বিবিএনিউজ.নেট | রবিবার, ০২ জুন ২০১৯ | প্রিন্ট | 638 বার পঠিত
গত এপ্রিলে ৫৭ মাসের মধ্যে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধির পরিমাণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসে নেমেছে। আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া ও তারল্য সংকটের কারণে এমনটি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি এপ্রিলে এসে হঠাৎ করে ১২.০৭ শতাংশ কমে গেছে। ২০১৪ সালে এটি সর্বনিন্ম ১১ দশমিক ৩৯ শতাংশে ছিল। গত মার্চ ও এপ্রিল বেসরকারি খাতের ঋণ ছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ৪২ ও ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ধীরগতির ঋণ প্রবৃদ্ধির পর এখনই সতর্ক না হলে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হুমকির মুখে পড়বে। এটি প্রমাণ করে যে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ একেবারেই সর্বনিন্ম।
তারা আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে এক্ষেত্রে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ খুঁজে বের করে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের এপ্রিলে বেসরকারি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৯ লাখ ৮৭ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। গত মার্চে যেটির পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৮১ হাজার ৫১০ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট একটি আশঙ্কাজন অবস্থানে আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারণ করে দেয়া এডিআরের সীমাবদ্ধতাও বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার অন্যতম একটি বড় কারণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেকটি তথ্যে দেখা যায়, ব্যাংক খাতের আমানতের প্রবৃদ্ধি এপ্রিল পর্যন্ত বেড়েছে। এপ্রিল পর্যন্ত আমানতের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছিল ১০ দশমিক ৫২ শতাংশ। অথচ ডিসেম্বরেও এই অনুপাত ছিল ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ।
ব্যাংকাররা বলছেন, সরকারের ঋণ নেয়া বেড়ে যাওয়া বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ। মে মাসের ১৫ তারিখের হিসেবে চলতি অর্থবছরের এখন পর্যন্ত ব্যাংক খাত থেকে ৭ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য আরও বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে গত ৫ মার্চ পর্যন্ত তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে রেপোর (পুনঃক্রয় চুক্তি) মাধ্যমে ১৩ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা ধার নিয়েছে। অথচ পুরো ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রেপোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো ধার নিয়েছিল ৫৭৩ কোটি টাকা।
এদিকে গত মার্চে ব্যাংকগুলোর ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়িয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। আগের সময়সীমা অনুযায়ী ৩০ মার্চের মধ্যে এডিআর সমন্বয়ের কথা ছিল। গত বছরের ৩০ জানুয়ারি এডিআর কমানোর নির্দেশনা দেওয়ার পর থেকে তা সমন্বয়ের জন্য এ নিয়ে চার দফা সময় বাড়ানো হলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ২০টি ব্যাংকের এডিআর নির্ধারিত সীমার ওপরে রয়েছে। এর মধ্যে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে বেসরকারি খাতের ১১টি ব্যাংক। সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে শুধু বেসিক এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক রয়েছে এ তালিকায়। আর ইসলামী শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত সাতটি ব্যাংকের এডিআর বেশি রয়েছে।
ঋণ প্রবৃদ্ধি ব্যাপক বাড়তে থাকায় ব্যাংকগুলোর ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) কমিয়ে গত ৩০ জানুয়ারি একটি সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এডিআর কমিয়ে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর জন্য ৮৩ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য ৮৯ শতাংশ করা হয়। আগে যা ৮৫ ও ৯০ শতাংশ ছিল। ব্যাংকগুলোর এডিআর নির্ধারিত সীমায় নামিয়ে আনতে প্রথমে গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় দেয়া হয়। এরপর আরেকটি সার্কুলারের মাধ্যমে সময় বাড়িয়ে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর করা হয়। তবে তারল্য সংকটের কথা বলে বিভিন্ন দাবিতে সরব হয় বিএবি। পরবর্তীতে সময় আরও বাড়িয়ে ৩০ মার্চ নির্ধারণ করা হয়। এখন আরেক দফা সময় বাড়ল।
২০১৮ সালে দেশের ব্যাংকগুলোতে ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করা হয়েছে। যা তার আগের বছরের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি। এভাবে গত পাঁচ বছরে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন-২০১৮ এ তথ্য উঠে এসেছে। গত মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট-২০১৮ নামে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। যার মোড়ক উন্মোচন করেছেন গভর্নর ফজলে কবির।
জানা গেছে, সম্ভাব্য খেলাপি হওয়া থেকে বিরত থাকতে এবং খেলাপি হওয়ার পর তা নিয়মিত করতে পুনঃতফসিল করেন ঋণগ্রহীতারা। পুনঃতফসিল করতে নির্ধারিত হারে নগদ ডাউন পেমেন্ট দেয়ার নিয়ম রয়েছে। ২০১২ সালে ঋণ পুনঃতফসিলের পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা জারি করা হয়। তবে ২০১৩ সালে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিবেচনায় শিথিল শর্তে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়া হয়।
এর পরের বছর থেকে ব্যাংকগুলোর ঋণ পুনঃতফসিলের গতি বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। ২০১৪ সালে ১২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পেয়েছিলেন খেলাপি গ্রাহকরা। এরপর ২০১৫ সালে ১৯ হাজার ১৪০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। ২০১৬ সালে ১৫ হাজার ৪২০ কোটি টাকা এবং ২০১৭ সালে ১৯ হাজার ১২০ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করার সুযোগ পান খেলাপি গ্রাহকরা। সব মিলিয়ে গত পাঁচ বছরে ৮৯ হাজার ২৪০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করেছে ব্যাংকগুলো।
ব্যাংকাররা বলছেন, প্রভাবশালী গ্রাহকদের চাপের মুখে পুনঃতফসিল সুবিধা দিতে বাধ্য হচ্ছে ব্যাংক। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি পুনঃতফসিল করা হয়েছে। পুনঃতফসিল সুবিধার ৫৮ শতাংশই ভোগ করেছেন বড় বড় শিল্পপতিরা।
Posted ১১:৩২ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ০২ জুন ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed