বিবিএনিউজ.নেট | রবিবার, ০৯ জুন ২০১৯ | প্রিন্ট | 538 বার পঠিত
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সহযোগিতায় নিজ দেশকে আকর্ষণীয় এক বিনিয়োগ গন্তব্যে পরিণত করেছেন আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি। বাস্তবতা হলো, এখানে অভিজাতদের পকেট যখন ক্রমেই ভারী হয়ে উঠছে, সাধারণ মিসরীয়দের জীবনমানে তখন দেখা যাচ্ছে ক্রমাগত অবনতি।
বছরখানেক হলো মিসর নিজেকে বৈশ্বিক বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। দেশটিকে এখন বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় উদীয়মান বাজার হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। মিসরীয় পুঁজিবাজার থেকে দুই পয়সা কামিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে জলস্রোতের মতো এসে ভিড় জমাচ্ছেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে দেশটির স্থানীয় বাজারের মোট ঋণে বিদেশীদের ভাগ ছিল আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২০ শতাংশেরও বেশি। এ প্রবণতা বজায় থাকবে চলতি বছরেও। এক বিনিয়োগ ব্যাংকের ভাষ্যমতে, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও পূর্ব ইউরোপে যত সংস্কারের কাহিনী রয়েছে, তার মধ্যে মিসরের এ পুনরুত্থানের গল্পটিই সবচেয়ে বেশি চিত্তাকর্ষক।
প্রকৃতপক্ষে এসব গালগল্পের আড়ালে রয়েছে অন্ধকারাচ্ছন্ন এক বাস্তবতা। চলতি বছরের এপ্রিলে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মিসরের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশই হয় গরিব অথবা নাজুক অবস্থানে রয়েছে। সার্বিক জীবনমানের দ্রুতাবনতি ঘটছে। তাহলে মিসরের অর্থনীতির বাইরের দিকটা এতটা মসৃণ হলো কীভাবে?
মিসরের এ অলৌকিক অর্থনৈতিক পুনরুত্থানের পেছনে রয়েছে বড় মাপের এক প্রতারণা। আর এ প্রতারণার নীলনকশাটির মূল কারিগর জেনারেল থেকে প্রেসিডেন্ট বনে যাওয়া আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির সরকার ও আইএমএফ। জনগণের অর্থের ক্রমাগত অব্যবস্থাপনা ও অবহেলা এবং মিসরীয় পাউন্ডের অবমূল্যায়নের কারণে পাঁচ বছরে মিসরের বহিঃঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। সরকারি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণেরও বেশিতে এবং অদূর ভবিষ্যতেও এ প্রবণতা অব্যাহত থাকবে।
বর্তমানে মিসরীয় বাজেটের ৩৮ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে শুধু ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য। ঋণ ও কিস্তি বাবদ প্রদেয় অর্থ যোগ করার পর এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৮ শতাংশেরও বেশিতে।
জনগণকে শক্তিশালী করা বা সহায়তা দেয়ার বদলে মিসরীয় সরকারি সম্পদের সিংহভাগই ব্যয় হচ্ছে ঋণসংক্রান্ত অর্থ পরিশোধের পেছনে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবকাঠামোর পেছনে এত কম ব্যয় বরাদ্দের বিষয়টি ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী ১০ কোটি বাসিন্দার দেশটির জন্য বেশ আশঙ্কাজনক। বিষয়টি আশঙ্কাজনক ইউরোপীয়দের জন্যও।
বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে মিসর শিগগিরই দেউলিয়া হয়ে পড়বে। সম্পূর্ণ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে মিসর। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও সংবিধান পরিবর্তনের জন্য অনুষ্ঠিত গণভোটে ব্যাপক মাত্রায় কারচুপির খবর ফাঁস হওয়ায় সিসি সরকারও আন্তর্জাতিক মহলে এখন বৈধতা হারাচ্ছে। এছাড়া জনগণের প্রাপ্য মৌলিক সেবা নিশ্চিতে ব্যর্থতা ও নৃশংস দমন-পীড়নে সরকারের শাসনকার্যের অক্ষমতাই প্রকাশ পাচ্ছে।
কিন্তু এক্ষেত্রে জনগণের তুলনায় আন্তর্জাতিক অভিমতের বিষয়টি অত্যন্ত গৌণ। একটি দেশ যখন এভাবে পতনের দিকে এগিয়ে যায়, তখন জনগণ নিজেই এ সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব নেয়। যদি তা না-ও পারে, সেক্ষেত্রে তাদের মধ্যে অন্য কোনো স্থানে নিজের আবাস খুঁজে নেয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, লিবিয়া ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পর সেখানকার নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক হারে গণঅভিবাসনের প্রবণতা দেখা যায়। এর কুফলগুলো সচেতন সবাই বেশ ভালোভাবে অনুধাবন করতে পেরেছেন। আয়তনে মিসর লিবিয়ার তুলনায় প্রায় ১৫ গুণেরও বেশি বড়। সুতরাং এ দেশটির ব্যর্থতার প্রভাবও হবে নাটকীয় ও অচিন্তনীয়।
অন্যদিকে আইএমএফ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে অনেক। মিসরীয় অর্থনীতির কাঠামোয় অনেক হস্তক্ষেপ করেছে সংস্থাটি। আইএমএফ মিসরের প্রবৃদ্ধির হার প্রকাশ করে আসছে। কিন্তু এ অংক মাত্রাতিরিক্ত ঋণ দিয়ে অনেক বেশি ফোলানো-ফাঁপানো। বিষয়টা অনেকটা সাধ্যের তুলনায় অতিরিক্ত ঋণ করার মাধ্যমে নিজের আয় বাড়িয়ে দেখানোর মতো।
এ ধরনের অতিরঞ্জনের আরেকটি উদাহরণ হলো মিসরের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের বিষয়টি। এর পরিমাণ ৪ হাজার কোটি ডলার। আপাতদৃষ্টিতে বিপুলায়তন এ রিজার্ভের বড় একটি অংশ গঠিত হয়েছে ধারের মাধ্যমে, যা দেশটির বৈদেশিক ঋণের অংশ। এ অর্থ যেমন কৃত্রিমভাবে মিসরীয় অর্থনীতির আকার বাড়াচ্ছে, তেমনি এর স্থিতিশীলতাও নষ্ট করছে।
এর সবই আইএমএফের হস্তক্ষেপের প্রত্যক্ষ প্রভাব। ব্যালান্স অব পেমেন্টের সমস্যার সমাধান, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধিকে গতিশীল করে তোলার শর্তে ঋণ দিয়ে থাকে আইএমএফ। যদিও বাস্তবে অর্থনৈতিক ভারসাম্যের সমস্যা মোকাবেলার নামে ঋণগ্রহীতা সরকারগুলোকে জনকল্যাণমূলক ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে আনতে চাপ প্রয়োগ করে থাকে সংস্থাটি। বিষয়টি এমন, ঘাটতি কমাও, তাহলেই তোমরা ঋণ পাওয়ার উপযোগী।
জনকল্যাণমূলক ব্যয়, সরকারি কর্মচারীদের বেতন অথবা ঋণ বা সুদ পরিশোধ; মূলত এ কয়েকটি খাতেই বেশির ভাগ ব্যয় হয় সরকারের। এর মধ্যে সিসি কোন খাতে ব্যয় কমানোর সিদ্ধান্ত নেবেন; তা সহজেই বোঝা যায়। যে সরকারি ভর্তুকির ওপর মিসরের অনেক হতদরিদ্র নির্ভরশীল, তা তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হলো। বিষয়টি নিয়ে সিসির ঘোষণা, ‘আমি জানি। মিসরের জনগণ আরো অনেক সহ্য করতে পারে।’
কিছু ক্ষেত্রে হয়তো এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নেয়া যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রেও যথেষ্ট পরিমাণে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির উপস্থিতি থাকতেই হবে। অন্যথায় সরকারি প্রণোদনার ওপর নির্ভরশীলরা দ্রুতই দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে পড়বে। মিসরে সরকারি কোনো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নেই। সিসি সরকারকে এ ধরনের কর্মসূচি নিতে বলছে না আইএমএফও।
আইএমএফের এ দৃষ্টিভঙ্গির পেছনের ধারণাটি হলো, সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধির বিপরীতে ঘাটতি কমানোই দেশ ও দেশের নাগরিকের জন্য সবচেয়ে ভালো ফল বয়ে আনবে। এমন ধারণাকে আসলে বালখিল্য ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। ধারণাটি এমন, যেন সিসির মতো এক স্বৈরাচারী স্ট্রংম্যান জনকল্যাণকে অভিজাত শাসক সম্প্রদায়ের স্বার্থের মতো সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন। প্রকৃতপক্ষে সিসি গত পাঁচ বছরে দেশের নাগরিকদের জন্য অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছুই দেখাতে পারেননি। আইএমএফের অনুরোধে তার হাত দিয়ে সংঘটিত প্রতিটি অর্থনৈতিক সংস্কার সেসব জনতার ওপর ক্রমাগত ভার চাপিয়ে গেছে, যাদের এটি বহনের সক্ষমতা সবচেয়ে কম।
যখন আইএমএফের পক্ষ থেকে মিসরের সুদ পরিশোধের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলো, তখন মূলধনের খোঁজে আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারের দ্বারস্থ হলেন সিসি। মিসরের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে নতুন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা গড়ে তোলার জন্য সিসি নির্ভর করলেন আইএমএফের নানামুখী ঋণের ওপর। এ ধরনের পরিস্থিতি বেশিদিন চলতে পারে না। নড়বড়ে হয়ে উঠেছে অর্থনীতির ভিত্তি। অনর্থক ও ব্যয়বহুল অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য সিসি সরকার এখন ঋণ করেই চলেছে। যদিও সাধারণ মিসরীয়দের অধিকাংশেরই এখন রান্নার তেলটুকুও জোগাড় করতে নাভিশ্বাস উঠে যায়।
এ ধরনের সমস্যার সমাধানের শুরুটা রাজনীতিতে। যে সরকার জনগণের অর্থ নিয়ে এ ধরনের অব্যবস্থাপনা দেখাতে পারে, সে সরকারের পক্ষে মিসরের অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখ থেকে ফিরিয়ে আনার মতো নীতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর সিসির সামরিক একনায়কতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ এখন সাবেক স্বৈরাচার হোসনি মোবারকের ঘোর সংরক্ষণবাদী দুর্বৃত্তদের চেয়েও বেশি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোয় জনস্বার্থের বিষয়টি খুব কমই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। শুধু সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কিছু ব্যক্তিই এখান থেকে উপকার পেয়ে থাকে। এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের ক্ষমতাকে আরো সুসংহত করে তোলে ও দেশের ঘাড়ে আরো দৃঢ় হয়ে চেপে বসে।
লিবিয়ায় মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফির শাসনের ক্ষেত্রে অনেকটা একই প্যাটার্ন দেখা গেছে। বিশ্বজুড়ে স্বৈরাচারদের ক্ষেত্রে বিষয়টি সাধারণ। তথাকথিত সবচেয়ে আকর্ষণীয় উদীয়মান বাজার ও বৈশ্বিক বিনিয়োগ গন্তব্য এখন বিনাশের পথেই এগিয়ে চলেছে। আর এ যাত্রায় কাণ্ডারি হলেন সিসি। মিসর যদি শেষ পর্যন্ত অন্তহীন হতাশায় নিমজ্জিত হয়, তাহলে শুধু মিসরীয়রাই ভুগবে না। ভুগবে আফ্রিকা। ভুগবে মধ্যপ্রাচ্য। ভুগবে প্রাগমাটিজমের নামে সিসিকে বাড়তে দেয়া ইউরোপও।
—ফরেন পলিসি থেকে ভাষান্তরিত। লেখক মিসরের সাবেক বিনিয়োগমন্ত্রী
Posted ৩:৫০ অপরাহ্ণ | রবিবার, ০৯ জুন ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed