শুক্রবার ১৯ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবস্থাপনা ব্যয়

দেউলিয়ার পথে ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   বুধবার, ১০ নভেম্বর ২০২১   |   প্রিন্ট   |   462 বার পঠিত

দেউলিয়ার পথে ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স

বীমা কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় নিয়ে একাধিক নির্দেশনাসহ প্রবিধি প্রণয়ন করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে ২০১৬ সাল থেকে এমন কার্যক্রম চলমান রাখলেও এখন পর্যন্ত কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত ব্যয় নিয়ন্ত্রনে জোরালো পদক্ষেপ নিতে পারেনি বীমা খাতের এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা। অধিকন্তু বীমা আইন ও প্রবিধির পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দস্তুর ব্যয় বাড়িয়ে গ্রাহকদের আমানত ঝুঁকির মুখে ফেলছে কয়েকটি কোম্পানি। তেমনই একটি প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা খাতে প্রথম প্রজন্মের প্রতিষ্ঠান ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাবেক চেয়ারম্যান এম. শেফাক আহমেদের সময়কালে নির্ধরিত ব্যয়সীমা থেকে কম খরচ করে অতিরিক্ত ব্যয় করা অর্থ পুন:ভরনের লিখিত অঙ্গিকার দিলেও তা মানেনি প্রতিষ্ঠানটি। বরং এরপর থেকে ব্যয় বাড়িয়েছে আগের চেয়ে কয়েকগুন বেশি। প্রতিষ্ঠানের এমন মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়কে অনাকাঙ্খিত ও অনভিপ্রেত বলছেন স্টেকহোল্ডাররা। এতে কোম্পানির আর্থিক ভিত দূর্বল হওয়ার পাশাপাশি ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা আছে গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের। এমনটাই জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, সমাপ্ত ২০২০ সালে আইডিআরএ নির্ধারিত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের চেয়ে অতিরিক্ত খরচ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। (প্রতি বছরই এমন অত্যাধিক ব্যয় করেছে)। সমাপ্ত বছরের ম্যানেজমেন্ট এক্সপেন্স বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আইডিআরএর সার্কুলার অনুসারে ২০২০ সালে কোম্পানির অনুমোদিত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা ছিল ২৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা প্রায়। অথচ এ সময়ে প্রতিষ্ঠানটি মোট প্রিমিয়ামের ৪৪.০৪ শতাংশ বা ৩৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকারও বেশি ব্যয় করে। নির্দেশনা লঙ্ঘন করে ৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকারও বেশি ব্যবস্থাপনা ব্যয় হয়, যা মোট ব্যবসার ১০.৪১ শতাংশ। একই চিত্র দেখা যায় ২০১৯ সালেও। ওই বছরে কোম্পানির অনুমোদিত ব্যবস্থাপনা ব্যয় সীমা ছিল প্রায় ৩৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। অথচ কোম্পানি মোট প্রিমিয়ামের ৪০.৭৬ শতাংশ বা প্রায় ৪২ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয় করে। সে সময় আইন অমান্য করে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় হয় প্রায় ৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, যা মোট ব্যবসার ৭.৫০ শতাংশ।

এই অতিরিক্ত ব্যয়ের ফলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) কর বাবদ ২০২০ সালে ৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা এবং ২০১৯ সালের জন্য প্রায় ২ কোটি ৯১ লাখ টাকা বাধ্যতামূলক প্রদান করতে হবে। অর্থাৎ দুই বছরে কর বাবদ রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে ৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এছাড়া অতিরিক্ত ব্যয়ের বাকি প্রায় ১০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা প্রতিবছর নির্ধারিত ব্যয়ের চেয়ে কমিয়ে পুনর্ভরণ হিসেবে সমন্বয় করতে হবে। এজন্য ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সের পরিচালনা পর্ষদকে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে হবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যানের কাছে, এমনটাই জানান বিনিয়োগকারীরা।

এদিকে আইন লঙ্ঘন করে ব্যয় করলেও কোম্পানির বহিঃনিরীক্ষক শফিক বসাক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এটি উল্লেখ করে কোয়ালিফাইড ওপিনিয়ন (আপত্তি) এবং ম্যাটার অব অ্যম্ফাসাইস দেয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা না দেয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছে খাত সংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিযোগ কোম্পানির এই অনিয়মে নিরব সায় দেয়ায় নিয়ম ভঙ্গের দায় এই নিরীক্ষকের উপরও বর্তায়। সেক্ষেত্রে অনাপত্তি দেয়ার কারণ খুঁজে বের করে শফিক বসাক অ্যান্ড কোম্পানির দায়িত্বে অবহেলার জন্য আইনসঙ্গত ব্যবস্থা গ্রহণে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) প্রতি দাবি জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

প্রতিষ্ঠানটির এমন আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডাররা জানান- মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের ফলে ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সের সাথে সম্পর্কিত সকলে স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে। পরিচালকরা অবৈধভাবে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার বঞ্চিত হয়েছে গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীরা। পাশাপাশি দূর্বল হয়েছে কোম্পানির আর্থিক ভিত্তি। ফলে ভবিষ্যতে কমে যেতে পারে গ্রাহকদের বীমা দাবী পরিশোধ ও বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ প্রদানের সক্ষমতা। তারা বলেন- এই অতিরিক্ত ব্যয় না হলে কোম্পানির লভ্যাংশ প্রদানের সক্ষমতা কয়েকগুন বেড়ে যেতো। এতে লাভবান হতো বিনিয়োগকারীরা। আবার এখান থেকে সরকারও কোটি টাকা রাজস্ব পেতো। বীমা দাবী পরিশোধের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন সময়ে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। অনেক সময় প্রকৃত দাবী না থাকলেও মিথ্যা দাবী উত্থাপন করে অর্থ ভাগবাটোয়ারা করার বিষয়ে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র। (এ বিষয়ে পরবর্তী প্রতিবেদনে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে)

বিনিয়োগকারীরা জানান- পুঁজিবাজারে কারসাজির সাথে যে কয়টি প্রতিষ্ঠান জড়িত তাদের একটি হলো ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স। প্রতিষ্ঠানটির এসব অনিয়মের দায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএকেও নিতে হচ্ছে। তাই আইন পরিপালনে কোম্পানিকে বাধ্য করতে বড় কোন দূর্ঘটনা ঘটার পূর্বেই আইডিআরএ এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বিএসইসিকে ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সের এমন ব্যয় সম্পর্কে খাত সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য হলো- ‘প্রতিষ্ঠানটির যে বীমা আইনের প্রতি নজরদিচ্ছে না, এতে স্পষ্ট বুঝা যায়। এতে কোম্পানির ব্যবস্থাপনার দৈন্যদশা প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে কোম্পানিটি ধীরে ধীরে দেউলিয়াত্বের দিকে ধাবিত হবে।’ আর্থিক প্রতিবেদনের এমন ডিফেক্ট অডিটের সাথে জড়িত সকলকেই শাস্তি ও জরিমানার আওতায়ও নিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন তারা। তাছাড়া এমন ঘটনাও মানিলন্ডারিংয়ের সম্পৃক্ততাও থাকতে পারে এমনটা জানিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বিএফআইইউ ও দুদকসহ সংশ্লিষ্টদের পদক্ষেপ নেয়ারও আহবান জানিয়েছে। অপরদিকে বিনিয়োগকারীদের ধারণা, ম্যানেজমেন্ট কস্ট এতো বৃদ্ধি না পেলে কোম্পানি ২৫-৩০ শতাংশ লভ্যাংশ প্রদান করতে পারতো। কিন্তু পুঁজিবাজারে ‘এ’ ক্যাটাগরি অবস্থান ধরে রাখার কৌশল হিসেবে গত দুই বছর যাবত নগদ ও বোনাস মিলিয়ে মাত্র ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিতেই প্রতিষ্ঠানটির ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এটি স্টেকহোল্ডারদের জন্য এটি একটি ভয়াবহ চিত্র।

তারা বলেন- লিস্টেড কোম্পানি হিসেবে ব্যয়ের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটিকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে আরো ভূমিকা পালন করতে হবে। তাছাড়া ব্যবস্থাপনা ব্যয় সম্পর্কিত আইডিআরএ নির্দেশনা অমান্য করায় শফিক বসাক এন্ড কোং তাদের প্রতিবেদনে কোয়ালিফাইড অপিনিয়ন না দেয়ায় এটি স্টেকহোল্ডারদের সাথে প্রতারণা করার শামিল বলেও জানান তারা।
উল্লেখ্য, বীমা আইনের ব্যবস্থাপনা ব্যয় সম্পর্কিত বিধি অনুসারে ২০১৬ সালে গ্রাহকদের স্বার্থরক্ষায় অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় বন্ধে তৎকালীন চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদের নেতৃত্বে আইডিআরএ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় কোম্পানিগুলোকে বিধি অনুসারে ব্যয় করার নির্দেশনা দেয়। পাশাপাশি কয়েকটি বিষয়ে লিখিত প্রতিশ্রুতি নেয় কোম্পানির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদ থেকে। এর মধ্যে রয়েছে- ১. অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় সর্বোচ্চ ৫ বছরের মধ্যে কমিয়ে পুন:ভরণ করা, ২. কোম্পানিসমূহের বোর্ড সভার সিদ্ধান্তসহ অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় পুন:ভরণের অঙ্গিকারনামা নেয়া, ৩. কোম্পানির তহবিলে অতিরিক্ত ব্যয়িত ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমিয়ে আনতে পরিচালকগণকে ব্যাক্তিগত উদ্যোগসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ৪. আইডিআরএ’র পক্ষ থেকে নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিসমূহের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমানো সহ সকল কার্যক্রম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা এবং সময়ে সময়ে ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা পর্ষদকে সভায় আহ্বান করে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান।

বীমা খাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি উন্নয়ণ অব্যাহত রাখতে আইডিআরএ’র সাবেক চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন খাত বিশ্লেষকরা। বীমা কোম্পানিগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন পরিপালন নিশ্চিত হলে এর সুফল ভোগ করবে সাধারণ জনগণসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডাররা। এতে আইডিআরএ’র ভাবমূর্তি উজ্জল হওয়ার পাশাপাশি তাদের সুসংহত অবস্থান সম্পর্কে সম্যক ধারণ পাবে পুরো দেশসহ বিশ্বসংস্থাগুলো।

 

 

 

 

 

 

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১২:২৮ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১০ নভেম্বর ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।