্য করে সিইও শাহ জামাল হাওলাদারের নির্দেশনায় কৌশলে ডাটা জালিয়াতির (একক বীমা প্রিমিয়ামকে মেয়াদি বীমায় রূপান্তর) মাধ্যমে কখনো ৪৫ শতাংশ আবার কখনো ৭৫ শতাংশ হারে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের নামে গ্রাহকের অর্থ পুরোটাই আত্মসাৎ করা হয়েছে।

এদিকে, প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম, নবায়ন ও গ্রুপ বীমা থেকে মোট সংগ্রহ করে ৮১ কোটি টাকা। এরমধ্যে ২০২১ সালে ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় করে ৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, ২০২২ সালে ১ম বর্ষের প্রিমিয়াম ২৭ কোটি টাকাসহ নবায়ন ও গ্রুপ বীমা মিলে আয় করে ২৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা এবং সর্বশেষ ২০২৩ সালে একইভাবে ১ম বর্ষের প্রিমিয়াম ৩৬ কোটি টাকাসহ নবায়ন ও গ্রুপ বীমা মিলে ৪৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা সংগ্রহ করে।

উল্লেখ্য, গত তিন বছরে ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম, নবায়ন ও গ্রুপ বীমা আয় ৮১ কোটি টাকার মধ্যে অনুমোদনহীন বীমা পরিকল্প “সুরক্ষিত দ্বিগুণ প্রদান এক কিস্তি বীমা” থেকে এককালীন প্রিমিয়াম সংগ্রহ করা হয়েছে প্রায় ২৪ কোটি টাকা। এনআরবি ইসলামীক লাইফ এ যাবত ৮১ কোটি টাকা ব্যবসা করলেও প্রতিষ্ঠানটি লাইফ ফান্ড সন্তোষজনক অবস্থায় নিতে ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো কোম্পানি একক কিস্তি বীমা পরিকল্প থেকে এককালীন হারে যে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে তার সবটুকুই ডাটা জালিয়াতির করে ঘাটতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ফলে বর্তমানে কোম্পানি চরম তারল্য সংকটে রয়েছে। কোম্পানির বহিঃনিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান মাহফেল হক এন্ড কোম্পানি ২০২২ সালে তাদের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের এম্ফেসিস অব ম্যাটার হেডে ২০২১ ও ২০২২ সালে মোট ৪ কোটি ২৬ লাখ টাকা ক্যাশ ইন হ্যান্ডে বাস্তবে পাননি বলে উল্লেখ করেন। প্রতিষ্ঠানটির এই আর্থিক অনিয়মের ব্যাপারে কোম্পানির ক্যামেলকো বিএফআইইউতে এসটিআর-এসএআর না করায় বিস্মিত হয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

এনআরবি ইসলামীক লাইফের অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, বীমা একটি আংকিক তথ্য গাণিতিক ও জটিল বিষয়। একই সাথে বীমা যেহেতু স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে সেহেতু একটি বীমা কোম্পানি পরিচালনায় বিদ্যমান আইন, বিধি-বিধান এবং কর্তৃপক্ষ কর্তৃক জারীকৃত সার্কুলার, তথ্য নির্দেশনাসমূহ মেনে চললেই কেবল বীমা গ্রাহকদের স্বার্থ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে সিইও কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেন না। তারা আরো বলেন, সিইও’র নেতৃত্বে এনআরবি ইসলামীক লাইফ যেভাবে পরিশোধিত মূলধন খরচ, অতিরিক্ত হারে ব্যবস্থাপনা ব্যয় ও এককিস্তি বীমা প্রিমিয়াম নিয়ে অনিয়ম দুর্নীতি করেছে এতে ইসলামিক আদর্শ ও চেতনার ধারক জীবন বীমা কোম্পানিগুলো আস্থা সংকটে পড়বে। তারা বলেন, তথ্যভিত্তিক এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর আইডিআরএ’র কঠোর পদক্ষেপ হিসেবে কোম্পানিতে বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা জরুরী। নতুবা বীমা খাতে আরেক কালো অধ্যায়ের সূচনা হবে বলে মত দিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। নিয়ন্ত্রণ সংস্থা আইডিআরএ শাহ জামাল হাওলাদারের এ অপকর্মগুলো আমলে নিয়ে তাকে কঠোর জবাবদিহিতার আওতায় আনবে বলেই খাত সংশ্লিষ্টদের বিশ্বাস। অভিযোগ রয়েছে যে, এত অনিয়মের পরেও শাহ জামালকে সিইও পদে পুনরায় অনুমোদন দেওয়ার জন্য আইডিআরএ’র অতি ঊৎসাহী একটি মহল তৎপর রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ঘাড়ে মাত্র তিন বছরে ৮১ কোটি টাকার দায় চাপানো শাহ জামাল হাওলাদার সিইও পদে পুনঃঅনুমোদন পেলে পরবর্তীতে গ্রাহকের দাবি পূরণে ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারবে না বীমা খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটি।

এদিকে এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ জামাল হাওলাদারকে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন খরচ, অনুমোদনহীন বীমা পরিকল্প থেকে ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে তহবিল তছরূপ ও ঋণাত্মক লাইফ ফান্ড সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতিকে বলেন, নতুন প্রতিষ্ঠিত লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে পরিশোধিত মূলধন খরচ স্বাভাবিক ঘটনা। শুরুতে কোম্পানির আয় থাকে না। ব্যবসা সম্প্রসারণে তখন পরিশোধিত মূলধন খরচ করতে হয়। অনুমোদনহীন বীমা পরিকল্প সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমরা এই পরিকল্প অনুমোদনের জন্য আইডিআরএ জমা দিয়েছি। ৯০ দিনের মধ্যে অনুমোদন দেওয়ার কথা থাকলেও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ থেকে আমরা এখনো “সুরক্ষিত দ্বিগুন প্রদান এক কিস্তি বীমা”সহ আরো অনেক পরিকল্পের অনুমোদন পাইনি।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১১:৩১ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১৫ মে ২০২৪

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

(1665 বার পঠিত)
বিজ্ঞাপন
(1589 বার পঠিত)
বিজ্ঞাপন
(1266 বার পঠিত)
বিজ্ঞাপন
(1086 বার পঠিত)

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।