শুক্রবার ২৬ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পুঁজিবাদী সমাজ ও মানবিক বিপর্যয়

পান্না কুমার রায় রজত   |   রবিবার, ২০ জুন ২০২১   |   প্রিন্ট   |   712 বার পঠিত

পুঁজিবাদী সমাজ ও মানবিক বিপর্যয়

১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবে উজ্জীবিত হয়ে কবি নজরুল ‘লাল ফৌজ’ গল্পে লিখেছেন বিপ্লবের কথা, পরে অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধূমকেতু’ ও প্রবন্ধ ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’ গান ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ ও পরে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় পুঁজিবাদের স্বরূপ উন্মোচন করেন কবি নজরুল। বিদ্রোহী কবিতায় তিনি বলেছিলেন, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা হলেই তিনি শান্ত হবেন। একটি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতিই হচ্ছে মূল চালিকাশক্তি। সমাজ নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত।

যুগ যুগ ধরে বিশ্বে গণতান্ত্রিক যে পদ্ধতি চলে আসছে, তাতে সমাজকেই মূলভিত্তি ধরে নির্বাচনের ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, নির্বাচন শেষে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিজেকে সমাজের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব রেখেই নিজের সত্তাকে নিজ তৃণমূল সমাজ থেকে পৃথক করে নিয়ে চলে যায় চাকচিক্যময় বর্ণাঢ্য জগতে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ জনগণ। পুঁজির মূল লক্ষ্য অধিকহারে মুনাফা অর্জন করা। পুঁজিবাদ তাই মুনাফা ও সাফল্যের সঙ্গে পুঞ্জীভূত করে সর্বগ্রাসী লোভ ও বঞ্চিতদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় শত্রুতার আগুন। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা বর্তমানে ভয়ঙ্করভাবে ভোগবাদী করে তুলেছে মানুষকে। আগে অনেক মানুষ দিনে একবেলা খেতেন, এখন আয় এবং ভোগ অনেক বেড়েছে। এই পরিবর্তন অবশ্যই আমাদের স্বীকার করতে হবে।

পুঁজিবাদী অর্থনীতির দর্শন উৎপাদন প্রতিযোগিতা আর বাজার দখল, যা চালিকাশক্তি পুঁজি, লক্ষ্য মুনাফা। পুঁজিবাদ নীতি-নৈতিকতার কোনো মূল্যায়ন করে না। জনগণকে নানা রঙ-ঢঙ ও আকাশছোঁয়া স্বপ্নের মধ্যে ফেলে পুঁজি আদায় করে নেয় তার মুনাফা। এ জন্য স্বার্থপরের মতো ব্যবহার প্রয়োগ করে।

মানুষের ভোগ চাহিদাকে সে বিলাসিতার আনন্দ দিয়ে মানুষকেই শূন্য করে বুদ্ধি, প্রজ্ঞা আর মেধার সমন্বয়ে। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে আমরা মানবিক মূল্যবোধের নিম্নগামী স্পষ্ট দেখতে পাই। বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটছে, অথচ সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে, ভিডিও করছে। একজন মানুষকে বাঁচানোর পরিবর্তে ছবি তুলে ঘটনার সাক্ষী থাকতে চাইছে। মানুষের চিন্তার অবদমন কত নিচে গেলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। অথচ মানবিকতার ঊর্ধ্বে কিছুই থাকতে পারে না। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় উদ্যোক্তার ভূমিকা প্রধান এবং উদ্যোক্তার হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতাসহ সমাজ কর্তৃক অর্জিত সকল অর্থনৈতিক উৎকর্ষতা সমর্পিত।

মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে নিজেরাই নিজেদের আলোকিত করতে চায়, কিন্তু পারে না এর অন্যতম কারণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা যা বৃহৎ বা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আলোর আকাক্সক্ষার সামনে সুউচ্চ প্রাচীর রচনা করে রেখেছে। মুষ্টিমেয় মানুষের পর্বতপ্রমাণ ভোগ ঐশ্বর্য সঞ্চয়ের কারণে সৃষ্ট বৃহৎ সমাজের দুঃখ-কষ্ট ও বঞ্চনার ক্ষোভ পৃথিবীকে বিপর্যস্ত করে তুলতে উদ্যত। কল্যাণ অর্থনীতি পৃথিবীকে এ বিপর্যয় থেকে মুক্ত করে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর বসবাসযোগ্য মানুষদের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করতে সক্ষম বলে আমি মনে করি।

মানুষ যদি মানুষের প্রতি যথার্থই সহমর্মী হয়, তবে যে কোনো উদ্যোক্তা সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ নিয়ে ব্যবসা করবে। এখানে কার ও পুরো বিশ্বের মানুষের অন্যতম বিশেষ কেউ হবার বাসনা না থাকলেও চলবে। সে বাজার চাহিদার ভিত্তিতে বিনিয়োগকৃত মূলধনের ইনফ্লো বিশ্লেষণপূর্বক মূল্য এমনভাবে নির্ধারণ করবে, যাতে সহসা তার ধনভাণ্ডার উপচে পড়ে সমাজকে নিঃস্ব করতে না পারে। বৃহৎ সমাজে বহুরকম সম্প্রদায় দেখা যায়, এসব সমাজের অনেকে আবার নিজ সম্প্রদায়ের মানুষকে ওপরে টেনে তুলতে আর্থিক ও মানসিক সহায়তা প্রদান করে। এ সম্প্রদায়ের ভিতর আর্থিক ও সামাজিক স্ট্যাটাসে খুব বেশি পার্থক্য থাকে না। কল্যাণ অর্থনীতি বৃহৎ সমাজে ব্যক্তিস্বার্থ সহনীয় পর্যায়ে এনে সাম্য ও আর্থিক ভারসাম্য সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে, যেখানে কিছু অভাব থাকলে ও দারিদ্র্য থাকবে না। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় যেসব ক্ষেত্রে সর্বাধিক মুনাফা সম্ভব, সেদিকে উৎপাদনকারীরা তাদের মূলধন বিনিয়োগ করে। এখানে উৎপাদনকারীরা সামাজিক কল্যাণের কথা বিবেচনা না করে শুধু মুনাফা অর্জনের তাগিদেই উৎপাদন কার্য পরিচালনা করে। এতে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাধিত হয় এবং বুর্জোয়া শ্রেণির জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ থাকে না। একদিকে কাঁচামালের জন্য, অন্যদিকে উৎপাদিত পণ্যের জন্য বৃহৎ বাজারের প্রয়োজন হয়।

আমদানি ও রফতানির জন্য দেশি ও বিদেশি বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা দেখা দেয়। এতে গড়ে ওঠে, আর্থিক উপনিবেশ। পুঁজিবাদী দেশগুলোর মধ্যে বিদেশি বাজার দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। অবশেষে এ প্রতিযোগিতা রূপান্তরিত হয় বিরোধে। গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষ পুঁজিবাদী শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়। বাংলাদেশ এখন পুঁজির দিকে যাচ্ছে। যদিও সংবিধান পুঁজির দিকে যাওয়া সমর্থন করে না। কারণ এখনো সংবিধানে সমাজতন্ত্রের কথা বলা আছে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে কল্যাণ অর্থনীতি কাজ করে। কল্যাণ অর্থনীতির দুটো পথ। একটি ভোগের মাধ্যমে উপযোগ বৃদ্ধি করা, অন্যটি উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে বহুমুখী উৎপাদন বৃদ্ধি। তাই তৃণমূল স্তরের মানুষের হতাশা, হাহাকার ও ক্ষোভ দূর করতে এ অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন।

কল্যাণমুখী অর্থনীতি সমাজে অপরিবর্তিত ও অসামঞ্জস্য দূর করে প্রকৃত কল্যাণ সাধন করে। প্রচলিত ও সম্ভাব্য উৎপাদন, বণ্টন, সেবা ইত্যাদি খাত অর্থাৎ অর্থনীতির সমস্ত কার্যাবলি সকল স্তরে বিভাজন আবশ্যক। কেননা সকল স্তরের সাধারণ মানুষের উৎকর্ষ-বঞ্চনা দূর করাই কল্যাণমুখী অর্থনীতির মূল লক্ষ্য। এটা করা না গেলে নিম্নস্তরে অর্থাৎ সকল স্তরের সাধারণ মানুষ কোনোদিনই তাদের অর্জিত উৎকর্ষতা ভোগ করতে পারবে না। বিপুল উৎপাদন ও অপচয়ের কোনো না কোনো একসময়ে ‘ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি’ কার্যকর হতে শুরু করলে প্রবৃদ্ধির চেয়ে জনসংখ্যা মাত্র বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে এবং ভূ-অভ্যন্তরস্থ সম্পদের রিজার্ভ কমতে থাকবে।

মানুষের বেঁচে থাকার বিকল্প কোনো কিছুই উদ্ভাবন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত ব্যাপার, তাই বর্তমান সময়টাকেই ন্যূনতম উৎকর্ষতা অর্জনের শ্রেষ্ঠ সময় বিবেচনায় এনে রাষ্ট্রের পরিচালনা কাঠামোকে কল্যাণমুখী স্তরে বিভক্ত করতে হবে। বাংলাদেশে গত একযুগে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও সেখানে পুঁজিপতিদের অর্থনৈতিক দর্শনে উদারনীতির দৃষ্টিভঙ্গির মনোভাবের পরিবর্তে পুঁজিবাদ-নির্ভর অর্থনীতি দর্শনের গতিধারা চলমান রয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারীকালে দারিদ্র্যসীমার নিচে থেকে লোকসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ বা ততোধিক বাংলাদেশে অতি ধনীদের বৃদ্ধির হার সারা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ (জবঢ়ড়ৎঃ ড়ভ এষড়নধষ ওহঃবমৎরঃু ভরহধহপব) মাত্র ১০ বছরে দেশে কোটিপতি ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ হারে।

২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত যারা ৫০ লাখ ডলারের বেশি সম্পদের অধিকারী হয়েছেন তাদেরকে নিয়ে এ তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে (সূত্র: ওয়েলথ এক্স)। প্রাকৃতিক উদারতা যখন বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কর্তৃক ম্যানিপুলেটেড হয়, তখন মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হয়। মানুষের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার, চলাফেরার অধিকার, কথা বলার অধিকার, উপার্জন করার অধিকার, জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করার অধিকার, নিজের জীবনকে সাজানোর অধিকার, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকারÑসবই মানবাধিকারের একটি চলক। আর এগুলোর সবই অর্জিত হয় প্রাকৃতিক উদারতা থেকে, আর এগুলো সবই পরস্পরের সাথে যুক্ত একক ইকো সিস্টেমের মতো। এর যে কোনো একটি প্রভাবিত হলে অন্যগুলো ও প্রভাবিত হয় মানুষের ইতিহাসে এর অজস্র দৃষ্টান্ত আছে।

মানুষের ইতিহাসে যত দুর্যোগ এসেছে, তার সবই এই মানবিক ইকো সিস্টেম ভাঙতে গিয়ে কিন্তু ভাঙা যায়নি। সাময়িকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ও শেষ পর্যন্ত সব উপদ্রব দূর করে মানবিক চলকগুলো পরস্পরযুক্ত হয়ে এককে পরিণত হতে চেয়েছে। যেসব কারণগুলো এ চলকগুলোকে বিপর্যস্ত করে সে কারণগুলো প্রতিটি চলকের উৎকর্ষতা গতিরোধের সাথে সম্পৃক্ত। কল্যাণমুখী অর্থনীতি মানবাধিকারের সকল চলককে সকল স্তরের মাঝ দিয়ে পরিচালিত হতে দিতে চায়, যা সকল চলককে যা থেকে নিরাপত্তা বিধানপূর্বক তা শক্তিশালী এককে পরিণত করতে সহায়তা করবে। অর্থাৎ একজনের স্বাধীনতা কোনোক্রমেই অন্যের দুঃখ-কষ্ট অতিশোষণ ও ক্ষতির কারণ হয়ে উঠবে না।

এ-রকম সমাজব্যবস্থা পৃথিবীর তথা, সারাবিশ্বের মানুষের সুখ-শান্তি দিতে সক্ষম। এটা ধরে নেয়া যায় যে, সাধারণ মানুষ অঢেল অলস সম্পদ চায় না, চায় মর্যাদা নিয়ে মানুষের মতো বাঁচতে মানুষের এ সহজাত দাবিকে কেউ আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া সমর্থন করতে পারে কী!

 

 

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৭:০০ অপরাহ্ণ | রবিবার, ২০ জুন ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।