আবুল কাশেম | সোমবার, ১৭ জুলাই ২০২৩ | প্রিন্ট | 302 বার পঠিত
দেশের শীর্ষস্থানীয় গাড়ি আমদানিকারক “নিটল-নিলয় গ্রুপের” নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান ‘নিটল মটরস লিমিটেডের’ বিরুদ্ধে ৩৬৬ কোটি ৩৯ লাখ ৮৪ হাজার ১১২ টাকার ভ্যাট বকেয়ার অভিযোগে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। একই সঙ্গে অপরিশোধিত মূসক বা ভ্যাট কেন আদায় করা হবে না, ২১ কার্যদিবসের মধ্যে লিখিতভাবে সন্তোষজনক জবাব চাওয়া হয়েছে।
গত ১৪ জুন যশোর কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার মো. মোয়াজ্জেম হোসেনের স্বাক্ষরে নিটল মটরস লিমিটেড কর্তৃপক্ষ বরাবর ৩৬৬ কোটি ৩৯ লাখ ৮৪ হাজার ১১২ টাকার ভ্যাটের দাবিনামা সম্বলিত ৭ পৃষ্টার একটি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে, এনবিআর’র অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিশাল অঙ্কের ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে। ভারত থেকে ৫ বছর আগে গাড়ি আমাদানি ও বিক্রির বাণিজ্যিক বিষয়ে ভ্যাট অনাদায়ীর ঘটনায় এনবিআর থেকে নিটল মটরস লিমিটেড কর্তৃপক্ষকে এ দাবিনামা নোটিশ পাঠানো হয়। এরমধ্যে বিক্রয়ের তথ্য প্রদর্শন না করে ভ্যাট ফাঁকি ৮৩ কোটি টাকা, যানবাহন পরিচালন আয় থেকে ভ্যাট ফাঁকি ২৭৮ কোটি টাকা, অফিসের পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ফাঁকি সাড়ে ৪ কোটি টাকা, স্থান-স্থাপনা ভাড়ায় ভ্যাট ফাঁকি ৫৩ লাখ টাকা রয়েছে বলা হয়। নোটিশে আরও উল্লেখ করা হয়, যশোরের অভয়নগর চেঙ্গুটিয়ার প্রেমবাগ ঠিকানায় ‘ভারতীয় টাটা মটরস লিমিটেড এবং নিটল মটরস লিমিটেডের জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানির নাম ‘নীতা মটরস লিমিটেড।’ নীতা মটরস লিমিটেডের মাধ্যমে ভারত থেকে বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, পিক-আপ ইত্যাদি যানবাহন সম্পূর্ণ প্রস্তুত (সিবিইউ) অবস্থায় আমদানি করে থাকে নিটল মটরস লিমিটেড’।
নোটিশে বলা হয়, এনবিআর’র নিরীক্ষায় চার ধরনের অনিয়ম শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে- ক্রয় ও বিক্রয়ের রেজিস্টার যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করা জনিত অনিয়ম; স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত উপকরণ ক্রয় রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ ব্যতীত সরবরাহ করা জনিত অনিয়ম, সি এ রিপোর্ট মোতাবেক কর্তনযোগ্য উৎসে মূসক যথাযথভাবে কর্তন না করা এবং পণ্য ও সেবা সরবরাহের বিপরীতে যথাযথ মূসক পরিশোধ না করায় মূসক বা ভ্যাট অনাদায়ী রয়েছে। এ অনিয়মের মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের ভ্যাট বা মূসক বকেয়া রয়েছে। এটা প্রথম পর্যায়ের দাবিনামা। যদি শুনানির মাধ্যমে সমাধান হয়, তা হলে দুই পক্ষের জন্যই শুভ।
এনবিআর’র দাবিনামায় মোট আমদানি ও বিক্রি করা গাড়ির মূল্যের উপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইন ১৯৯১ এর ধারা ৩৭ এর উপধারা (৩) অনুযায়ী মাসিক ২ শতাংশ হারে সুদও প্রযোজ্য। প্রতিষ্ঠানটির এরূপ কার্যকলাপ মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১ এর ধারা ৩, ৪, ৫, ৬ (৪-ক হতে ৪-ছ) ৭, ৩১, ৩২ ও মূল্য সংযোজন কর বিধিমালা, ১৯৯১ এর বিধি ১৮-ক এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যা মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১ এর ধারা ৩৭ মোতাবেক দণ্ডারোপযোগ্য। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কারণ দর্শানো নোটিশের জবাব পাওয়া না গেলে মূসক আইন অনুযায়ী দাবিনামা চূড়ান্ত করা হবে। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে নীতা কোম্পানি লিমিটেড কর্তৃক নিটল মটরসের নিকট বিক্রয় করা বাস, ট্রাক, পিক-আপ হিসাবে মোট চার হাজার ১৯৯ ইউনিট মূসক রেজিস্টারে প্রদর্শন না করে ভ্যাট পরিহার বা ফাঁকি দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় ভ্যাট অফিসের নিরীক্ষায়। সবমিলিয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নিরীক্ষায় উদঘাটিত রাজস্ব বা ভ্যাটবাবদ ৩৬৬ কোটি ৩৯ লাখ ৮৪ হাজার ১১২ টাকা নিটল মটরস লিমিটেডের নিকট আদায়যোগ্য বলে মনে করছে এনবিআর।
এদিকে নিটল মটরস লিমিটেডের পক্ষে সিনিয়র ব্যবস্থাপক (কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট) আনিসুর রহমানের স্বাক্ষরে গত ৫ জুলাই (২০২৩) এনবিআর’র কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের যশোর অফিসে তথ্য অধিকার আইনে প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র চেয়ে ডাকযোগে আবেদনপত্র পাঠানো হয়েছে। ওই আবেদনপত্রে বেশকিছু যৌক্তিক প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়। প্রশ্নের মধ্যে রয়েছে, একই যানবাহনের উপর ৩ বার ১৫ শতাংশ মূসক (ভ্যাট) নিধারণ করা হয়েছে। বিআরটিএ’র রেজিস্ট্রেশন থাকা সত্বেও স্থায়ী সম্পদকে (যানবাহন) পণ্য হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বিআরটিএ’র রেজিস্ট্রেশনের পরও গত ২০১৯ সালে ১ সেপ্টেম্বর এনবিআর গত ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭-১৮ পর্যন্ত ১৩ হাজার ৭৬৪টি গাড়ির ক্রয় মূল্যের উপর পরিশোধিত ১৫% মূসক রেয়াত না দিয়ে স্থায়ী সম্পদ ‘পণ্য’ হিসেবে বিবেচনা করে অনুমিত বিক্রয় মূল্যের উপর ১৫% মূসক দাবি করা হয়েছে।
এরআগে নিটল মটরসের পক্ষ থেকে গত ২০১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তথ্য অধিকার আইনে এনবিআর’র সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু ওই চিঠির আলোকে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি না দিয়ে আবার ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে ৪,১৯৯ টি গাড়িসহ পূর্বের বিভিন্ন অর্থ বছরের গাড়ির বিপরীতে আদায়কৃত ভাড়া অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। একবার বিক্রয় মূসক আবার আদায়কৃত ভাড়াকে বিবিধ সেবার আয় হিসাবে ১৫% সেবা মূসক দাবি করা হয়েছে। অর্থাৎ একই গাড়ির উপর ৩ বার ১৫% হিসাবে মূসক দাবি করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিআরটিএ’র মালিকানা যাচাই বাছাই না করেই ২০১২ সালের ২৮ জুনের ‘এসআরও’-২৪২ এর ২০১৫ সালের ৪ জুন সংশোধিত ‘এসআরও’- ১২৪ এবং সর্বশেষ সংশোধিত ২০১৮ সালের ৭ জুন ‘এসআরও’-১৭৪ এর রেজুলেশন ৯ এবং ১২ আমলে না নিয়ে ১৫% বিক্রয় মূসক (ভ্যাট) দাবি করা হয়েছে। এভাবে একটি যানবাহনের উপর ৩ বার ভ্যাট দাবি করার কোন যৌক্তিকতা নেই। নোটিশের তথ্য অনুযায়ী ‘নীতা কোম্পানি লিমিটেড’ থেকে আমদানি করা ৪ হাজার ১৯৯ টি গাড়ির মূসক চালান নং, ইঞ্জিন নং, চেচিস নং এবং ক্রয় মূল্যের উপর ১৫% পরিশোধিত মূসকের পরিমাণ এবং তথ্যাদির সত্যায়িত কপি পাবার জন্য আবেদন জানানো হয়েছে। একই গত ২৬ জুন নিটল মটরস থেকে কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের যশোরের অফিসে তথ্যাদির সত্যায়িত কপি পাবার জন্য ‘সাধারণ আদেশ নং-১৫/মূসক/২০১৫, তারিখ ৩০/০৮২০১৫, দফা ৩.৩ মোতাবেক একটি আবেদন পত্রের সাথে সোনালী ব্যাংক মহাখালী শাখার মাধ্যমে ৫ হাজার ৫ শত টাকা ট্রেজারি চালানের কপিও পাঠানো হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আলোচিত বিষয় নিয়ে নিটল-নিলয় গ্রুপের ফিন্যান্স পরিচালক মোহাম্মদ সেলিম “দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতিকে” বলেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় গাড়ি আমদানিকারক “নিটল-নিলয় গ্রুপের” নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স নিটল মটরস লিমিটেডকে’ ভ্যাট আদায়ের নামে অযথা হয়রানি করা হচ্ছে।‘৫ বছর আগের ডিমান্ড হঠাৎ করে দিয়ে দিলেন, কীভাবে দিলেন? আমরা খুবই আশ্চর্য হয়েছি। তিনি বলেন, এনবিআর থেকে পাঠানো নোটিশটি গত ২২ জুন পাবার পর গত ৫ জুলাই সময় চেয়ে আবেদন জানানো হয়েছে। তবে আগামী ১৯ জুলাই যশোর কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার অফিসের সংম্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে নিটল মটরস লিমিটেডের কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক হবার কথা রয়েছে। ওই বৈঠকে ঊভয় পক্ষের রেকর্ড পত্র পর্যালোচনা এবং যৌক্তিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
এজন্য তথ্য অধিকার আইনে গত ৫ জুলাই তথ্য-উপাত্ত চেয়েছি। তাদের জবাব পেলে আমরা শুনানি দেব। এরপরও যদি মীমাংসা না হয়, তাহলে আমরা আদালতে যাব। আমি বলব, ভ্যাট অফিস আইন ও বিধির যথাযথ প্রয়োগ করতে পারেনি। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা আমাদের সুনামেরও বিষয়, বিব্রতকরও।’ ‘এটা অনেক আগের একটা বিষয়। আমাদের কাছে যদি ভ্যাট পাওনা থাকত, তখনই বলত। কিন্তু তারা ওই সময় দাবি করেনি। আমাদের এ গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান কখনও সরকারের একটা টাকাও বকেয়া রাখেনি। এমনকি কোনো ব্যাংকও আমাদের কাছে টাকা পাবে না। আমাদের ৩০-৩৫টি ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন রয়েছে।’
Posted ৮:২৫ অপরাহ্ণ | সোমবার, ১৭ জুলাই ২০২৩
bankbimaarthonity.com | rina sristy