বিবিএনিউজ.নেট | বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০১৯ | প্রিন্ট | 374 বার পঠিত
অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ে অরাজকতা চলছে। পেঁয়াজের দাম দেশবাসীকে ভোগাচ্ছে দীর্ঘ দুই মাস ধরে। দাম পৌনে তিন শ’ টাকায় পৌঁছে যাওয়ায় দেশব্যাপী পেঁয়াজ নিয়ে যে হইচই সৃষ্টি হয় তারই ফাঁকে বেড়ে গেছে চাল, তেল, সবজিসহ অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম। বেশ কয়েকটি সবজির দাম এখন ১০০ টাকার ঘরে। ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি শসা। সাধারণ সবজি হিসেবে পরিচিত শালগমের কেজিও এখন ৮০ টাকা। টমেটো বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা কেজিদরে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা এবং কার্গো বিমানে আমদানির সিদ্ধান্তে পেঁয়াজের দাম কিছুটা থমকে দাঁড়ালেও প্রায় সব নিত্যপণ্যের দামই হু হু করে বাড়ছে। এরই মধ্যে হৈ-হুল্লোড় বাধিয়ে দিয়েছে লবণ। গুজবের হুজোগে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে লবণ বিক্রির খবরও পাওয়া গেছে। এসব নিয়ে জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হলেও সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগের অভাব লক্ষ করা গেছে।
তিন মাস আগেও বাজারে প্রতি কেজি ভালো মানের দেশী পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। ভারতীয় পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। এরই মধ্যে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে এসে ভারত প্রথমে পেঁয়াজের রফতানিমূল্য প্রতি টন ২৫০ রুপি থেকে বাড়িয়ে ৮০০ রুপি নির্ধারণ করে। দুই সপ্তাহ না যেতেই ২৯ সেপ্টেম্বর নিষিদ্ধ ঘোষণা করে পেঁয়াজ রফতানি। আর তাতেই মওকা পেয়ে যায় ব্যবসায়ীদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তাদের কারসাজিতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। ৫০, ৬০, ৮০, ১০০, ১২০, ১৬০, ২০০, ২৫০ এবং সর্বশেষ ২৭৫ টাকায় ওঠে পেঁয়াজের দর। এরই মধ্যে সরকারের সাথে যোগসাজশের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডিকেট হাতিয়ে নেয় শত শত কোটি টাকা।
সরকার তার চেষ্টা প্রচেষ্টা কিছু অভিযান এবং টিসিবির মাধ্যমে ৪৫ টাকা দরে কয়েক টন পেঁয়াজ বিক্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখায় জন অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শনিবার কার্গো বিমানে পেঁয়াজ আমদানির ঘোষণা দিলে থমকে দাঁড়ায় বাজার। ২৭৫ টাকা থেকে দাম নেমে আসে ২০০ টাকায়। কিন্তু ঘোষণা অনুযায়ী মঙ্গলবার পেঁয়াজ নিয়ে কার্গো বিমান দেশে না পৌঁছায় ছন্দপতন ঘটে এ উদ্যোগেও। মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘বিমানে আমদানি করা পেঁয়াজের প্রথম চালান আজকে (মঙ্গলবার) আসার কথা ছিল। কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না। সেটা বুধবার আসবে।’
পেঁয়াজ নিয়ে ডামাডোলের ফাঁকে বেড়ে গেছে চালের দামও। রাজধানীর মৌলভীবাজার পাইকারি মার্কেটে গতকাল প্রতি কেজি ভালো মানের মিনিকেট চাল বিক্রি হয় ৫৯ থেকে ৬০ টাকায়। খুচরা বাজারে এসে একই চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৪ থেকে ৬৫ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে খুচরা বাজারেই এ দাম ছিল ৫৮ থেকে ৫৯ টাকা। কয়েক দিন আগে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে মোটা চালের কেজিপ্রতি দর ছিল ৩২ থেকে ৩৪ টাকা, যা গতকাল বিক্রি হয় ৩৬ থেকে ৩৭ টাকা কেজিদরে। মাঝারি মানের বিআর-২৮ জাতের চালের দাম কেজিতে ৪ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকায়। অথচ আড়তদার, মিল মালিক কিংবা খুচরা বিক্রেতা- সবাই একবাক্যে বলছেন এ সময়ে এভাবে চালের দাম বাড়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদার নিজেও বলেছেন, দেশে চালের পর্যাপ্ত মজুদ আছে এবং সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই।
স্বস্তি নেই সবজির বাজারেও। ঢাকার খুচরা বাজারে গতকাল পাকা টমেটো বিক্রি হয় ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজিদরে। কাঁচা টমেটোর কেজি ৮০ টাকা। বাজারে গতকাল ছোট আকারের প্রতিটি লাউ বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৮০ টাকা পিস। নতুন আলুর কেজি ১০০ টাকা। এ ছাড়া গাজর বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি। করলা বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। বেগুন, পটোল, ঝিঙ্গা, ধুন্দল, চিচিংগা, কাঁকরল, ঢেঁড়স, বরবটি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি। কাঁচা মরিচের কেজি ৭০ থেকে ১০০ টাকা। শিম বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। শীতকালীন সবজি ছোট আকারের প্রতি পিস ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। একই দামে বিক্রি হচ্ছে বাঁধাকপি। এক কেজি মুলা বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। ধনেপাতার কেজি ৩০০ টাকা। লেবু ও কলার হালি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা।
গত এক সপ্তাহে ভোজ্যতেলের দামও বেড়েছে লিটারে চার থেকে পাঁচ টাকা। আদার দাম কয়েক মাস ধরেই বেশি। আমদানি করা আদা ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা এবং দেশী নতুন আদা বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়। রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়। সপ্তাহের ব্যবধানে বয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। গত সপ্তাহে বাজারে যে মুরগি বিক্রি হয় ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা কেজিদরে গতকাল সেগুলো বিক্রি হয় ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায়। খুচরা বাজারে পাকিস্তানি কক মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২১০ থেকে ২২০ টাকা কেজি। আর লাল লেয়ার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ২০০ টাকায়। বাজারভেদে গরুর গোশত বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৫৭০ টাকা এবং খাসির গোশত বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৮৫০ টাকা কেজিদরে।
রাজধানীর খুচরা বাজারে কয়েক মাস ধরেই এমন চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ ছাড়া সব ধরনের মাছ। খুচরা বাজারে গতকাল এক কেজি থেকে ১ কেজি ২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা কেজিদরে। আর পিস বিক্রি হচ্ছে ১০০০ থেকে ১১০০ টাকার মধ্যে। ৮০০ গ্রাম থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা কেজি। পিস হিসেবে বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে। বাজার ও মানভেদে প্রতি কেজি তেলাপিয়া ও পাঙ্গাশ মাছ বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা। রুই ও কাতল মাছ বিক্রি হয় ২৮০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি। এ ছাড়া পাবদা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, ট্যাংরা ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা, শিং ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা কেজি। স্বস্তি দিচ্ছে না ছোট মাছও। কাচকি মাছ বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজিদরে।
বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী পণ্যের সরবরাহ কমলে দাম বাড়ে আর সরবরাহ বাড়লে দাম কমে। কিন্তু বাংলাদেশে সব সময় এই নিয়ম খাটে না। বর্তমানে বাজারে যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে, পেঁয়াজ ছাড়া কোনোটির সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। পেঁয়াজের দাম বাড়ার পক্ষে যুক্তি দেখানো হয়েছিল যে ভারত রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। সময়মতো বিকল্প বাজার থেকে পেঁয়াজ আনা গেলে অসাধু ব্যবসায়ীরা ভোক্তাসাধারণের পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিতে পারতেন না। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে গুটিকয়েক ছোট ব্যবসায়ী ধরা পড়লেও বড় মজুদদারেরা বরাবরের মতো রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরেই। এ নিয়ে জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ থাকলেও সরকার অনেকটাই নির্বিকার।
তবে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা মঝে মধ্যেই উদ্ভট কথা বলে বাজারকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলছেন এবং মানুষের কষ্ট নিয়ে তামাশা করছেন বলে অভিযোগ উঠছে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকার নিচে নামার সম্ভাবনা নেই মর্মে বক্তব্য দিয়ে বাজারকে প্রভাবিত করেছেন বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার চালকল মালিকদের সাথে বৈঠক করে দাম না বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দেশে চালের যথেষ্ট মজুদ আছে। তবে বাংলাদেশের মানুষ এখন বেশি বেশি করে চিকন চালের ভাত খাওয়ায় চিকন চালের দাম বেড়েছে। মন্ত্রীর এই তত্ত্বকে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে উপহাস বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে।
Posted ৪:১১ অপরাহ্ণ | বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed