নিজস্ব প্রতিবেদক | শুক্রবার, ১৫ মে ২০২০ | প্রিন্ট | 418 বার পঠিত
করোনার কারণে অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধি ও রাজস্ব আহরণে ধস সামাল দিতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত ৫৪ দশমিক ২৬ শতাংশ ব্যাংক ঋণ নিতে হচ্ছে সরকারকে। চলতি অর্থবছরের শুরুতে ৪৭ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এখন ব্যাংকগুলো থেকে ৭২ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকার ঋণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক ঋণ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২৫,৬৭০ কোটি টাকার বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি এই লক্ষ্যমাত্রা চূড়ান্ত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার ব্যাংক থেকে বেশি মাত্রায় ঋণ গ্রহণের ফলে তারল্যের সংকট হবে। এতে বেসরকারি ঋণপ্রবাহে ভাটার সৃষ্টি হবে। শেষ পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ কমে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বছরের শুরুতে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ৪৭ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৮ হাজার ৯৪ কোটি টাকা, এখন সেখান থেকে সরে গিয়ে ৫২ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অপরদিকে দীর্ঘমেয়াদি ১৯ হাজার ২৭০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত নেয়া হবে ২০ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা। তবে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেয়ার পরিমাণ বেশি বাড়ানো হয়েছে।
জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ সোমবার বলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বর্তমান রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হবে। আর এটা দেখা দিলে ব্যাংক ঋণ করা ছাড়া বিকল্প উপায় থাকে না সরকারের হাতে। এ জন্যই সম্ভবত বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছেন। এর অর্থ কোত্থেকে আসবে এটি বাংলাদেশ ব্যাংক পরিষ্কার করে দিয়েছে। অর্থাৎ বিদ্যমান তারল্য থেকে সেটি ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে প্রণোদনার ব্যয় মেটাতে সরকারকে ব্যাংকের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হতে হবে না। মূলত রাজস্ব ঘাটতির কারণেই ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে।
সরকার ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নেয়া বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বিআইডিএসের সাবেক ডিজি এম কে মুজেরি বলেন, স্বাভাবিক নিয়মে ব্যাংক থেকে সরকার বেশি ঋণ করলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এর নেতিবাচক প্রভাব কম পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, করোনাভাইরাসের কারণে শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ও স্থবির হয়ে আছে। পরিচালনার জন্য এই মুহূর্তে ঋণের প্রয়োজন হচ্ছে না। ফলে বিনিয়োগে খুব বেশি আঘাত করবে না, সরকার বেশি মাত্রায় ঋণ করায়। তবে এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেছেন, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার পর শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ঋণের চাহিদা বাড়বে। সেটি মোকাবেলা করতে সরকারের এখন থেকে প্রস্তুতি থাকতে হবে।
সূত্রমতে, করোনার আগেই চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এ সময় ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আদায় হয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা। এখন এ ঘাটতির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে। কারণ, ২৬ মার্চ এর পর থেকে সবকিছু ‘লকডাউনে’ পড়ে। ফলে শিল্পপ্রতিষ্ঠান ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। যে কারণে শেষ তিন মাসে রাজস্ব আদায়ে আরও বড় ধরনের ধস নেমে আসবে।
সূত্র আরও জানায়, করোনাভাইসারের কারণে সম্প্রতি স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় বেড়েছে। বছরের শুরুতে স্বাস্থ্যসেবা খাতে বরাদ্দ দেয়া হয় ৯ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা। এ বরাদ্দের বাইরে অর্থ বিভাগ এ পর্যন্ত আরও ৫০০ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ দিয়েছে। এ ছাড়া সরকারের ব্যয় বেড়েছে প্রণোদনা খাতেও। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও সাধারণ মানুষের পুনর্বাসনের জন্য সরকার এক লাখ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ রয়েছে। যেটি সরাসরি চলতি বাজেট থেকে দেয়া হবে।
এ ছাড়া অন্যসব প্যাকেজের সুদের ৫০ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে পরিশোধ করার ঘোষণা দিয়েছে। এতে সরকারের প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে শুধু সুদ পরিশোধে। পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, নার্স-ডাক্তার-পুলিশসহ অন্য শ্রেণির চাকরিজীবীদের জন্য একটি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বা মৃত্যু হলে সেখান থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। ফলে ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে সরকারের ঋণ গ্রহণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৭ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা। কিন্তু জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে ঋণ নিয়ে ফেলেছে ৫৩ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬ হাজার ২৮ কোটি টাকা বেশি। এরই মধ্যে সামনে চলে আসছে করোনার অস্বাভাবিক ব্যয় ও রাজস্ব খাতে বড় ধরনের ধস। যে কারণে এখন লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আরও ২৫ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা বেশি ঋণ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এতে সরকারের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৭২ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা।
Posted ৬:১৪ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ১৫ মে ২০২০
bankbimaarthonity.com | saed khan