শুক্রবার ২৬ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মোটরযান বীমার প্রকল্প বিধিবদ্ধ দায় বীমা (Act Liability Insurance) বা তৃতীয় পক্ষ বীমা (Third Party Insurance) বাতিল করা সম্পর্কে কিছু কথা

এ,বি,এম, নুরুল হক   |   সোমবার, ২৩ আগস্ট ২০২১   |   প্রিন্ট   |   484 বার পঠিত

মোটরযান বীমার প্রকল্প বিধিবদ্ধ দায় বীমা (Act Liability Insurance) বা তৃতীয় পক্ষ বীমা (Third Party Insurance) বাতিল করা সম্পর্কে কিছু কথা

 

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ৩০ সেপ্টম্বর, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত একটি স্মারক লিপি প্রকাশ করে। স্মারকের বিষয় হচ্ছে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ অনুযায়ী তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা না থাকা প্রসংগে। স্মারকে যা বলা হয়েছে তা নিম্নরূপঃ

”উপর্যুক্ত বিষয়ে সুত্রস্থ পত্রের প্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, মোটর যান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর ধারা ১০৯ অনুযায়ী তৃতীয় পক্ষের ঝুকি বীমা বাধ্যতামূলক ছিল এবং এর অধীনে ১৫৫ ধারায় দন্ডের বিধান ছিল। তবে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ধারা ৬০-এর উপ ধারা (১), (২) ও (৩) নিম্নরূপঃ

১. কোন মোটরযানের মালিক বা প্রতিষ্ঠান ইচ্ছা করিলে তাহার মালিকানাধীন যে কোন মোটরযানের জন্য যে সংখ্যক যাত্রী বহনের জন্য নির্দিষ্টকৃত তাহাদের জীবন ও সম্পদের বীমা করিতে পারিবে।

২. মোটরযানের মালিক বা প্রতিষ্ঠান উহার অধীন পরিচালিত মোটরযানের জন্য যথানিয়মে বীমা করিবেন এবং মোটরযানের ক্ষতি ও নষ্ট হওয়ার বিষয়টি বীমার আওতাভুক্ত থাকিবে এবং বীমাকারী কর্তৃক উপযুক্ত ক্ষতিপূরন পাইবার অধিকারী হইবেন।

৩. মোটরযান দূর্ঘটনায় পতিত হইলে বা ক্ষতিপ্রস্থ হইলে বা নষ্ট হইলে উক্ত মটরযানের জন্য ধারা ৫৩ এর অধীন গঠিত সার্বিক সহায়তা তহবিল হইতে কোন ক্ষতিপূরন দাবি করা যাইবে না।
অর্থাৎ এধারা অনুযায়ী র্ততীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা বাধ্যতামূলক নয় এবং আইনের অধীন ইহা লংখন করা হলে কোন দন্ডের বিধান নেই।

২. এমতাবস্থায়, তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা না থাকলে সংশ্লিষ্ট মোটরযান বা মোটরযান মালিকের বিরুদ্ধে সরক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী কোন মামলা দেয়ার সুযোগ নাই।
৩. বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সকলকে অবগত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য অনুরোধ করা হলো।

স্বাক্ষর:
চেয়াম্যান
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ

পাঠকদের অবগতি ও পরিষ্কার ধারনা দেয়ার জন্য মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর ধারা ১০৯, ১২৩ ও ১৫৫ নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ

ধারা ১০৯। তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকির জন্য বীমার প্রয়োজনীয়তা ঃ

১. যাত্রী না হইলে কোন ব্যাক্তি কোন প্রকাশ্য স্থানে কোন মোটরযান ব্যবহার করিবেন না বা ব্যবহারে পাঠাইবেন না বা অন্য কাহাকেও তাহা ব্যবহার করিতে দিবেন না, যদি সেই ব্যাক্তি বা সেই অন্য ব্যাক্তি কর্তৃক যাহার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সেখানে মোটরযান ব্যবহারের জন্য এই অধ্যায়ে বর্নিত শর্ত পূরনকারী বীমার কোন নীতি প্রচলিত না থাকে।

ধারা-১২৩। বীমা সার্টিফিকিট প্রদর্শন ঃ

যে কোন প্রকাশ্য স্থানে মোটরযান চালনাকারী কোন ব্যক্তিকে কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত সাব-ইন্সপেক্টরের নীচে নহে এমন ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ অফিসার অথবা মোটরযানের কোন পরিদর্শক অথবা কর্তৃপক্ষ হইতে অনুমোদিত অপর কোন ব্যাক্তিবর্গ চাহিবামাত্র যানে ব্যবহার সংক্রান্ত বীমার সার্টিফিকেট দেখাইতে হইবে।

আরা-১৫৫। অবীমাকৃত মোটরযান চালনা ঃ
কোন ব্যাক্তি ১০৯ ধারার বিধান লংঘন করিয়া কোন মোটরযান চালাইলে কিংবা চালানার অনুমতি দিলে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা চরিমানা শাস্তি পাইবার যোগ্য হইবেন।

উপরের বর্নিত বিলুপ্ত আইনের ধারা সমূহ পর্য্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে একটি ভালো আইনকে (মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩) পরিবর্তন করে আর একটি অস্পষ্ট ও অবাস্তব আইন (সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮) চালু করা হয়েছে। এব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা বা এ্যাকট লায়লাবিলিটি বীমার প্রয়োজনীয়তা, সুবিধা ও লক্ষ্য সম্পর্কে একটু ধারনা দিতে চাচ্ছি:

বৃাটশদের প্রায় দুইশত বৎসরের শাসনামলে অবিভক্ত ভারতবর্ষে যে দু চারটি ভালো কাজ করেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বীমা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা। অষ্টাদশ শতাব্দির শেষ দিকে (১৭৯৭ সাল থেকে ১৮১০ সাল) কোলকাতায় ৭টি নৌবীমা কোম্পানী প্রতিষ্ঠিত হয়। এথেকেই এদেশে বীমার কার্যক্রম শুরু হয়। গত প্রায় সাড়ে তিনশত বৎসরে অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে বর্তমান অবস্থায় বীমার প্রসার লাভ করেছে। আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয়ে হচ্ছে মোটরযান বীমার বিষয় তাই আলোচনা মোটরযান বীমা সম্মর্কে সীমাবদ্ধ রাখবো।

ইউরোপে গাড়ি আবিষ্কারের পর ১৮৯৪ সালে মোটরযান ইংল্যান্ডে প্রবেশ করে। প্রথম দিকে মোটর যান দ্বারা দূর্ঘটনা ঘটলে কোনো ক্ষতিপূরনের ব্যবস্থা ছিল না। পরবর্তিতে ১৮৯৮ সালে ল’ অ্যাকসিডেন্ট ইন্স্যুরেন্স সোসাইটি লিমিটেড মোটর বীমার কার্যক্রম শুরু করে। ক্রমে রাস্তাঘাটের প্রসারের ফলে মোটর গাড়ীর চলাচলও বৃদ্ধি পায়। এতে দূর্ঘটনাও বৃদ্ধি পায় এবং তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ পথিক ও রাস্তায় চলাচল করা জনগন এবং তৃতীয় পক্ষের অর্থাৎ জনগনের সম্পত্তি দূর্ঘটনার সম্মুখিন হতে থাকে। ১৯৩০ সালে রোড ট্রাফিক আইন প্রবর্তন করা হয় যার মাধ্যমে বাধ্যকামূলক বিধিবদ্ধ দায়মুক্ত বীমা (Act Liability Insurance) চালু করা হয়, যা দ্বারা দূর্ঘটনায় তৃতীয় পক্ষের কোন ক্ষতি হলে তা পূরন করা বাধ্যতামূলক করা হয়। দ্বীতিয় মহাযুদ্ধের পর ইংল্যান্ডের বীমা কোম্পানীসমূহ ট্রান্সপোর্ট মন্ত্রনালয়ের সহযোগিতায় মোটর ইন্স্যুরেন্স ব্যুরো (Motor Insurance Bureauধঁ) স্থাপিত হয়, উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে যেখানে কোন বীমা নাই সেখানে তৃর্তীয় পক্ষের দাবি পরিশোধ বাধ্যতামূলক করা।

মোটরযান বীমার ঝুঁকির দুই ভাগে ভাগ করা হয় যেমন:
ক) বিধিবদ্ধ দায় বীমা (Act Liability Insurance) বা তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা (Third Party Insurance)।

খ) সর্বঝুঁকি বীমা (Comprehensive Insurance)।
আমাদের আলোচনার বিষয় যেহেতু তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা সম্পর্কিত সেহেতু সর্বঝুঁকি বীমা সম্পর্কে এখানে কোন বিষদ আলোচনার অবতারনা করবো না।

মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর ধারা ১০৯, ১২৩ এবং ১৫৫ ধারা রহিত করে সড়ক পরিকহন আইন ২০১৮ এর ধারা ৬০-এর উপধারা (১), (২) ও (৩) জারী করা হয়েছে যা খুবই দুর্বল ও অকার্য্যকর। উপধোরা (১) এ বলা হযেছে কোন মোটরযানের মালিক ইচ্ছা করিলে তাহার মালিকানাধীন যে কোন মোটরযানের জন্য যে সংখ্যক যাত্রী পরিবহনের জন্য নির্দিষ্টকৃত তাহাদের জীবন ও সম্পদের বীমা করিতে পারিবে।

প্রথমত: আমাদের দেশে ইচ্ছা করে কেউ বীমা করে না। সে ধরনের মান মানসিকতা এখনও তৈরি হয়নি। প্রকৃত চিত্র হচ্ছে, তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা বাতিল করার পর অনেক মোটরযানের মালিক কোন বীমা করতে চান না। ফলে মোটর মালিকদের সর্বঝুঁকি বীমা (Comprehensive Insurance) ও অনেক কমে গেছে। শুধু যারা ব্যাংক ঝন নিয়ে গাড়ি কিনছেন তারাই বাধ্য হয়ে বীমা করছেন। Comprehensive Motor Insurance  এর প্রিমিয়াম বেশি হওয়ায় এই বীমা করতে চান না। অর্থাৎ মোটরযান বীমা প্রিমিয়াম আশংকাজনক ভাবে হ্রাস পাবে। বাংলাদেশ ইন্স্যুবেন্স এসোসিয়েশন কর্তৃক প্রকাশিত ২০১৯ সালের ইন্স্যুরেন্স ইয়ার বুক অনুসারে ২০১৯ সালে গ্রস মোটর ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম আয় হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। আমাদের ধারনা ২০২১ সালে এই প্রিমিয়ামের পরিমান ১০০ কোটি টাকার উপর হবেনা। এতে সরকার ৫০ কোটি টাকার উপর রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হবে। এছাড়াও বীমা পেশায় নিয়োজিত কয়েক হাজার লোক বেকার হবে, যারা তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা বিক্রি করে জিবীকা নির্বাহ করতো। ইতিমধ্যে অধিকাংশ নন-লাইফ কোম্পানীর শাখা অফিসে যারা শুধু মোটরযান বীমা বিক্রি করতো ঐ সমস্ত শাখা অফিস বন্ধ হয়ে গেছে এবং এরকম অবস্থা চলতে থাকলে আরো অনেক শাখা অফিস বন্ধ হবে।

দ্বিতীয়ত: সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ধারা ৬০-এর উপধারা (১) এ উল্লেথ আছে ” যে কোন মোটরযানের জন্য নির্দ্দিষ্ঠ কৃত যাত্রী তাহাদের জীবন ও সম্পদের বীমা করিতে পারিবে।” অর্থাৎ রাস্তা ঘাটে চলাফেরা করা তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ পথিক, পাবলিক প্লেসে চলাফেরা করা

জনসাধারনের জীবন এবং তৃতীয় পক্ষের কোন সম্পদের কোন নিরাপত্তা থাকলো না। যস্ত্রদানব বাস ও ট্রাক পথচারিদের মেরে ফেলবে অথচ তার কোন নিরাপত্তা থাকবে না বা ক্ষতিপূরনের ব্যবস্থা থাকবে না। এই আইনের ধারা আমাদের সংবিধেিনর মৌলিক অধিকার সংত্রান্ত ২৭ ও ৩২ ধারার পরিপন্থি। এই ধারাসমূহে যা বলা হয়েছে তা নিম্নরূপঃ

ধারা ২৭। সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী।
ধারা ৩২।

আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যাক্তি স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যাক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।
মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ বাতিল করে (ধারা ১০৯) সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ধারা ৬০ এর উপধারা (০১) জারি করা হয় যা আমাদের সংবিধানের ২৭ ও ৩২ ধারার পরিপন্থি বলে প্রতিয়মান হয়।

তৃতীয়ত: বর্তমানে সরকার জাতীয় বীমা নীতি ২০১৪ প্রনয়ন করে দেশের বীমা শিল্পের উন্নয়নের জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহন করে। জাতীয় বীমা নীতি ২০১৪ এর কয়েকটি ধারা নিম্নে উল্লেখ করছি যা সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ধারা ৬০ এর উপধারা (১) ও (২) এর সাথে সাংঘর্ষিক। বীমা নীতির নিম্নবর্নিত ধারা সমূহ পর্য্যালোচনা করা যেতে পারে:

ধারা ২.১ রূপকল্প (Vision) ঃ সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে আপামর জনসাধাররকে ধাপে ধাপে বীমার আওতায় নিয়ে এসে জীবন, স্বাস্থ্য ও সম্পদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলার মাধ্যমে অন্যতম মানবাধিকার হিসেবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

ধারা ২.২ মিশন (Mission) ঃ দেশের সম্পদ ও জীবনের ঝুঁকির শতভাগ বীমার আওতায় নিয়ে আসা।

২.৪.৭ বীমা ও দায় ঃ দূর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দূর্যোগ ইত্যাদি কারনে ক্ষতিগ্রস্থ সস্পদের যেমন আর্থিক ক্ষতিপূরন বীমার মাধ্যমে করা হয়, তেমন বীমা গ্রহীতার অবহেলা কিংবা অজ্ঞতা বশত কোন কাজের মাধ্যমে তৃতীয় পক্ষের নিকট সৃষ্ট দায়ের জন্যও ক্ষতিপূরন বীমার মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। রাস্তায় গাড়ী চালালে, উৎপাদিত পন্যের ব্যবহারে ক্ষতি, পেশাগত দায়িত্ব পালনের ফলে সৃষ্ট ক্ষতি ইত্যাদি কারনে তৃতীয় পক্ষ কিংবা তাদের সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্থ হলে বীমা গ্রহীতার আইনগত দায় সৃষ্টি হয়। এসকল দায়ের ঝুঁকি গ্রহন করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তৃতীয় পক্ষকে জীবন ও সম্পদের ক্ষতিপূরনে বীমার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ন।

এছাড়া জাতীয় বীমা নীতির ২০১৪ এর ধারা ২.৫ প্রধান প্রতিপালনীয় বিষয় সমূহ এর উপধারা (২) ও (৭) বর্ণিত বিষয়ে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর বীমা সংত্রান্ত ধারা ৬০ এর উপধারা (১) ও (২) সাংঘর্ষিক।
আরা ২.৫ প্রধান প্রতিপালনীয় বিষয় সমূহ ঃ

২) বীমা সংক্রান্ত প্রচলিত আইন কানুন এবং অন্যান্য যেসব আইনে বীমা সংক্রান্ত বিধান আছে এগুলো পর্য্যালোচনা করে যথাযথ আইনি কাঠামো নিশ্চিত করা হবে।

৭) বীমা আইনের সাথে সাংঘর্ষিক আইনসমূহ পর্যালোচনা করা হবে।

জাতীয় বীমা নীতি ২০১৪ এর উপরোক্ত ধারাসমূহ পর্য্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ বাতিল করে যে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ জারী করা হয়েছে তার ধারা ৬০ এর উপধারা (১) ও (২)।

জাতীয় বীমা নীতি ২০১৪ এর ধারা ২.১, ২.২, ২.৪.৭ এবং ধারা ২.৫ এর উপধারা ২ ও ৭ এর সাথে সাংঘর্ষিক।

চতুর্থত: বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি কর্তৃক প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুসারে দেখা যায় যে ২০১০ সাল পর্যন্ত রেজিষ্ট্রিকৃত বিভিন্ন ধরনের গাড়ীর সংখ্যা ছিল ১৪,২৭,৩৬৮ যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত দাড়িয়েছে ৪৭,২৯,৩৯৩ অর্থাৎ ১০ বছরে তিনগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সমস্ত গাড়ীর বীমা বাধ্যতামূলক করা হলে বীমার প্রিমিয়াম আয় বাড়বে, জনসাধারনের অর্থাৎ তৃতীয় পক্ষের মৃত্যু, আহত ও পঙ্গু হওয়ার ঝুঁকি এবং সম্পদের ক্ষতি বীমার মাধ্যমে ক্ষতিপূরন করার নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। দেশের রাস্তাঘাট যত সম্প্রসারিত হবে বিভিন্ন ধরনের গাড়ীর সংখ্যাও তত বৃদ্ধি পাবে। সংগে সংগে দূর্ঘটনার সংখ্যাও বাড়বে। কর্তমানে প্রতিদিনই রাস্তায় মোটরযানের মাধ্যমে দূঘটনায় হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে। আহত হচ্ছে ও পঙ্গুত্ব বরন করছে। কিন্তু তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা বাধ্যতামূলক না থাকাতে নিরীহ নাগরিকরা কোন আইনি সুবিধা বা ক্ষতিপূরন পাবে না যা কোন রকমেই কাম্য নয় এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিপন্থি।
প্রসংগত এখানে উল্লেখ যে, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ধারা ৫২,৫৩ অনুসারে দূর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরন, চিকিৎসা ইত্যাদির বিধান করা হয়েছে। ধারাসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হল ঃ
ধারা ৫২।- ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তাহার পরিবারকে ক্ষতিপূরন প্রদান ঃ কোন মোটরযান হইতে উদ্ভুত দূর্ঘটনার ফলে কোন ব্যক্তি আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হইলে বা আঘাতপ্রাপ্ত হইয়া মৃত্যুবরন করিলে উক্ত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা ক্ষেত্রমতে তাহার উত্তরাধীকারীগনের পক্ষে মনোনীত ব্যক্তি ধারা ৫৩ এর অধীন গঠিত আর্থিক সহায়তা তহবিল হইতে ট্রাষ্টি বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত ক্ষতিপূরন বা, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে, চিকিৎসার খরচ প্রাপ্য হইবে।

ধারা ৫৩।- আর্থিক সহায়তা তহবিল -(১) ধারা ৫২ এর উদ্দেশ্য পূরনকল্পে, আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তির অনুকুলে বা ক্ষেত্রমত, মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের ক্ষতিপূরন প্রদানের লক্ষ্যে আর্থিক সহায়তা তহবিল নামে একটি তহবিল গঠিত হইবে।

(২) কর্তৃপক্ষ বিধি দ্বারা নির্ধারিত হারে ও পদ্ধতিতে মোটযানের মালিক বা প্রতিষ্ঠানের নিকট হইতে মোটরযানের শ্রেনিবিন্যাস বিবেচনাক্রমে প্রত্যেক মোটরযানের বিপরীতে আর্থিক সহায়তা তহবিলের জন্য বাৎসরিক বা এককালীন চাঁদা (Contribution আদায় করিবে।

এই আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠিত হয়েছে কিনা আমার জানা নেই বা হয়ে থাকালে এই তহবিল থেকে কোন দূর্ঘটনা কবলিত ব্যক্তির পরিবার বা আহত ব্যক্তি কোন আর্থিক সহায়তা পেয়েছে বলে জানা নেই।

নিম্নলিখিত কারনে এই তহবিল অকার্য্যকর এবং অবাস্তব:
প্রথমত: এই তহবিলের মাধ্যমে তৃতীয় পক্ষের সম্পত্তি নষ্ট জনিত ক্ষতির সহায়তা করার ব্যবস্থা রাখা হয়নি অথচ তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমায় তৃতীয় পক্ষের সম্পত্তির ক্ষতিপূরনের ব্যবস্থা ছিল।
দ্বিতীয়ত: মোটরযান হইতে উদ্ভুত দূর্ঘটনার ফলে কোন ব্যক্তি আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হইলে তার ক্ষতিপূরন আর্থিক সহয়তা তহবিল থেকে আদায় করা এক জটিল কাজ হবে। দূর্ঘটনা জনিত মৃত্যুর প্রমান করা, মৃত্যুর সনদ পত্র যোগার করা বা আহত হলে হসপিটালে চিকিৎসার খরচ আদায় করা কঠিন হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এধরনের দূর্ঘটনা জনিত ক্ষতিপূরণ কোথা থেকে করবে, অর্থাৎ আর্থিক সহায়তা তহবিল সংস্থার কার্যালয়ে কি প্রত্যেক জেলায় জেলায় স্থাপন করা হবে। আর তা যদি করতে হয় তাহলে ঐই তহবিলে অর্থ প্রশাসনিক খরচ বহন করতেই ব্যয় হয়ে যাবে এবং তখন দূর্ঘটনার ক্ষতিপূরণের জন্য কোন তহবিল থাকবে না। তাছারা আমাদের দেশে সরকারি সংস্থার আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং লাল ফিতার দৌরত্ত সর্বজনবিদিত।

পক্ষান্তরে বীমা কম্পানির আওতায় তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা করা থাকলে মটরজানের মাধ্যমে সংঘঠিত কোন দূর্ঘটনার দ্বারা মৃত্যু হলে বা আহত হলে ক্ষতিপূরণ আদায় করা তুলনামূলক ভাবে সহজ হবে। কেননা দেশের প্রধান প্রধান বানিজ্যিক স্থানে বীমা কোম্পানীর শাখা আছে বা প্রতিনিধিরা কর্মরত আছে। তাছাড়া বীমা কোম্পানী কর্তৃক দাবী পরিশোধের ব্যাপারে দায়বদ্ধতা রয়েছে এবং এ ব্যাপারে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রন কতৃপক্ষ (আই. ডি. আর. এ) সর্বদা তদারকি করে থাকে। তবে এই (ধারা ৫৩) তহবিলের একটা কাজ হতে পারে যদি কোন গাড়ীর তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা না করা থাকে তাহলে ঐ সমস্ত মোটরযান কর্তৃক সংঘটিত দূর্ঘটনার ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিকে বা তার উত্তরাধিকারীকে আর্থিক সহায়তা করা। তবে সার্বিক ভাবে আর্থিক সহায়তা তহবিল কোন ভাবেই বীমার বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে না। গত প্রায় ৩৫০ বৎসর যাবৎ বীমা ব্যবস্থা চালু আছে এবং আইনের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। আমাদের আসে পাশের দেশসমূহ যথা: ভারত, পাকিস্থান, শ্রিলংকা, নেপাল, ভূটান, মালদ্বিপ সব দেশেই তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা বলবৎ আছে। এছাড়া, ইউ. এস. এ.ইউ কে, অষ্ট্রেলিয়া ইউরোপিয়ণ ইউনিয়ন সহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশে এ্যাক্ট লায়াবিলিটি ইন্সুরেন্স বা তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা চালু আছে। হঠাৎ করে আমাদের দেশে এই বীমা বাদ দেয়ার কি কারণ থাকতে পারে তা আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না।

সর্বশেষে একটি বিষয় আমার কাছে খটকা লাগছে, তাহচ্ছে, সরক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ধারা ১২৫ অনুসারে মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ বহিত করা হয়েছে। এই ধারাটি নিম্নে উল্লেখ করা হলো ঃ

ধারা ১২৫। রহিত করন ও হেফাজত- (11 Motor Vehicle Ordinance 1983 ( Ordinance No) LV of 1983  অত:পর উক্ত Ordinance বলিয়া উল্লিখিত, এতদ্বারা রহিত করা হইল।

উল্লেখ্য যে, ১৯৮৮ সালে একটি সংশোধণী আইন জারী করা হয় যার টাইটেল হচ্ছে ”মোটরযান (সংশোধনী) আইন ১৯৮৮।” (১৯৮৮ সালের ২৭ নং আইন)। (মোটরযান অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ এর অধিকতর সংশোধনকল্পে প্রনীত আইন)। কিন্তু মোটরযান (সংশোধনী) আইন (১৯৮৮ সালের ২৭ নং আইন) রহিত করন করা হয়নি।

এমতাবস্থায়, আমি মনে করি তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা বা এ্যাক্ট লায়াবিলিটি বীমা বলবৎ আছে। আর তা যদি না হয় তাহলে এই বীমা পূণরায় চালু করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে বিনীত আবেদন জানাচ্ছি।

এ,বি,এম, নুরুল হক
প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক
এবং
বর্তমান সিনিয়র কনসালট্যান্ট
গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড

 

 

 

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৪:১৭ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২৩ আগস্ট ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।