পান্না কুমার রায় রজত | বৃহস্পতিবার, ১৮ নভেম্বর ২০২১ | প্রিন্ট | 613 বার পঠিত
বহুজাতিক উন্নয়ন সংস্থা বিশ্ব ব্যাংকের প্রচ্ছদ গল্পে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার চিত্রে বলা হয়েছে, মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে দেশটি। শিল্প ও সেবা, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, অবকাঠামোসহ অন্যখাতেও বড় বিনিয়োগ হচ্ছে। এর ফলে দেশটির অর্থনীতি মজবুত একটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এমন ইতিবাচক ধারায় যখন আমাদের বাংলাদেশ ঠিক সেই মুহূর্তে বিশ্ব ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ রিপোর্ট বা ব্যবসা সহজীকরণ সূচক আর প্রকাশ করবে না। গত ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত বিশ্ব ব্যাংকের সদরদফতর থেকে এই ঘোষণা দেয়া হয়। প্রতি বছর অক্টোবর মাসে এই সূচকের প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি।
অক্টোবর মাস শেষ হলো ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ রিপোর্টবিহীন কেমন চলবে বিশ্ব বিনিয়োগ? কিন্তু প্রশ্ন হলো, ২০০৬ সাল থেকে প্রতি বছর নিয়মিতভাবে এ রিপোর্ট প্রকাশ করে আসছিল বিশ্ব ব্যাংক। এ রিপোর্টকে ভিত্তি করে বিদেশি উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী তাদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাহলে বৈশ্বিক উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ করার কৌশল স্ব-স্ব উদ্যোক্তাদের বিচক্ষণতা ও দক্ষতার ওপরই নির্ভর করবে?
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে চিলি ৩৪তম অবস্থানে ছিল। ২০১৭ সালে দেশটি পিছিয়ে ৫৫ তম অবস্থানে নেমেছে। এরপর চিলির রাষ্ট্রপতি ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদনের পদ্ধতিগত পরিবর্বতন নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। ২০১৮ সাল ও ২০২০ সালে প্রকাশিত ব্যবসা সহজীকরণ সূচকের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে চীন, আজারবাইজান, সৌদি আরবসহ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মান নিয়ে তথ্য জালিয়াতি হয়েছে বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। ইচ্ছাকৃতভাবে এ দেশগুলোকে বেশি নম্বর দিয়ে মান এগিয়ে আনা হয়েছে।
বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশের কাছে এখনো নিছক বৈদেশিক মুদ্রার উৎস। বৈশ্বিক সরবরাহকারী ব্যবস্থা ও মূল্য শৃঙ্খলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে। আর বাডুজ্যকেন্দ্রিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হচ্ছে এফডিআই, মুক্তবাডুজ্য চুক্তি ও বৈশি^ক মূল্য শৃঙ্খলে অংশগ্রহণ। এফডিআই বাড়াতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ও লজিস্টিক সেবার উন্নতির পাশাপাশি মুদ্রার বিনিময়মূল্য নির্ধারণে আমাদের কৌশলী হতে হবে।
বিশ্ব ব্যাংকের মূলধনের উৎস হলো সদস্য রাষ্ট্রগুলোর দেয় অর্থ। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ধনী দেশগুলোই বিশ^ব্যাংকের পুঁজির বেশিরভাগ জোগান দেয়। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ব ব্যাংকে ধনী দেশগুলোর প্রভাব প্রতিপত্তি বেশি। আবেদনকারী দেশগুলোর মধ্যে কোন কোন দেশকে ঋণ দেয়া হবে, কোন দেশকে কত ঋণ দেয়া হবে তা নির্ধারণ করে ধনী দেশগুলো। এরা ঋণের শর্তাদিও নির্ধারণ করে। ঋণদানের ক্ষেত্রে তৃতীয় বিশে^র দেশগুলোর ওপর অসম শর্তারোপ করা হয়। সমালোচকদের মতে, তৃতীয় বিশ্বের প্রকৃত অর্থনৈতিক উন্নয়ন, তাদের অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা অর্জন এবং স্বাধীন জাতীয় অর্থনৈতিক বিকাশে সাহায্য দান বিশ্ব ব্যাংকের প্রকৃত উদ্দেশ্য নয়। তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে এসব দেশকে পরনির্ভর করে রাখা এবং একইসঙ্গে শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর প্রাধান্য বৃদ্ধিতে সাহায্য করা। স্বাধীনতার ঠিক পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা যখন খুবই নাজুক ছিল তখন সহযোগিতার মূলপ্রবাহ ছিল অনুদান আকারে।
১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের প্রাপ্ত সহায়তার এক-তৃতীয়াংশই ছিল অনুদান, বৈদেশিক ঋণ বর্তমান বৈশ্বিক অর্থায়নের যুগে উন্নয়নের পরিপূরক। বাংলাদেশের সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর রয়েছে সুসম্পর্ক। যথাসময়ে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধেও রয়েছে আমাদের সুনাম। তথাপি, পদ্মাসেতুর ১২০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব বাতিল করে বিশ্ব ব্যাংক। ফলে ২০১২ সালের ২৯ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয় আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি। তখন অভিযোগ করা হয়েছিল ‘পদ্মাসেতু প্রকল্পে’ পাঁচ কোটি ডলারের কাজ পেতে এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তারা ২০১০ ও ২০১১ সালে বাংলাদেশের সেতু কর্তৃপক্ষকে আর্থিক সুবিধা দেয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে পদ্মাসেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুললে ও কানাডার আদালতে তার কোনও প্রমাণ দিতে পারেনি বিশ্ব্যব্যাংক। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে কানাডার আদালত জানায়, পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতি ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ তুলে বিশ্ব ব্যাংক ঋণ বাতিল করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অথচ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে পদ্মাসেতু প্রকল্পের নির্মাণ কাজ দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে। বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আজ পদ্মাসেতু দৃশ্যমান বাস্তবতা। এটা আমাদের অর্থনীতির সক্ষমতার প্রকাশ। পদ্মাসেতু বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের সেতু। আমাদের মর্যাদার স্থাপনা। দেশের পশ্চিমাঞ্চলের ২৯ জেলার সাথে সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের একমাত্র সেতু।
বিশ্বব্যাংক বিনিয়োগ সহজীকরণের ক্ষেত্রে যে র্যাঙ্কিং নির্ধারণ করে তা নির্ভরযোগ্য হওয়া উচিত। কারণ এই সূচক সংশ্লিষ্ট দেশের বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রভাব ফেলে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ২০৪০ সালের ইউএনডিপি’র টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায় দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির আকাক্সক্ষায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন কর্মপরিকল্পনায় দেশের গতানুগতিক চেহারা পাল্টে দিয়ে সম্ভাবনাময় এক দেশ গড়ার প্রত্যয়ে নিয়তই ছুটে চলেছে। শিল্পায়নের জন্য দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। করোনা অতিমারীর চরম দাপটে সাময়িক বিপর্যস্ত এসব অর্থনৈতিক কর্মযোগ ক্রমান্বয়ে তার গতি ফিরে পেলে নবউদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার চিত্রও স্বস্তিদায়ক হবে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান। বাংলাদেশ সরকার দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সেবা প্রদান করা সহজ হয়েছে। বাংলাদেশ প্রায় ১৭ কোটি মানুষের একটি বিশাল বাজার। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে লাভবান হবেন। যে কোনো দেশ বা অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অনুঘটক হিসেবে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। একে কর্মসংস্থান নতুন প্রযুক্তি হস্তান্তর, অভিনব ব্যবস্থাপনা কৌশল রপ্তকরণ, ব্যবস্থাপনা সক্ষমতা বৃদ্ধি ও নতুন বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত এবং অভ্যন্তরীণ বাজার কার্যকারিতা বৃদ্ধির অন্যতম বড় উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোনো দেশের বিনিয়োগের পূর্বে সেই দেশের কার্যকর বিনিয়োগ পরিবেশ ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে থাকেন। আর এই যাচাই-বাছাইয়ের সহজ মাধ্যম হচ্ছে বিশ^ব্যাংকের বিজনেস রিপোর্ট। বিশ^ব্যাংক ২০২০ সালে যে ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ সূচক প্রকাশ করেছে সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৮তম। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারত ৬৩তম, ভিয়েতনাম ৭০তম, ইন্দোনেশিয়া ৭৩তম, ভুটান ৮৯তম, নেপাল ৯৯তম ও শ্রীলঙ্কা ৯৯তম।
বিশ্ব ব্যাংক প্রতিবেদন বাংলাদেশের অবস্থানের ওঠানামার বিষয়টি বেশ আলোচিত বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে। প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু গুরুত্বসহকারে আমলে নিয়ে টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে ডুয়িং বিজনেস সূচক উন্নত অবস্থান তৈরি করার একটা কর্মসূচি চলমান, যা তদারকির দায়িত্বে থাকা অন্যতম প্রধান সংস্থা বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রণয়ন বন্ধে সংস্থাটির নিজস্ব সিদ্ধান্ত প্রকাশ পেয়েছে। কারণ তারা ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখতে পারেনি। তারা বলেছে, তাদের নিজস্ব ব্যবস্থায় গলদ থাকার কারণে এই রিপোর্ট প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকছেন। এই প্রতিবেদন ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী ও নীতিনির্ধারকদের জন্য বিশেষ ভূমিকা রেখে আসছিল। তবে এই সূচক থাকুক বা না থাকুক বাংলাদেশকে নিজ দায়িত্বেই বিনিয়োগ সূচকে এগিয়ে যেতে হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলোও করতে হবে। কাঠামোগত পদ্ধতি বের করে নিজস্ব সূচক তৈরি করতে হবে, যা বিশে^র অনেক দেশ করে। তাই বিশ^ব্যাংক এই রিপোর্ট থেকে অব্যহতি না নিয়ে বরং বিভিন্ন বিতর্কিত ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে পুনর্গঠন করে ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ রিপোর্ট কার্যক্রম চালু রাখা প্রয়োজন। তবে পদ্ধতিগত কাজ সম্পাদনে নীতি ও আদর্শকে অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। ব্যবস্থাপনার উচ্চপর্যায় থেকে বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং বিশ^ব্যাংক সংস্থাটির নব্য উদারপন্থী পক্ষগণের কারণে প্রগতিশীল অনেক অর্থনীতিবিদ নিশ্চুপ। তাই স্বাধীন পর্যালোচনা প্যানেলের নিয়ম নীতি অনুসারে রিপোর্ট প্রণয়ন করতে হবে।
বিশ্ব ব্যাংকের গবেষণা নীতিনির্ধারকদের পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত করে, দেশগুলোকে আরো ভালোভাবে অবগত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে এবং অংশীজনদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতিগুলো আরো সঠিকভাবে পরিমাপ করার সুযোগ দেয়। এ ধরনের অনুসন্ধান বেসরকারি খাত, নাগরিক সমাজ, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও অন্যদের জন্যও মূল্যবান হাতিয়ার, যা বৈশি^ক সমস্যা সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা পাওয়া যায়। শেষ খবর হচ্ছে, বিশ্ব ব্যাংক তাদের বন্ধ করে দেয়া ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচক বন্ধ করলেও আবারো নতুন করে এ ধরনের সূচক প্রকাশ করবে। তবে সেই সূচক হবে আগের সূচকের চেয়ে অধিকতর স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক। বিভিন্ন দেশের জন্য প্রযোজ্য হবে এমন রিপোর্ট কখনোই পক্ষপাতমূলক হওয়া উচিৎ নয়। বিশ্ব নতুন করে যে ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচক প্রণয়ন করতে যাচ্ছে তাতে বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান অবস্থার প্রকৃতি চিত্র ফুটে উঠবে এটাই সবাই প্রত্যাশা করে।
Posted ১১:৩৩ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৮ নভেম্বর ২০২১
bankbimaarthonity.com | rina sristy
এ বিভাগের আরও খবর
আর্কাইভ ক্যালেন্ডার
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | ৩ | ||||
৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ | ৯ | ১০ |
১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ |
১৮ | ১৯ | ২০ | ২১ | ২২ | ২৩ | ২৪ |
২৫ | ২৬ | ২৭ | ২৮ | ২৯ | ৩০ | ৩১ |