পান্না কুমার রায় রজত | রবিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২১ | প্রিন্ট | 475 বার পঠিত
এ মুহূর্তে বিশ্বের সবার মনে যে প্রশ্নটি জোরালো হয়ে দেখা দিয়েছে তা হল পৃথিবী কি আবার আগের রূপে ফিরবে- যেমনটি ছিল “প্রি কোভিড পিরিয়ড”? এখন পর্যন্ত বিশ্বের বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের মত হলো পৃথিবী হয়তো দ্রুত পূর্বরূপে আর ফিরবে না। তাহলে পৃথিবীর পরিবর্তিত স্বাভাবিক রূপ ধারণ করবে যা ইতোমধ্যে ‘দ্য নিউ নরমাল’ নামে বিশ্বব্যাপি পরিচিতি পেয়েছে। সঙ্গত কারণেই অর্থনীতিও পরিবর্তিত নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে এটি হলো ‘দ্য নিউ নরমাল ইকোনমিক্স’ বা নতুন স্বাভাবিক অর্থনীতি অথবা পরিবর্তিত অর্থনীতির নতুন রূপ।
করোনাকালে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত নতুন শব্দ বোধ করি সোশ্যাল ডিসট্যান্স। যদিও অনেকেই এই টার্মোলজি মানতে রাজি নয়। তারা ফিজিক্যাল ডিসট্যান্সিং শব্দে বেশি আগ্রহী। তবে বাংলাদেশের মতো সর্বোচ্চ ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এই ডিসট্যান্সিং নিশ্চিত করাটা দূরুহ। তবুও যতটুকু হচ্ছে সেটা কেউ কল্পনা করেনি আগে। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। মানুষ একত্রে থাকবে, একে অন্যের সাথে সুখে দুঃখে পাশে থাকবে, এটাই মানবধর্ম। করোনা এই মানবধর্মকে ত্বরান্বিত করেছে কিন্তু প্রক্রিয়াটি এতটাই আত্মরক্ষামূলক যা সামাজিক রীতিনীতিকে উল্টে দিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে নিজেকে মানুষ হিসেবে অথবা অমানুষ হিসেবে প্রমাণ করার সুযোগ এসেছে। আগে কোন ষ্টোরে বা প্রতিষ্ঠানে গ্লাভস বা মাস্ক পরে গেলে মানুষ অন্যরকম ভাবে তাকাত আর এখন কোন ডিপার্টমেন্টে বা ষ্টোরসহ সকল প্রতিষ্ঠানে বড় করে সাইনবোর্ড লাগানো থাকে No Mask, No Entry এটিই নিউ নরমাল।
মানুষকে সবচেয়ে ক্ষতিকর ভাববে মানুষ, এড়িয়ে চলবে একে অন্যকে। এখন বিচ্ছিন্ন থাকাটাই বেঁচে থাকা তবে সেটা হবে কনসাস লিভিং। হ্যান্ডশেক-কোলাকুলি যুগের অবসান হয়েছে ইতোমধ্যেই। রবীন্দ্রনাথের ব্রজেশ^র চরিত্রের শুচিবায়ুগ্রস্থতাই স্বাভাবিকতায় পরিণত হবে। মন খারাপ বা হাসি আনন্দের ইম্প্রেশন ঢাকা পড়বে মাস্কের নীচে। লাইফ স্টাইলের সাথে মানুষের ইন্টারেকশন স্টাইল পাল্টে যাবে। বাঙালির চিরায়ত আড্ডা রূপান্তরিত হবে ভার্চুয়াল আড্ডায়। হেলদিয়ার ডিজিটাল লাইফ স্টাইলে অভ্যস্ত হতে হবে সবাইকে যার গতি হবে জ্যামিতিক হারে। মীনা কার্টুনের মাধ্যমে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া শেখাতে ১০ বছর সময় লেগেছে ইউনিসেফের আর করোনা তা শিখিয়েছে মাত্র কয়েক মাসে।
মূলত, অভিযোজিত এই নতুন অর্থনৈতিক রূপান্তর শহরের অর্থনীতি তথা দেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে গ্রামীণ অর্থনীতি পুনর্গঠন অবশ্যম্ভাভাবী। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল ও দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির দেশে করোনার কারণে শিল্পে ব্যবহার্য কাচাঁমাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি হ্রাস পেয়েছে ব্যাপকভাবে। বেশিরভাগ র্শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কারখানার মালিক কর্মী ছাটাই করেছেন, ভবিষ্যতে কারখানার মালিকরা উৎপাদন ব্যয় কমানোর জন্য প্রযুক্তি নির্ভরতার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারেন। আমাদের অভ্যন্তরীন ভোগ চাহিদা অনেক কমে যাওয়ার আশংকা রয়েছে, কারণ সাধারণ মানুষের ভোগ চাহিদা বাড়ছে না। অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য কমে গেলে তা দেশের উৎপাদন ব্যবস্থায় নিশ্চিতভাবে প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশের বেশি সংখ্যক মানুষের স্থায়ী কোন পেশা নেই। তারা কখনো ধান কাটেন, কখনো সবজি চাষ করেন, কখনো মাছ ধরেন, কখনো দিন মজুর, কখনো বড়লোকের তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করেন। অন্যসময় তারা চা সিগারেট খেয়ে আড্ডা দিয়ে সময় কাটান। করোনাকালীন এই ধরনের পেশার মানুষগুলো পুরোপুরি কর্মহীন। সকল ধরনের ভাসমান ব্যবসায়ী, কামার-কুমার, গৃহকর্র্মী, রাজমিস্ত্রী, রিক্সা ও ক্ষুদ্র পরিবহন চালকসহ পরিত্যাক্ত জিনিস সংগ্রহের টোকাইয়ের কথা ভাবতে হবে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংযোজিত হওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা প্রধান, কিন্তু আমরা যারা রাষ্ট্রে নিজেদেরকে সচেতন বলে মনে করি তাদেরও দায়টা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রি-কোভিড যুগে বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ উদ্যোক্তা সহায় সম্বলহীন হয়েছে বৃহৎ পুঁজির কাছে। মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রবেশ দিয়ে আমরা কোটি কোটি মানুষের আয় বাণিজ্যের শেষ অবলম্বনটুকু কেড়ে নিয়ে তুলে দিয়েছি কর্পোরেটরদের হাতে। এক যুগ আগেও বাংলাদেশের প্রত্যেকটা উপজেলা এবং গ্রামে বেকারি, অটোমিল, ঘানিসহ অনেক প্রকার ক্ষুদ্র ও হস্তশিল্প কারখানা ছিল। ঝালমুড়ি, চানাচুর, মোয়া বিক্রি করে লাখ লাখ মানুষ জীবন জীবিকা নির্বাহ করতো। আজ প্রায় সবই চলে গেছে গুঁটিকয়েক কর্পোরেটের পকেটে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উৎপাদন ও বাজারে যদি বৃহৎ পুঁজিবাদীদের প্রবেশাধিকার এখনই সংরক্ষিত করা না হয় তবে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের ঢেউয়ের সঙ্গেও অভিযোজিত হতে আমাদের সমস্যা হবে না।
সময়ের প্রয়োজনেই বদলে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা সব ব্যবস্থা ও মানুষের আচরণ। শারীরিকভাবে যখন কাছে যাওয়ার সুযোগ নেই তখন ডিজিটাল প্ল্যাটর্ফমই সবাইকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। অনলাইন ইন্টারেক্টিভ মিটিং টুলস যেমন- গুগল মিট, জুম, ফেসবুক, মেসেঞ্জার, গো-টু-মিটিং, ওয়েববক্স, গেটটু-ওয়েবিনার, মাইক্রোসফট মিটিং, স্ট্রিমইয়ার্ড, বিস্ট্রিম ও বি-লাইভের মতো সফটওয়্যার ও অ্যাপস নৈমিত্তিক কাজের ভরসা। ইতোমধ্যে আমাদের মন ও মস্তিষ্ক নতুনের আহবানে সাড়া দিতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে Work from Home বা বাসায় বসে কাজের রীতি চালু হয়ে গিয়েছে। অনেক অফিসে, জব বা ট্র্যাকিং টুলসের ব্যবহার, ভার্চুয়াল কাস্টমার সার্ভিস এবং বিভিন্ন সফটওয়্যার ভিত্তিক মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাসহ কর্মক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন পরিলক্ষিত। শিল্পী আব্বাস উদ্দিনকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল শহুরে মানুষ কেন তার গান শোনে? উত্তরে বলেছিলেন ‘রেডিওর অপর প্রান্তে যে মানুষ বসে থাকেন তাদের প্রত্যেকেরই একটা শিকড় আছে গ্রামে’। একমাত্র শিকড়ই বৃক্ষকে বাচাঁতে পারে।
কোভিড পরবর্তী যুগে “কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি” মুক্তির গুরুত্বপূর্ণ এবং দেশের প্রধান ও একমাত্র পথ হতে পারে। বর্তমান “নিউ নরমাল” সময়ে মানুষ বিনিয়োগের জন্য কোন ক্ষেত্রগুলোকে গ্রহণ করবে তা নিয়ে যথেষ্ট ভাবনা চিন্তা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। বাজার অর্থনীতির যে রমরমা অবস্থা বহু দশক ধরে দেখা গেছে, তার জায়গায় এক ধরনের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কিংবা অর্থনীতিতে সরকারি খাতের ব্যাপকতর অংশগ্রহণ সামনের বছরগুলোতে দেখা যেতে পারে। বিশ্বায়ন বলতে আমরা এখন যা বুঝি তার পরিসমাপ্তি হয়তো এখানেই। করোনা ভাইরাস হচ্ছে অর্থনৈতিক বিশ^ায়নে শেষ পেরেক। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে যে ধরণের বিশ^ায়ণ দেখা গেছে যাতে উভয়পক্ষই সুবিধা পেয়েছে। বিশ^ আবার সেই অবস্থায় ফিরে যাবে তেমন সম্ভাবনা কম।
“নিউ নরমাল ইকোনমিক্স” হবে মূলত প্রযুক্তি নির্ভর অর্থনীতি। আমাদের ভবিষ্যত অর্থনীতি সচল ও সমৃদ্ব রাখতে অর্থনীতিকে যান্ত্রিক ও প্রযুক্তির মাধ্যমে ঢেলে সাজাতে হবে। উন্নয়ন শাস্ত্রে “নিউ নরমাল” বলতে মানুষের আচরণগত পরিবর্তনকে নির্দেশ করে, যে আচরণ পূর্বে অস্বাভাবিক ছিল পরবর্তী অবস্থায় তা স্বাভাবিক হিসেবেই পরিচিত হয়। “নিউ নরমাল” হলো মানুষের আচরণগত যোগাযোগের নতুন কৌশল। তবু আমরা আশাবাদী, বাংলাদেশের সাহসী ও শ্রমজীবি মানুষ এটা মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে এবং আমাদের কাম্য হবে কার্ল মার্কস ও এডাম স্মিথের একটি পলিটিক্যাল ইকোনমি নয় একটি “নিউ নরমাল ইকোনমি”।
Posted ২:৫৯ অপরাহ্ণ | রবিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২১
bankbimaarthonity.com | rina sristy