নিজস্ব প্রতিবেদক | মঙ্গলবার, ১৬ জুন ২০২০ | প্রিন্ট | 347 বার পঠিত
দেশে তৈরি মোটরসাইকেল ও এর যন্ত্রাংশ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস বা ভ্যাট (মুসক) অব্যাহতি সুবিধার মেয়াদ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে মোটরসাইকেল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এমএমইএবি)।
জানা যায়, প্রস্তাবিত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে স্থানীয় পর্যায়ে মোটরসাইকেল ও এর যন্ত্রাংশ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস বা ভ্যাট (মুসক) অব্যাহতি সুবিধার মেয়াদ না বাড়ানোয় হুমকির মুখে পড়ছে দেশীয় মোটরসাইকেল শিল্প। করোনাকালে এই সিদ্ধান্তকে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ বলে মনে করছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা।
তারা বলছেন, দেশীয় মোটরসাইকেলকে আমদানিকৃত মোটরসাইকেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাজারে টিকে থাকতে হয়। এই সিদ্ধান্তটি এমন সময় নেওয়া হলো যখন বাংলাদেশে তৈরি মোটরসাইকেল বিশ্ববাজারে রপ্তানি শুরু হয়েছে, অভ্যন্তরীণ বাজারেও দাম কমেছে। এই অবস্থায় রপ্তানি ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি আমদানি করা মোটরসাইকেলের প্রসার ঘটবে এবং দেশীয় মোটরসাইকেল শিল্পের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। এই খাতে বিনিয়োগ ও কর্মংস্থান বৃদ্ধি ব্যাহত হবে। এ অবস্থায় ভ্যাট অব্যাহতির দাবি জানিয়েছে মোটরসাইকেল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এমএমইএবি)।
এমএমইএবি নেতারা বলছেন, সরকারের ধারাবাহিক বিভিন্ন নীতি সহায়তা এবং বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ও উদ্যোগের কারণে মোটরসাইকেল উৎপাদন শিল্প বাংলাদেশে একটি উদীয়মান শিল্প হিসেবে বিকশিত হয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে উৎপাদনমুখী খাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
সরকারের প্রদত্ত নীতি সহায়তার আলোকে এ খাতে দেশি বিদেশি বিনিয়োগকারীগনকে আকৃষ্ট করার জন্য সরকার কর্তৃক গঠিত ‘মোটরসাইকেল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়ন সমন্বয় পরিষদ’ গেজেট প্রজ্ঞাপন নং ০৪.০০.০০০০.৬১১.০৬.০০৫.১৯.২৪২,০ সেপ্টেম্বর ২০১৯) এর একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্র্যারিফ কমিশন নিরলশ প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে। এর ফলে, ইতোমধ্যেই হোন্ডা, সুজুকি, বাজাজ, ইয়ামাহা, হিরো, টিভিএস এর মত বিখ্যাত ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বাংলাদেশে উৎপাদন শুরু হয়েছে যাতে দেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক বিনিয়োগ রয়েছে। তাছাড়া, সম্পূর্ণ দেশীয় মালিকাধীন মোটরসাইকেল উৎপাদনকরী প্রতিষ্ঠান রানার অটোমোবাইল লিমিটেড, নিউ গ্রামীণ মোটরস, রোডমাস্টার বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা প্রযুক্তিগত মান সমৃদ্ধ শিল্পে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে।
বর্তমানে এ শিল্প খাতে বিনিয়োগের পরিমান প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। তাছাড়া স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মোটরসাইকেল এখন আমাদের সার্কভুক্ত দেশ ভূটান, নেপালসহ অন্যান্য দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এর ফলে ক্রমশ একদিকে যেমন মোটরসাইকেল আমদানির বিপরীতে আমদানি ব্যয় হ্রাস পেয়েছে ও বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে তেমনি অন্যদিকে এ পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত অতিরিক্ত বৈদেশিক মুদ্রা দেশের রিজার্ভকে সমৃদ্ধ করছে।
উল্লেখ যে এই শিল্পের সম্ভাবনার কথা বিবেচনায় নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যকে ২০২০ সালের প্রোডাক্ট অব দ্য ইয়ার ঘোষণা করেছেন। যেখানে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য হিসেবে মোটরসাইকেল শিল্প অর্ন্তভুক্ত। এ খাতে শিল্পায়নে গতি আনতে জাতীয় শিল্পনীতি ২০১৬ অনুসরণপূর্বক সরকার বিগত ১৪/১০/২০১৮ তারিখে ‘মোটরসাইকেল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা, ২০১৮’ প্রকাশ করেছে। উক্ত নীতিমালার লক্ষ্যসমূহ হচ্ছে- স্থানীয়ভাবে মোটরসাইকেলের উৎপাদন ২০২১ সালের মধ্যে ন্যূনতম ৫ লক্ষ এবং ২০২৭ সালের মধ্যে ১০ লক্ষে উন্নীতকরণ, প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে স্থানীয় ও আন্তজার্তিক বাজারে মানসম্মত মোটরসাইকেল সরবরাহ, মোটরসাইকেল শিল্প থেকে জিডিপির অবদান ২০২৫ সালের মধ্যে ০.৫% হতে ২.৫% এ উন্নীতকরণ, ২০২৭ সালের মধ্যে ন্যূনতম ৫০% মোটরসাইকেল দেশে উৎপাদনপূর্বক আমদানি ব্যয় হ্রাসকরণ ও বৈদেশিক মুদধা সাশ্রয় এবং এ খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান ৫ লাখ থেকে বাড়িয়ে ২০২৭ সালের মধ্যে ১৫ লাখে উন্নীতকরণ।
এ লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে উক্ত নীতিমালার অনুচ্ছেদ ৩.৩, ৩.৪, ৪.২, ও ৪.৪ সহ একাধিক স্থানে মোটরসাইকেল উৎপাদনকরী প্রতিষ্ঠানকে শুল্ক-কর অব্যাহতিসহ অন্যান্য প্রনোদনা প্রদানের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। যা এ শিল্পের উন্নয়নে সরকারের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে। তাছাড়া, মোটরসাইকেল উৎপাদন শিল্প হালকা প্রকৌশল শিল্প হিসেবে জাতীয় শিল্পনীতিতে উচ্চ অগ্রাধিকার খাতভুক্ত এবং অটোমোবাইল শিল্প হিসেবে অগ্রাধিকার খাতভুক্ত। জাতীয় শিল্পনীতি ২০১৬ এর অনুচ্ছেদ ৪.৪ অনুযায়ী অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতসমূহে প্রদত্ত বিশেষ প্রনোদনা ও শুল্ক-কর অব্যাহতি প্রদান করা হবে এবং এ ধরনের সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে উচ্চ অগ্রাধিকার শিল্প খাত প্রাধান্য পাবে যার অন্যতম দাবীদার মোটরসাইকেল উৎপাদন শিল্প। এ ধারাবাহিকতায় এ শিল্পে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শুল্ক, ভ্যাট ও কর অব্যাহতি প্রদান করে আসছিল।
কিন্তু করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে লকডাউন এবং অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে এ শিল্প এখন মারাত্মক হুমকির মুখে। বিগত দুই মাসেই এ শিল্পে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা যা আগামী এক বছরে ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা হতে পারে। ফলে, প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার দেশি বিদেশি বিনিয়োগ এখন অনিশ্চিতার মুখে এবং এ শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ৫ লাখ লোক এখন জীবিকা হারানোর ভয়ে আতংকিত ও দিশেহারা। ফলে সরকারের প্রত্যক্ষ নীতি সহায়তা ছাড়া এ খাত টিকিয়ে রাখাই এখন অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়বে।
এমন অর্থনৈতিক মন্দা ও জাতীয় দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের স্বার্থে সরকার গঠিত ‘মোটরসাইকেল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়ন সমন্বয় পরিষদ” এর একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে আমাদের আবেদন বিবেচনাপূর্বক মোটরসাইকেল শিল্প উন্নয়ন নীতি ২০১৮ ও জাতীয় শিল্প উন্নয়ন নীতি ২০১৬ এর আলোকে স্থানীয়ভাবে মোটরসাইকেল ও এর যন্ত্রাংশ উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা এ বাজেটেও বলবৎ থাকবে ও মেয়াদ বৃদ্ধি করা হবে মর্মে আমরা আশস্ত ছিলাম।
উল্লেখ্য যে,জাতীয় এপিআই ও ল্যাবরেটরি বিকারক উৎপাদন ও রপ্তানি নীতি এর আলোকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এপিআই উৎপাদনের ক্ষেত্রে মূসক অব্যাহতি প্রদান করেছে। তাছাড়া, ফ্রিজ, এসি, কম্প্রেসর, লিফট ইত্যাদিসহ মোবাইল উৎপাদনের ক্ষেত্রে মূসক অব্যাহতি সুবিধা বহাল থাকলেও জাতীয় শিল্প নীতি তে উচ্চ অগ্রাধিকার খাত হিসেবে মোটরসাইকেল শিল্প অন্তর্ভুক্ত থাকা স্বত্তেও এ করোনাকালীন অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে মোটরসাইকেল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ভ্যাট অব্যাহতির সময়সীমা বর্ধিত করা হয়নি যা নিতান্তই অনভিপ্রেত এবং অনাকাংখিত। এটি একদিকে যেমন মন্ত্রিসভা অনুমোদিত ‘মোটরসাইকেল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা, ২০১৮’ এবং ‘জাতীয় শিল্প নীতি ২০১৬’ এ সরকার প্রদত্ত শুল্ক কর প্রনোদনা সুবিধার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় তেমনি শিল্পায়নের মাধ্যমে সরকারের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণনয়। তাছাড়া, নীতি সহায়তার ক্ষেত্রে ন্যূনতম ধারাবাহিকতা না থাকলে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের উপর এ খাতসহ সকল খাতেই মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে যা আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পথ রুদ্ধ করবে।
এছাড়াও, করোনাকালীন অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় বিশ্বের সকল দেশের কর প্রশাসন যখন বিভিন্ন প্রনোদনা প্রদান করছে তখন স্থানীয় মোটরসাইকেল শিল্পে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে তা ব্যবসায়ী সমাজ সহ বিনিয়োগকারীদের ব্যাপকভাবে নিরুৎসাহিত করবে।
অধিকন্তু, বর্তমান করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক গণপরিবহনকে এই ভাইরাস সংক্রমণের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং গণপরিবহনের ব্যবহার সীমিত করার উপদেশ প্রদান করেছে। এক্ষেত্রে দ্রুতগামী ও অধিকতর নিরাপদ যানবাহন হিসেবে মোটরসাইকেলের ব্যবহার গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে হতে পারে। সুতরাং অধিকতর কম মূল্যে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে মোটরসাইকেল সরবরাহ করা সম্ভব হলে ভাইরাস বিস্তার রোধে কার্যকরী ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে। সুতরাং মোটরসাইকেল স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা বহাল রাখা অত্যন্ত জরুরি।
বর্ণিতাবস্থায়, করোনা ভাইরাসজনিত অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা ও তৎপরবর্তীতে এ শিল্প টিকিয়ে রাখা, দেশি বিদেশী বিনিয়োগ সুরক্ষা,কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ, আমদানি ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় ও রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও সর্বোপরি শিল্পায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে, মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত ‘মোটরসাইকেল শিল্প উন্নয়ন নীতি, ২০১৮’ ও ‘জাতীয় শিল্প নীতি ২০১৬’ এর আলোকে ও সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে স্থানীয় পর্যায়ে মোটরসাইকেল ও এর যন্ত্রাংশ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আগামী ২০২৭ সন পর্যন্ত মূসক অব্যাহতি সুবিধা প্রদান করার দাবি জানিয়েছেন এ খাত সংশ্লিষ্ট দেশি উদ্যোক্তারা।
Posted ৯:২৮ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১৬ জুন ২০২০
bankbimaarthonity.com | saed khan