রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

Ad
x

সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ভাটার টান

বিবিএনিউজ.নেট   |   মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২০   |   প্রিন্ট   |   525 বার পঠিত

সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ভাটার টান

অলস তারল্যের চাপে ২০১৪ সালে কমতে শুরু করে ব্যাংক আমানতের সুদহার। একপর্যায়ে তা নেমে আসে মূল্যস্ফীতিরও নিচে। এ অবস্থায় সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে ব্যাংক গ্রাহকরা। পাঁচ বছর ধরে সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের এ সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করেই ছন্দপতন হয়েছে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে। পর্যাপ্ত সঞ্চয়পত্র নিয়ে বিক্রেতারা বসে থাকলেও দেখা মিলছে না ক্রেতার।

২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রতিদিন নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ১২৮ কোটি টাকার। বিদায়ী বছরের নভেম্বরে তা ১০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। ২০১৯ সালের নভেম্বরজুড়ে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে মাত্র ৩২০ কোটি টাকা। যদিও আগের বছরের একই সময়ে ৩ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল।

সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ভাটার টান শুরু হয় ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম দিনই। গত বছরের আগস্ট থেকেই ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। ওই মাসে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি এক লাফে কমে ১ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকায় নেমে আসে। এরপর তা আরো কমে সেপ্টেম্বরে ৯৮৫ কোটি, অক্টোবরে ৮২২ কোটি ও সর্বশেষ নভেম্বরে ৩২০ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবৈধ পথে উপার্জিত অর্থের একটি অংশ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ হতো। ক্রয়সীমার অতিরিক্ত সঞ্চয়পত্রও কিনতেন প্রভাবশালীরা। ছিল না সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের কোনো কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডারও। ফলে কালো টাকা বিনিয়োগের নিরাপদ মাধ্যম হয়ে উঠেছিল সঞ্চয়পত্র। কিন্তু চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে সঞ্চয়পত্র বিক্রিকে অটোমেশনের আওতায় আনা হয়েছে। এছাড়া সঞ্চয়পত্র কেনায় বাধ্যতামূলকভাবে জমা দিতে হচ্ছে গ্রাহকের জাতীয় পরিচয়পত্র ও ই-টিআইএন সার্টিফিকেট। ফলে কালো টাকার মালিকরা অর্থের বড় অংশই বিদেশে পাচার করছেন। বাকি অর্থ বিনিয়োগ করছেন প্লট ও ফ্ল্যাট ক্রয়ে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট বিক্রি বেড়েছে।

ছয় মাস আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয়সহ সারা দেশের সব কার্যালয়েই সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় ছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকসহ অন্য সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের ভিড় দেখা যেত। সঞ্চয় ব্যুরো, পোস্ট অফিসসহ অন্য উৎস থেকেও সঞ্চয়পত্র কিনতে মরিয়া ছিলেন গ্রাহকরা। পাঁচ বছর ধরে চলা এ দৃশ্যে হঠাৎই পরিবর্তন এসেছে। গত এক সপ্তাহ বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয়, সোনালী ব্যাংকসহ অন্য কয়েকটি ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় ও সঞ্চয়পত্র ব্যুরোর একাধিক শাখা পরিদর্শন করে দেখা গেছে একেবারেই ভিন্নচিত্র।

গত সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সঞ্চয়পত্র বিক্রির বুথে ক্রেতাদের কোনো সারি নেই। দু-একজন গ্রাহক সঞ্চয়পত্রের মুনাফা তুলতে এসেছেন। কেউ কেউ নতুন সঞ্চয়পত্রও কিনছেন। গ্রাহকরা এসেই বিক্রয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে সঞ্চয়পত্র নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। অথচ ছয় মাস আগেও বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয় থেকে সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য দিনভর লাইনে দাঁড়াতে হতো। সকাল ১০টায় সারিতে দাঁড়ালে সঞ্চয়পত্র হাতে পেতে বিকাল গড়িয়ে রাত হতো। সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের সারি দীর্ঘ হতে হতে সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছত।

একই পরিস্থিতি দেখা গেছে রাজধানীর মাতিঝিলে সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়েও। সোনালী ব্যাংক ছাড়াও এ কার্যালয়ে সঞ্চয়পত্র ব্যুরোর একটি শাখা রয়েছে। সোমবার দুপুরে গিয়ে ওই কার্যালয় থেকে কোনো গ্রাহককে সঞ্চয়পত্র কিনতে দেখা যায়নি।

সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে আগের মতো চাপ নেই বলে জানান সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মোহাম্মদ মোদাচ্ছের হাসানও। তিনি বলেন, প্রতিদিন অল্প কিছু গ্রাহক হলেও সঞ্চয়পত্র কিনছেন। পেনশনারসহ প্রকৃত গ্রাহকরা বর্তমানে সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছেন। অটোমেশন চালু হওয়ার পর থেকেই সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে সব অনিয়ম বন্ধ হয়ে গেছে। আগে বড় অংকের সঞ্চয়পত্র বিক্রির জন্য প্রভাবশালীরা তদবির করতেন, এখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেসব তদবির বন্ধ হয়ে গেছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি, সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি ও অন্যান্য খাত থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। গত অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ছিল ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। বিক্রি বাড়তে থাকায় সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা ঠিক করা হয়। যদিও অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে সব ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রি অটোমেশনের আওতায় আনা হয়। একই সঙ্গে ক্রয়সীমা কমানো হয় সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের। বর্তমানে এক ব্যক্তি যেকোনো স্কিমের সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন। প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি কর্তৃক সঞ্চয়পত্র ক্রয় প্রায় বন্ধ রয়েছে। প্রকৃত গ্রাহকদের হাতে সঞ্চয়পত্র পৌঁছাতেই এসব উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গত জুলাইয়ে উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার পর সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে অস্বাভাবিক স্থবিরতা নেমে এসেছে।

চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। যদিও ২০১৮-১৯ অর্থবছরের একই সময়ে ২১ হাজার ৬৬২ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। সে হিসেবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে এক-চতুর্থাংশে নেমে এসেছে। সর্বশেষ নভেম্বরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি মাত্র ৩২০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। যদিও ২০১৮ সালের নভেম্বরে নিট ৩ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। ২০১৯ সালের নভেম্বর শেষে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৯১ হাজার ৫০১ কোটি টাকা।

অবৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থ দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিক্রি কমেছে বলে মনে করেন জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আবু তালেব। তিনি বলেন, আগে কে কত টাকার সঞ্চয়পত্র কিনছে, কেন্দ্রীয়ভাবে তা জানার সুযোগ ছিল না। এখন অটোমেশনের কারণে সঞ্চয়পত্রের সব ক্রেতার তথ্য কেন্দ্রীয় ভাণ্ডারে সংরক্ষিত হচ্ছে। কেউ চাইলেই সীমার অতিরিক্ত সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছে না। এছাড়া সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে ই-টিআইএন সার্টিফিকেট জমা দিতে হচ্ছে। জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নম্বরসহ অর্থের উৎস জানাতে হচ্ছে। এসব কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে স্বচ্ছতা এসেছে। ফলে এ খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের পথও বন্ধ হয়েছে। তবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি এতটা কমে যাওয়াটাও কাঙ্ক্ষিত নয়। সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ানোর বিষয়টি সরকার সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে।

সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর ও একাধিক ব্যাংকের কর্মকর্তা জানান, আগে রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালীরা কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র রাখার জন্য ফোন করতেন। অনেকেই প্রতিনিধি পাঠিয়ে সে সঞ্চয়পত্র নিয়ে যেতেন। কিন্তু অটোমেশন চালু হওয়ার পর থেকে প্রভাবশালীরা সঞ্চয়পত্র কেনা বন্ধ করে দিয়েছেন। আগের মতো এখন সঞ্চয়পত্রের জন্য তদবির আসছে না।

সংশ্লিষ্টদের এ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের সময়। গত জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশনে দেয়া প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ তাদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা অর্থাৎ ধনী মানুষেরা ব্যাপক হারে সঞ্চয়পত্র কিনে রেখেছেন।

আগে যে অর্থে প্রভাবশালীরা সঞ্চয়পত্র কিনতেন, সে অর্থ এখন কোথায় বিনিয়োগ করছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের একটি অংশের অর্থ ব্যাংকে আমানত হিসেবে এসেছে। তবে কালো টাকার বড় অংশই প্লট বা ফ্ল্যাট ক্রয়ে বিনিয়োগ হচ্ছে। একই সঙ্গে বাজার থেকে নগদ ডলার কিনে নিয়েও জমা করছেন অনেকে। এছাড়া দেশের বাইরে পাচার তো হচ্ছেই।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের বিক্রি ও নির্মাণ বেড়েছে। বর্তমানে আবাসন খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো পাঁচ-সাত হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট নির্মাণ করছেন। এসব ফ্ল্যাট নির্মাণের আগেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। আবার মধ্যবিত্তদের জন্য তৈরি করা ছোট আকারের ফ্ল্যাট অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে।

সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমায় ওই খাতের কিছু অর্থ ব্যাংকে আসছে বলে জানান মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়েছে। আমানতের সুদহার বাড়ায় গ্রাহকরা সঞ্চয়পত্র না কিনে ব্যাংকে এফডিআর করছেন। তবে ব্যাংক খাতের সুদহারের বিদ্যমান অস্থিরতা মানুষকে সম্পদ ক্রয়ে উৎসাহিত করছে। অনেকেই নগদ টাকায় ফ্ল্যাট কিনছেন।

Facebook Comments Box
top-1
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ২:৩৫ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২০

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

রডের দাম বাড়ছে
(11395 বার পঠিত)

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
প্রকাশক : সায়মুন নাহার জিদনী
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।