বিবিএনিউজ.নেট | বুধবার, ০৮ মে ২০১৯ | প্রিন্ট | 852 বার পঠিত
রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যাংকের মালিকরা বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। বিনিময়ে কথা দিয়েছিলেন নয়-ছয় সুদহার কার্যকর করা ছাড়াও বেশকিছু শর্ত পরিপালনের। ওই সব সুবিধাভোগের পর বর্তমানে শর্তভঙ্গের প্রতিযোগিতায় নেমেছে প্রভাবশালীদের ব্যাংকগুলো। মালিকরা সুদহার বাড়াচ্ছেন হু-হু করে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১২ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাড়ছে ঋণের সুদহারও। গত বছরের জুলাই থেকে আমানতে সর্বোচ্চ ৬ এবং ঋণে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদ কার্যকরের ঘোষণা দেন ব্যাংক মালিকরা। এর পূর্বশর্ত হিসেবে ৫টি সুবিধা আদায় করে নেন।
ব্যাংকের কর কমানো, নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) কমানো, সরকারি আমানতের অর্ধেক বেসরকারি ব্যাংকে রাখা, রেপো রেট কমানো এবং ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) সমন্বয়সীমা দফায় দফায় বাড়ানো। সব সুবিধা ১ জুলাই থেকে ভোগ করছে ব্যাংক। কিন্তু কোনো ব্যাংকই নয়-ছয় সুদহার কার্যকর করেনি। আগে থেকে কয়েকটি খাতে কম সুদ ছিল সেগুলোকেই কার্যকর বলে উপস্থাপন করেছে কয়েকটি ব্যাংক।
ব্যাংকের এমন কার্যক্রমে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ব্যাংকের মালিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ব্যাংকের সুদহার কমানো হলো না কেন? এছাড়া তারল্য সংকটের কারণে গোপনে গোপনে বেশি সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করেছে কিছু ব্যাংক। কিন্তু চলতি বছরের শুরু থেকে গোপনীয়তা ছেড়ে প্রকাশ্যে শর্তভঙ্গ শুরু করে কয়েকটি ব্যাংক। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সুদহার বাড়ানোর ঘোষণা দেয় একটি ব্যাংক।
ব্যাংকটি ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ মুনাফায় আমানত সংগ্রহের বিজ্ঞাপন প্রচার করে। এর পর অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংক সুদহার বাড়ানোর ঘোষণা দিতে শুরু করে। সম্প্রতি আমানতের বিপরীতে প্রায় ১৩ শতাংশ সুদ দেওয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে নতুন আসা একটি ব্যাংক। ব্যাংকটির মাসিক জমায় (ডিপিএস) সুদ দিচ্ছে ৯ থেকে ১১ দশমিক ৭৮ শতাংশ। পাঁচ বছর দশ মাসে জমাকৃত আমানত দ্বিগুণ এবং ৯ বছরে তিনগুণ হবে।
এতে সুদহার দাঁড়ায় যথাক্রমে ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশ ও ১২ দশমিক ৯৮ শতাংশ। গত ২৫ এপ্রিল থেকে এই নীতিলঙ্ঘনের সুদহার কার্যকর করেছে ব্যাংকটি। নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংক বাড়তি সুদহার কার্যকর করেছে। এসব ব্যাংকের মালিকরা রাজনৈতিকভাবে বেশ প্রভাবশালী। একটি ব্যাংক আমানতের সুদহারের সঙ্গে ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড ও মুনাফা যোগ করে ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হবে।
এক্ষেত্রে ১০ শতাংশ আমানত নিলে ঋণের সুদহার কমপক্ষে ১৪ শতাংশ হবে এটিই স্বাভাবিক। ব্যাংক মালিকরা ৫টি সুবিধার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে আদায় করে নেন ৩টি সুবিধা। তাই সুদহার কার্যকর হচ্ছে কিনা সেটি মনিটর করার কথা ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ৯-৬ সুদহার কার্যকর হয়নি। তবে এটি ব্যাংকগুলোর নিজস্ব বিষয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আমানত ও ঋণের সুদহার ব্যবধানের (স্প্রেড) মার্চভিত্তিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঋণের ক্ষেত্রে গড়ে ১০ শতাংশের বেশি সুদ আদায় করছে ২৮টি ব্যাংক। খাতভিত্তিক ঋণের সুদহার ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ আদায় করছে কিছু কিছু ব্যাংক। অথচ ব্যাংকের মালিকদের ঘোষণা অনুযায়ী ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হবে ৯ শতাংশ।
৯ শতাংশের নিচে সুদ রয়েছে মাত্র ২টি ব্যাংকের। বাস্তবিক পরিস্থিতিতে সুদহার এ মুহূর্তে কমানো সম্ভব নয় বলে জানান ব্যাংকাররা। আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে কিছু ব্যাংক। কলমানি ও রেপোর মাধ্যমে টাকা নিয়ে প্রয়োজন মেটাচ্ছে। গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে না পারলে ব্যাংকের ইমেজ সংকট তৈরি হবে। এ জন্য যেকোনো মূল্যে আমানত সংগ্রহের চেষ্টা করছে ব্যাংকগুলো। এতে সুদহার বাড়ছে। এদিকে ব্যাংকের মালিকদের সুবিধাভোগের পর এবার ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে সুবিধা নেওয়া শুরু করেছেন।
বিশেষ করে ঋণখেলাপিরা এখন সুবিধা হাতিয়ে নেওয়ার তুঙ্গে। সূত্র জানায়, নয়-ছয় কার্যকরে শুভঙ্করের ফাঁকি ছিল। ব্যাংকের মালিকরা যোগসাজশ করে কম সুদে ঋণ ভোগ করেছেন। অন্যরা এটি পাননি। নিজেরা সুবিধা নিয়ে একে ব্যাংকের কার্যকর বলে চালিয়ে দেন। তারল্য সংকটের কারণে ২০১২ ও ১৩ সালের দিকে ব্যাংকগুলোয় সুদহার ব্যাপকহারে বাড়তে থাকে। আমানতের সুদহার ১৩ থেকে ১৭ শতাংশ উঠে যায়।
এখন আবার সেই একই ধরনের সংকট শুরু হয়েছে। সম্প্রতি প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাহেল আহমেদ বলেন, সুদহার কমবেশি বাজারের ওপর নির্ভরশীল। টাইমলাইন বেঁধে কমিয়ে আনা কঠিন। তবে আমরা চেষ্টা করছি গ্রাহকবান্ধব সুদহার কার্যকর করতে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) প্রেসিডেন্ট ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদি আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিয়ে থাকে।
বেশিরভাগ স্বল্পমেয়াদি আমানতের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর তা গ্রাহক তুলে নিয়ে যান। ফলে ব্যাংকগুলোকে ঋণের তহবিল জোগাড় করতে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়। সুদহার বেড়ে যায়। খেলাপি ঋণে ব্যাংকের তহবিল আটকে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোয় টাকার চাহিদা রয়েছে। ফলে আমানতের সুদহার বাড়ছে। আর আমানতের সুদহার বাড়লে ঋণের সুদহারও বাড়বে। তবে আমরা চেষ্টা করছি সুদহার কমাতে।
Posted ১২:৩৪ অপরাহ্ণ | বুধবার, ০৮ মে ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed